সম্বলটুকু বাঁচানোর চেষ্টা। বকখালিতে বুলবুলের দাপটের পর। ছবি: পিটিআই।
ঝড় আসে। ঝড় চলিয়াও যায়। ধ্বংসচিহ্নগুলি পশ্চাতে পড়িয়া থাকে। ৯ নভেম্বরের রাত্রে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল পশ্চিমবঙ্গে যে তাণ্ডবলীলা চালাইয়াছে, তাহার চিহ্ন রাজ্যের উপকূলের সর্বত্র বিদ্যমান। আঘাত হানিবার পর সে দ্রুত শক্তিক্ষয় করিয়া বাংলাদেশের পথে অগ্রসর হইয়াছে বলিয়া হয়তো শহর কলিকাতা বাঁচিয়াছে। কিন্তু উপকূলবর্তী গ্রামাঞ্চলকে সে ছাড় দেয় নাই। সেখানে প্রাণহানি ঘটিয়াছে, ঘর ভাঙিয়াছে, ফসলের খেত তছনছ হইয়াছে এবং গৃহহীন পরিবারগুলির কাছে ভবিষ্যৎ লইয়া এক বৃহৎ প্রশ্নচিহ্ন ঝুলাইয়া দিয়াছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার সম্ভব হইলে হয়তো দেখা যাইবে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। তাই, ঝড় শুধুমাত্র কাব্যের অনুপ্রেরণা নহে, তাহার বাস্তব অভিঘাত বড় নির্দয়, বড় মর্মান্তিক।
আয়লার সময় যে সরকারি অ-প্রস্তুত অবস্থা দেখা গিয়াছিল, বুলবুলের ক্ষেত্রে তাহা হয় নাই। আবহাওয়া দফতরের সঙ্গে সরকারি বিভাগগুলির যথাযথ সামঞ্জস্য রক্ষা করা সম্ভব হইয়াছে বলিয়াই হয়তো প্রাণহানি বেশি হয় নাই। প্রচুর মানুষকে যথাসময়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরাইয়া লওয়া সম্ভব হইয়াছে। তবে, আত্মতুষ্ট হইবার উপায় নাই। মনে রাখিতে হইবে, ঝড় চলাকালীন ভাটা চলিতেছিল। ভরা জোয়ারে ঝড় আঘাত হানিলে বিপর্যয়ের মাত্রা আরও অনেক বেশি হইতে পারিত। প্রকৃতি স্বয়ং এই যাত্রায় সরকারের মুখরক্ষা করিয়াছে। অন্য দিকে, আয়লার সময় ঝড়ের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতি হইয়াছিল নদীবাঁধগুলি ভাঙিয়া। সামুদ্রিক নোনাজলের স্রোত বিনা বাধায় চাষের জমি, ঘরবাড়ি ভাসাইয়া দিয়াছিল। সুন্দরবন আজও সেই বিপর্যয় কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। এই ঝড়ে তেমন ক্ষতি কম। ফলে বৃষ্টির জলে ভরিলেও নোনাজলে খেতের সর্বনাশ হয় নাই। সর্বোপরি, ঝড়ের সামনে অনেকাংশে প্রতিরোধ গড়িয়াছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। বিশেষজ্ঞগণ বারংবারই বলিয়াছেন, ম্যানগ্রোভ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখেও প্রাণপণ লড়াই করে। সুন্দরবন পার হইয়া সরাসরি রাজ্যের অভ্যন্তরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানিতে পারে না। সুতরাং, ক্ষতি যে মাত্রায় হইতে পারিত, সেই মাত্রায় হয় নাই। কিছুটা সরকারি তৎপরতায় এবং অনেকটাই প্রকৃতির বদান্যতায়।
কিন্তু বার বার প্রকৃতি প্রসন্ন হইবে না। জলবায়ু যে হারে পরিবর্তিত হইতেছে, তাহাতে আগামী দিনে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং প্রকোপ দুই-ই বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া জলবায়ু বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হইতেছে সমুদ্রজলের। ঘন ঘন তৈরি হইতেছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়। চলতি মাসেই প্রায় একই সঙ্গে আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে তৈরি হইয়াছিল দুইটি ঘূর্ণিঝড়। বিরল ঘটনা বইকি। শুধুমাত্র ঘূর্ণিঝড়ই নহে, সার্বিক ভাবে বৃদ্ধি পাইবে প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তাও। সুতরাং, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চাই। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস মিলিলেই আরও তৎপরতার সঙ্গে উদ্ধারকার্য শুরু করিতে হইবে, স্থায়ী ত্রাণশিবিরের সংখ্যাবৃদ্ধি করিতে হইবে, নজরদারি চালাইতে হইবে নদীবাঁধগুলির উপরেও। সর্বোপরি, যে কোনও অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মানসিক প্রস্তুতি লইয়া থাকিতে হইবে সরকারকে। প্রয়োজনে পৃথক বিভাগ গড়িয়া অর্থ বরাদ্দ করিতে হইবে। আয়লা এবং বুলবুল প্রমাণ করিয়াছে, ঝড় লইয়া নিশ্চিন্ত হইবার অবকাশ আর নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy