দূষণের ভয়াবহতা লইয়া জনগণের এই বিপুল নির্লিপ্তি হয়তো কখনও দূর হইবার নহে।
পূজা শেষ। জলদূষণের শুরু। পূজা-অন্তে দেবীপ্রতিমাকে জলে ফেলাই হিন্দু ধর্মের নিয়ম। সুতরাং, প্রতি বৎসর এই সময় গঙ্গা-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নদীতে দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মূর্তির রঙের ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়া যায় জলে। মৃত্যু হয় মাছ-সহ জলজ প্রাণীর। দক্ষিণবঙ্গ তো বটেই, সমীক্ষায় প্রকাশ, উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি নদীগুলিতেও প্রতি বৎসর বিসর্জন-পরবর্তী পর্যায়ে দূষণ অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পায়। জল দূষিত হইলে তাহা জলজ প্রাণীর পাশাপাশি মানুষকেও সমান আঘাত করে। মনে রাখা প্রয়োজন, জলদূষণ শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের নহে, সমগ্র বিশ্বের সমস্যা। পরিস্রুত পানীয় জলের অভাব সর্বত্রই পরিলক্ষিত হইতেছে। এতদ্সত্ত্বেও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে উৎসবের মরশুমে যে নির্বিচার জলদূষণ চলিতে থাকে, তাহাতে আতঙ্ক হয়— দূষণের ভয়াবহতা লইয়া জনগণের এই বিপুল নির্লিপ্তি হয়তো কখনও দূর হইবার নহে।
আশার কথা, সাধারণ মানুষ নির্লিপ্ত হইলেও আদালত চুপ থাকে নাই। কলিকাতা হাইকোর্ট দীর্ঘ দিন পূর্বেই প্রতিমা বিসর্জনের নির্দিষ্ট নিয়ম স্থির করিয়াছে। গঙ্গাদূষণ রোধে কড়া রায় দিয়াছে জাতীয় পরিবেশ আদালতও। আদালতের চাপে বিভিন্ন পুরসভার পক্ষ হইতেও জলদূষণ রোধে নানা ব্যবস্থা লওয়া হইতেছে। পথপ্রদর্শক চন্দননগর, কল্যাণী, নৈহাটি। চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী প্রতিমা জলে পড়িবার পরই তাহা ক্রেনে তুলিয়া লওয়া হয়। ফলে, কাঠামোর মাটি, রং জলে মিশিবার সময় পায় না। কল্যাণীতে বিসর্জনের জন্য নির্দিষ্ট জলাশয় আছে। বিসর্জন সাঙ্গ হইবার পরই জলাশয়টিকে দ্রুত পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা হয়। তবে সেরা পদ্ধতিটি সম্ভবত নৈহাটির কালীপূজা বিসর্জনের। সেখানে মূর্তিকে গঙ্গার পাড়ে আনিয়া গঙ্গাজল ছোঁয়াইয়া এবং যাবতীয় ধর্মীয় বিধি মানিয়া মূর্তির আনুষ্ঠানিক বিসর্জন হয়। অতঃপর গঙ্গার জলই হোসপাইপের মাধ্যমে ব্যবহার করিয়া মূর্তিকে গলাইয়া ফেলা হয়। কলিকাতাতেও দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের ক্ষেত্রে গত কয়েক বৎসর ধরিয়া কিছু সচেতনতা পরিলক্ষিত হইতেছে পুরসভা এবং পুলিশের পক্ষ হইতে। বিশেষত, গত বৎসর গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে বিসর্জনের পর মূর্তি দ্রুত জল থেকে তুলিয়া অন্যত্র লইয়া যাইবার সুব্যবস্থা ছিল, ব্যবস্থা ছিল প্রতিমার সাজ, ফুল, মালা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলিবারও। সর্বোপরি ছিল নজরদারির তৎপরতাও।
কিন্তু— কিছু জায়গায় বিসর্জনের চিত্র দেখিয়া প্রবল আশান্বিত হইবার উপায় নাই। আদালয়ের নিয়ম সর্বত্র সমান ভাবে মানা হয় না, আদালত অবমাননার ভয় সত্ত্বেও। বিশেষত, গ্রামের দিকে নজরদারির অভাবে নিয়মের তোয়াক্কা না করিয়া ইচ্ছামতো বিসর্জনের রীতি সমানে চলিতেছে। দুর্গাপূজা, কালীপূজার ন্যায় বড় পূজা ছাড়া ছোটখাটো পূজার ক্ষেত্রে কার্যত কোনও নিয়ম খাটে না। গঙ্গার ঘাট পরিষ্কারে যে পরিমাণ কর্মী নিয়োগ করা হয়, প্রত্যন্ত এলাকার পুকুর, ছোট নদীর ক্ষেত্রে তাহা অসম্ভব। ফলে বিসর্জনের বহু পরেও নদীতে খড়ের কাঠামো ভাসিয়া যায়, পাড়ে স্তূপীকৃত হইয়া পড়িয়া থাকে খাবারের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল, থার্মোকলের বাসন। খাস কলিকাতার বুকেও তো ছটপূজায় জলদূষণ কমানো যায় নাই, আদালতের স্পষ্ট নির্দেশিকা সত্ত্বেও। প্রতি বৎসর নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া শহরের জলাশয়গুলিতে অবাধে চলে ছটপূজার সামগ্রী ফেলা। পুলিশ সেখানে নীরব দর্শক। প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দিতেছে সরকার স্বয়ং। সমস্যা হইল, দূষণ ধর্মীয় ভাবাবেগ বুঝে না। ফলে, সরকার যদি ধর্মে আঘাতের লাগিবার ভয়ে নীরব থাকে, তবে তো নাগরিকের সর্বনাশ। রাজ্যে বিভিন্ন পূজার সংখ্যা সাম্প্রতিক কালে যে ভাবে বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহাতে কিছু বৎসরের মধ্যে জলদূষণ এক অকল্পনীয় মাত্রায় পৌঁছাইবে। দূষণজনিত ক্ষতির মাত্রাটি যত ক্ষণ না জনগণ এবং সরকার স্বয়ং সম্যক ভাবে উপলব্ধি করিতেছে, দূষণাসুর বধ হইবার নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy