মণ্ডপ আছে, প্রতিমা আছে, দর্শনার্থী নেই। স্টল আছে, ব্যারিকেড আছে, ভিড় নেই। রাস্তায় আলো আছে, গাড়ি আছে, যানজট নেই। আসলে পুজো আছে, উৎসব নেই। উদ্যাপন আছে, উচ্ছ্বাস নেই। ষষ্ঠী-সপ্তমী সামলে চলে অষ্টমী-নবমীতে জনতা কিছুটা গা-ঝাড়া দিলেও নেই। বিক্ষিপ্ত ভিড়ের ভাইরাল ভিডিয়ো আছে, আনন্দের জোয়ার নেই। অতিমারির পুজো এর বেশি কী-ই বা হতে পারত!
না, ভুল থেকে গেল। দীর্ঘ অবরোধ-জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা মন বেপরোয়া হতেই পারত। তার ইঙ্গিত দেখাও যাচ্ছিল এখানে-ওখানে, বাজারে-দোকানে। দ্বিতীয়ার দিন থেকেই মণ্ডপে জমতে শুরু করেছিল গিজগিজে জনতা। তার পরই আচমকা ব্রেক। আদালতের নির্দেশ বঙ্গবাসীকে ঢুকিয়ে দিল ঘরে। নইলে পুজোর কলকাতায় রাস্তা ফাঁকা বলে পুলিশকে ছুটি দিয়ে দেওয়া যাচ্ছে— এমনটা আর ঘটেছে বলে মনে হয় না। বস্তুত জুন-জুলাইয়ের দিনগুলোতেও বোঝা যাচ্ছিল না, এ বার পুজো আদৌ হবে কি না, হলে কেমন ভাবে হবে। শেষ লগ্নে এসে ঢাকে কাঠি পড়েছিল। রাজ্য প্রশাসনও রাজনীতি এবং অর্থনীতির অঙ্ক কষে দুর্গোৎসব ‘সফল’ করার ব্রত নিয়ে ফেলেছিল। ফলত খালি চোখেই দেখা যাচ্ছিল করোনাবিধি শিকেয় তুলে কলকাতা অন্তত ফিরে যাচ্ছে কলকাতাতেই। আদালত পথ আগলে না দাঁড়ালে জনস্রোত আরও কত দূর ফুলেফেঁপে উঠতে পারত, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। শেষ মুহূর্তে আদালতের নির্দেশে পুজোমণ্ডপে দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া এক অভূতপূর্ব ঘটনা নিঃসন্দেহে। দর্শকশূন্য মাঠে ক্রিকেট ম্যাচের মতোই।
তবে আদালতের হস্তক্ষেপটুকু বাদ দিয়ে সার্বিক নিষ্প্রাণতার কথা যদি ভাবতে হয়, তা হলে ২০২০ কিন্তু একা নয়। পারিপার্শ্বিকতার চাপে পুজোর আয়োজন আর আনন্দ ম্লান হয়ে যাওয়ার নজির বড় কম নেই। ভয়ালতম দৃষ্টান্ত অবশ্যই মন্বন্তরের বছর— ১৯৪৩। রাজপথে কঙ্কালের মিছিলের মধ্যে চণ্ডিকার আগমন। আহিরীটোলার পুজো উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রফুল্লকুমার সরকার বললেন, ‘‘মা আজ দুর্গারূপে আসেন নাই। করালবদনা কালীরূপে আসিয়াছেন। তাই চারিদিকে নগ্ন প্রেতমূর্তি সকল দেখিতেছি।’’ আনন্দবাজার পত্রিকায় সপ্তমীর সম্পাদকীয়তে লেখা হল, ‘‘পূজার উদ্বেল উচ্ছ্বাসময় জনস্রোতের পরিবর্তে পথে পথে ভ্রাম্যমাণ সর্বস্বহারা জনতার মধ্যে দুঃখ, দারিদ্র্য বেদনার যে অভিব্যক্তি প্রকট হইয়া উঠিয়াছে এমন পূর্বে কখনও দেখি নাই, আর কখনও দেখিতে হইবে কি না জানি না।’’ পুজোমণ্ডপগুলোর প্রধান কাজই সে বার হয়ে উঠেছিল, নিরন্ন মানুষকে পুজোর দিনগুলোতে অন্ন জোগানো। পুজোর খবরে লেখা থাকল, ‘‘অধিকাংশ পূজামণ্ডপে উদ্যোগীরা আমোদপ্রমোদের পরিবর্তে দরিদ্রনারায়ণের সেবার ব্যাপকতর ব্যবস্থা করিয়াছেন— মানুষের দুর্বুদ্ধি, অক্ষমতা অথবা অবিমৃষ্যকারিতার ফলে যাহারা নিরন্ন হইয়াছে, তাহাদের মুখে পূজার কয়দিন আহার্য্য তুলিয়া দেওয়ার এই ব্যবস্থাই এইবারের এই স্মরণীয় পূজার মুখ্য বৈশিষ্ট্য।’’
এ বছর যেমন পুজোর গতিপ্রকৃতি নিয়ে অনেক দিন অবধি একটা অনিশ্চয়তা ছিল, এর ঠিক উল্টোটা ঘটেছিল ১৯৬৫-তে। সে বছর পুজো পড়েছে সেপ্টেম্বরের শেষে। জোগাড়-যন্তর সবই চলছে। অগস্ট মাসে বেধে গেল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। কলকাতায় ব্ল্যাক-আউট। ১৮ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন বারোয়ারি পুজো কমিটিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার পর ঘোষণা করা হল, এ বছর কোনও খোলা জায়গায়, রাস্তায়, ফুটপাতে, পার্কে পুজো করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। এমনিতেও ব্ল্যাক আউট চলছে। ফলে মণ্ডপে জ্বালানো যাবে না আলোও। প্রতিমাশিল্পীদের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দেওয়া হোক। তা ছাড়া যুদ্ধের মধ্যে উৎসবে মেতে ওঠা কোনও কাজের কথা নয়, এতে তরুণ প্রজন্মের মন বিক্ষিপ্ত হবে। মোদ্দা কথা, বারোয়ারি পুজো এ বারের মতো কার্যত বন্ধ। কিন্তু পরিস্থিতিটা পাল্টাল ক’দিনের মধ্যেই। ২৩ সেপ্টেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হল। কলকাতায় ব্ল্যাক আউট উঠল, সেই সঙ্গে ছাড়পত্র পেল বারোয়ারি পুজোও। ৩০ সপ্তমী। এক সপ্তাহের মধ্যেই সেজে উঠল শহর। জাঁকজমক কমের উপরে রেখে পুজো কমিটিগুলো বেশ কিছু টাকা পাঠিয়ে দিল প্রতিরক্ষা তহবিলে। কিন্তু পুজোর উৎসাহ আর উদ্দীপনায় কমতি রইল না।
১৯৭৮-এর বন্যার স্মৃতি এখনও অনেকেরই মনে আছে। বহু জেলা সে বার পুজোর সময়ে জলমগ্ন। কলকাতায় জল নেমে যাওয়াতে বড় পুজো প্রায় সব ক’টাই হয়েছিল। কিন্তু আয়োজনের জৌলুস আর মানুষের উচ্ছ্বাস, দুই-ই ছিল ম্রিয়মাণ। অষ্টমীর সকালের সংবাদ বিবরণ জানাচ্ছে, এ বার ঢাকের আওয়াজ কম। কারণ প্লাবিত জেলা থেকে ঢাকিরা অনেকেই আসতে পারেননি। সপ্তমীর সন্ধ্যাতেও শহরের রাস্তায় কোনও যানজট নেই। কারণ আশপাশের জেলা ও শহরতলি থেকে কলকাতায় পুজো দেখতে আসার ভিড় নেই। ‘‘কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের পাড়াটি প্রায় অন্ধকার। এখনও বহু ঘরে দুর্গাপ্রতিমা রয়ে গিয়েছে।’’
বন্যার প্রসঙ্গ উঠলেই ’৭৮-এর কথা যে আলোচনায় ঘুরেফিরে আসে, তার একটা বড় কারণ, কলকাতা নিজে সে বার ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু পুজোর মরসুমে বন্যার প্রকোপ বাংলার জেলাগুলিতে থাবা বসিয়েছে বার বারই। ১৯৪২-এর পুজোয় প্রলয়ঙ্কর বন্যার কবলে পড়েছিল মেদিনীপুর। ১৯৫৯-এ একে চরম খাদ্য সঙ্কট, তার উপরে বহু জেলা ভাসল বন্যায়। মুর্শিদাবাদ, নদিয়ার অবস্থা ছিল ভয়াবহ। হাওড়ার বাগনানে একটি গ্রামে শত কষ্টেও পুজোর আয়োজন হয়েছিল। পঞ্চমীর রাতে হুহু করে জল ঢুকে প্রতিমা-সহ গোটা গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের পঞ্চমীর খবর আবার শুরুই হচ্ছে এই বলে— ‘‘বাংলাদেশের ৭০ লক্ষ শরণার্থী, দশটি জেলা জুড়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা— এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে পুজো এসে গেল।’’ আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় পাশাপাশি সাজিয়ে দেওয়া হল তিনটি ছবি— একটি শরণার্থী শিবিরের, একটি বন্যাদুর্গত পরিবারের, একটি আলোকোজ্জ্বল রাজপথের। সঙ্গে অভিন্ন ক্যাপশন: ‘পুজো এসেছে’। মনে রাখা যাক, তার আগের মাসেই ঘটে গিয়েছে কাশীপুর-বরাহনগরের হত্যাকাণ্ড। উত্তর কলকাতার বারোয়ারি পুজোর সংখ্যায় কিন্তু কোনও হেরফের হয়নি। তবে দক্ষিণে ২৭টি পুজো কম সে বার।
শূন্য জঠরে ধুঁকতে ধুঁকতে ক’টা টাকার আশায় পুজোর কলকাতায় ছুটে আসা? সেই ঢল দেখেছিল ১৯৭৪-এর ক্ষুধার্ত শরৎ। হাংরি অটম। গৌতম ঘোষের তথ্যচিত্রে ধরা আছে সেই অন্নহীনতার দিনলিপি। সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ‘‘কলকাতাকে ঘিরে নিরন্ন জেলা চব্বিশ পরগণার তাবৎ মহকুমা থেকে কিছু না হোক অন্তত হাজার চারেক ঢাকি উপস্থিত এখন এই শহরে। অর্ধেকেরই বায়না হয়নি।’’ জামাকাপড়ের সরকারি বিপণি পাঁচ শতাংশ রিবেট বাড়িয়ে দশ শতাংশ করেও বাজার জমাতে পারেনি। ‘‘পূজার থালা— ভিক্ষার থালা— এ বার পাশাপাশি সাজানো।’’ চতুর্থীতে শহর জুড়ে ভুখা মিছিল।
২০২০-তে খাদ্যের আকাল নেই। কিন্তু ক্ষুধা আছে। জামলো মকদমের মৃতদেহ আছে। বেকারত্বের রেকর্ড আছে। তদুপরি আছে ফ্যাসিবাদের জোয়াল, উত্তর-সত্যের হরেক বেসাতি। একের পর এক নব্য ‘নর্মাল’-এর সঙ্গে যুঝতে যুঝতেই মনকে প্রবোধ দেওয়া— আসছে বছর আবার হবে! হবে তো ঠিক?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy