পিতলের দশভূজা এবং প্রাচীন পাথরের মূর্তি। ছবি: লেখক
বক্রেশ্বর শুধু শৈব তীর্থক্ষেত্র নয়, সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ বলেও পরিচিত।
প্রচলিত মতে, সতীর দুই ভ্রু-র মধ্যস্থল বা মন পড়েছিল বক্রেশ্বরে। পুরাণকথায়, বীরভূম যে সব কাহিনিতে জায়গা করে নিয়েছে, তার মধ্যে দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করার পর মহাদেবের তাণ্ডবনৃত্য একটি। পুরাণে মেলে, সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে মহাদেব ত্রিভুবন জুড়ে উন্মত্তের মতো নৃত্য করেছিলেন। এ ভাবে চললে প্রলয় উপস্থিত জেনে বিষ্ণু তাঁর সুদর্শনচক্র দিয়ে সতীর দেহ ছেদ করতে শুরু করেন। সতীর দেহ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা অংশে। যে যে স্থানে সতীর দেহাংশ পড়ে, সেই জায়গাগুলি মহাপীঠ ও তীর্থক্ষেত্র বলে চিহ্নিত হয়। বক্রেশ্বর তেমনই একটি সতীপীঠ এবং জেলার পাঁচটি সতীপীঠের অন্যতম।
পর্যটকরা বক্রেশ্বরে ছুটে আসেন শুধু শৈবপীঠের জন্য নয়, সতীপীঠের টানেও। ওড়িশার রেখ-দেউলরীতির স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি বক্রেশ্বরে দুধসাদা সুউচ্চ শিব মন্দিরের ঠিক দক্ষিণ দিকে দেবী মহিষমর্দিনী মন্দির। মন্দিরের বেদিতে অধিষ্ঠিত পিতলের তৈরি দশভূজার দুর্গা মূর্তি। প্রচলিত বিশ্বাস এবং শতাব্দী প্রাচীন ধারণা প্রতিষ্ঠিত পিতলের দশভূজা মূর্তির নীচেই একটি গর্তের মধ্যে রয়েছে সতীর দেহাংশ-মন। সেবায়েতবর্গ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, আগেও একাধিক পিতলের তৈরি দেবীমূর্তি ওই আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেই মূর্তিগুলির ক্ষয় হওয়ার পরই সেখানে নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিতদের ধারণা, দেবীপীঠের ওই আসনে অন্য মূর্তি ছিল। একই মত তাঁর ‘বীরভূম বিবরণ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ইতিহাস গবেষক হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। প্রায় ১০০ বছর আগে মহিষমর্দিনী মন্দির থেকে কয়েকশো মিটার দূরে আচার্যদের দুর্গামন্দির সংলগ্ন একটি পুকুর ‘ধরমগড়ে’ থেকে মিলেছে একটি পাথরের আঠারো বছরের দুর্গা মূর্তি। আচার্য পরিবারের সদস্যরা বক্রেশ্বরের সেবায়েতও বটে।
সম্ভবত, পাষাণ দুর্গামূর্তিটিই বক্রেশ্বর শিবমন্দির সংলগ্ন সতীপীঠের আসল মূর্তি। হরেকৃষ্ণবাবু তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন, বাংলা ১৩২২ সালে মূর্তিটি উদ্ধার হয়েছে। দীর্ঘদিন মাটির নীচে থাকায় মূর্তিটি কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত ঠিকই তবে সেটা অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এক মৈথুনরত নারী পুরুষের উপরে দেবীর কমলেকামিনী মূর্তি। নীচে ও উপরে চালচিত্রাকারে কৌমরী, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, বারাহী-সহ নয়টি শক্তিমূর্তি রয়েছে।
আচার্য পরিবারের সদস্য অমর আচার্য ও কল্যাণ আচার্যরাও একই কথা বলছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত ও সিঁদুরের প্রলেপ পড়ে থাকায় সেটা চোখে না পড়লেও, একটু ভালকরে নজর করলেই মূর্তিটির অবয়ব বোঝা যায়। আঠারো হাতের এই দুর্গামূর্তিকে আমরা মহালক্ষ্মী বলেই মানি। শতাব্দী প্রচীন পারিবারিক দুর্গার বেদিতে প্রতিষ্ঠিত। আচার্য পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, প্রায় সাত দশক আগে যখন বক্রেশ্বরে টোল চলত তখন কলকাতা থেকে এক সপ্ততীর্থ সংস্কৃত পণ্ডিত এসে এই মূর্তি দেখে এ কথাই বলেছিলেন। শক্তিপীঠের আসল মূর্তি সম্ভবত এটিই।’’ তাঁদের সংযোজন, ‘‘শুধু ওই সংস্কৃত পণ্ডিতই নন, ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের রাজপরিবারের এক সদস্য এসে আমাদের মন্দিরে টানা দু’দিন হোমযজ্ঞ করে গিয়েছিলেন বলে পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি।’’
তবে আচার্য পরিবারে বহুকাল থেকেই দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। ওই পরিবারের দুর্গামন্দিরে দোলা আসা বা অষ্টমীর সন্ধি পুজোর বলিদানের পরই বক্রেশ্বর মহিষমর্দিনী দোলা আসা বা বলিদান হয়ে থাকে। বক্রেশ্বরের অন্য সেবায়েতরা বিষয়টি মেনে নিয়েছেন তবে আচার্য পরিবারে থাকা পাষাণ মূর্তিটির সঙ্গে মহিষমর্দিনী মূর্তি বা সতীপীঠের কোনও যোগ রয়েছে এমনটা অনেকেই মানেন না। যদিও তার সঠিক ব্যাখ্যাও তাঁদের কাছে নেই।
বক্রেশ্বরে শ্বেতগঙ্গার পাশে থাকা একটি প্রাচীন বটগাছের তলায় একটি সুপ্রাচীন হরগৌরী মূর্তি ভগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। গৌরীহর মিত্র ও হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ভগ্ন হরগৌরী মূর্তিটিকে প্রায় হাজার বছরের পুরনো বলে অনুমান করেছেন। কিন্তু দুটি মূর্তি দু’জায়গায় কীভাবে পাওয়া গেল সেটা নিয়েও তাঁর গবেষণায় সংশয় প্রকাশ করেছেন হরেকৃষ্ণবাবু। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহিষমর্দিনী মন্দির ওই জায়গায় থাকলেও, কালাপাহাড়ের আক্রমণের জন্য মহিষমর্দিনী মূর্তিটিকে পুকুরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষকদের মতে, দ্বাদশ শতাব্দীর ওড়িশার রাজাদের শাসনকালেই কখনও বক্রেশ্বরে মন্দির (শিব বা দুর্গা, কিংবা দুটোই) প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পরে সেই মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। হতে পারে সেই সময় মুর্তি স্থানচ্যুত হয়েছিল। কিন্তু সেটার সঠিক তথ্য নিয়ে সংশয় রয়েই গিয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন এই ইতিহাসের আকরভূমি নিয়ে সংবেদনশীল ছিলেন ১৬০০ সালের পরে বীরভূমের রাজধানী রাজনগরের মুসলিম রাজারা। বক্রেশ্বরে জমি শুল্ক নিতেন না তাঁরা।
সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক তথা বীরভূমের ইতিহাস গবেষক, প্রয়াত অর্ণব মজুমদারে ছেলে পার্থশঙ্খবাবু বলেন, ‘‘কত বছরের প্রাচীন ওই মূর্তিগুলি তার প্রামাণ্য নথি নেই। তবে পূর্ব ভারতের এই অংশে আর্য সংস্কৃতি বিস্তারের সময় ওই অংশের অনার্য ধর্ম কেন্দ্রগুলিকে আর্যকরণ করা হয়। এরই অঙ্গ হিসবে শৈব কেন্দ্রগুলির সঙ্গে একজন করে একেক দেবীকে সংযুক্ত করা হয়েছিল। বক্রেশ্বরের ক্ষেত্রে মহিষমর্দিনী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy