প্রতীকী ছবি
পাড়ার চায়ের দোকানে রাজা-উজির মারা এক কথা, দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসাবে এক প্রধান বণিকসভার বৈঠকে বক্তৃতা করা আর এক। স্বাভাবিক প্রত্যাশা, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কথা বলিবার সময় বক্তা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া লইবেন। পীযূষ গয়ালের কথাটি যদি সেই বিবেচনাপ্রসূত হয়, তবে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ লইয়া গভীর দুশ্চিন্তার কারণ আছে। তিনি বলিয়াছেন, কিছু কিছু দেশের (অর্থাৎ, চিনের) বিভিন্ন সংস্থা অপেক্ষাকৃত সস্তায় পণ্য জোগান দেয় বটে, কিন্তু দেশের নাগরিকের কর্তব্য তুলনায় বেশি খরচ করিয়াও স্বদেশি পণ্য কেনা— নচেৎ, বিদেশি সংস্থাই বাজার দখল করিয়া লইবে। শ্রীগয়াল যে সমস্যাটির কথা উত্থাপন করিয়াছেন, তাহা বাস্তব। চিনের বিরুদ্ধে গোটা দুনিয়াতেই ডাম্পিং-এর অভিযোগ উঠিয়াছে— অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে চিনা সংস্থা উৎপাদন মূল্যের কম দামে পণ্য বেচিয়া বাজারের দখল রাখিতে চাহে। দেশীয় পণ্যের তুলনায় বিদেশি পণ্য সস্তা হইলে শেষ অবধি দেশের বাজারে দেশীয় সংস্থা না থাকিবার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। এবং, সেই প্রতিযোগিতাহীন বাজারে বিদেশি সংস্থা যথেচ্ছ মূল্য আদায় করিতে পারে, ইহাও সত্য। প্রশ্ন মন্ত্রিমহোদয়ের সমাধানপদ্ধতি লইয়া। তাঁহারা যদি সত্যই আশা করেন যে দেশপ্রেমের বটিকা সেবন করিয়া নাগরিক অধিক মূল্যে দেশীয় পণ্য কিনিয়া জাতীয়তাবাদী দায়িত্ব পালন করিবে, এবং নাগরিকের সেই ‘সদিচ্ছা’ই ডাম্পিং-এর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানতম অস্ত্র হয়, তবে ঘোর বিপদ। কারণ, বাণিজ্যবিদ্যার ছাত্র মন্ত্রিমহোদয় যদি বা না-ও জানেন, অর্থশাস্ত্রে প্রণোদনার গুরুত্ব অপরিসীম। এবং, কম দামে পণ্য কিনিবার ন্যায় প্রণোদনা আর নাই।
কোনও দেশ, বা কোনও সংস্থা ডাম্পিং করিতেছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারির দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দর্শন উদার বাণিজ্যের পক্ষপাতী, ডাম্পিং-এর নহে। ফলে, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা ইদানীং যে দেশটির নাম উচ্চারণ করিতেছেন না, সেই দেশ যদি এই অন্যায় বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করে, তবে আইনানুগ ব্যবস্থা লওয়া সম্ভব। আর, যদি উৎপাদনশীলতার কারণেই বিদেশি পণ্য তুলনায় সস্তা হয়, তবে দেশের উৎপাদনশীলতা, কুশলতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করা বিধেয়। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘আত্মনির্ভরশীলতা’ ইত্যাদি গালভরা শব্দ বক্তৃতায় সুন্দর— কার্যক্ষেত্রে দেখিতে হইবে, কেন ভারত বহু পণ্য উৎপাদনই করিতে পারে না, কেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতে উৎপাদন ব্যয় বেশি। পরিকাঠামোর উন্নয়ন, বিনিয়োগের পথ সুগম করা, সরকারি দীর্ঘসূত্রতা কমাইয়া আনা ইত্যাদির কথা ভাবা জরুরি। অর্থনীতি বস্তুটি যে রাজনীতি নহে, শুধুমাত্র স্লোগান, বিজ্ঞাপন বা দেশাত্মবোধক হুঙ্কারে যে তাহার চাকা গড়ায় না, এই কথাটি কর্তারা যত দ্রুত স্বীকার করেন, তত মঙ্গল।
কেহ সন্দেহ করিতেই পারেন, পীযূষ গয়ালের এই স্বদেশি-প্রেমের ভিন্নতর উদ্দেশ্য আছে— তিনি নাগপুরের উদ্দেশে সঙ্কেত পাঠাইলেন। স্বদেশি পণ্যের পক্ষে শ্রীগয়াল যে কথাগুলি বলিলেন, তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ, বা বৃহত্তর অর্থে সঙ্ঘ পরিবারের অবস্থান। বিদেশি পণ্যের বিরুদ্ধে এই জেহাদটির সহিত উদার অর্থনীতির দর্শনের বিরোধ প্রত্যক্ষ। এক দিকে উদার অর্থনীতির আহ্বান, অন্য দিকে সঙ্ঘের অর্থনৈতিক অবস্থান— যত দিন যাইতেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য নীতিতে এই টানাপড়েন স্পষ্টতর হইয়া উঠিতেছে। তাহা ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকারক। তাঁহারা ঠিক কোথায় দাঁড়াইয়া আছেন, গত ছয় বৎসরে কখনও তাহা পরিষ্কার ভাবে জানা যায় নাই। এই ধোঁয়াশাকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মোড়কে পরিবেশন করিতে চাহিলে আরও একটি ভুল হইবে। পীযূষ গয়ালের কথায় আশঙ্কা হয়, সরকার সেই ভুল করিতে প্রস্তুত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy