জমিতেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে খড়। নিজস্ব চিত্র
অবিভক্ত মেদিনীপুরে ধান কাটার কাজে হারভেস্টার যন্ত্র বা কম্বাইন মেশিনের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে আকাল দেখা দিয়েছে খড়ের। এভাবে চলতে থাকলে খড়ের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশ কিছু ক্ষেত্র। যার কয়েকটির সঙ্গে আবার জীবিকাও জড়িয়ে রয়েছে। যন্ত্রের ব্যবহারে পরিবেশের ক্ষতির দিকও রয়েছে।
গ্রামীণ জীবনে খড়ের চাহিদা দীর্ঘদিনের। তবে এটাও ঠিক, বিশ বছর আগে খড়ের ব্যবহার যত ছিল, এখন কিন্তু তার ব্যবহার অনেকটাই কমেছে। তা সত্ত্বেও খড়ের প্রয়োজন কিন্তু এখনও যথেষ্ট।
গরু-ঘোড়ার খাদ্য হিসাবে খড় একটি অন্যতম উপাদান। এ ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে খড়ের আরও কিছু ব্যবহার রয়েছে। কেউ ঘরের ছাউনি করেন। খড় ভরা গদি, তোশকের কদরও এখনও রয়েছে। জৈব জ্বালানি হিসাবে খড়ের ব্যবহার বাড়ছে। খড়ের আবরণ কোনও বস্তুকে আঘাত থেকে রক্ষা করে। তাই প্যাকিংয়ের কাজে খড়ের ব্যাপক চাহিদা। এ ছাড়াও দড়ি, টুপি তৈরি এবং মাশরুম চাষেও খড় ব্যবহার হয়। পুকুরের জলে শ্যাওলা পরিষ্কার বা কোথাও কোথাও মাছ ধরার জাল টানার কাজেও ব্যবহার হয় খড়। আস্তাবলে খড় ব্যবহার হয়। প্রতিমা তৈরির সময়ে প্রচুর খড়ের ব্যবহার হয়। শহরাঞ্চলে খড়ের চাহিদা ততটা না থাকলেও গ্রামাঞ্চলে নানান প্রয়োজনেই খড় প্রয়োজন হয়। কিন্তু এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের উৎপন্ন লাফিয়ে লাফিয়ে কমায় সমস্যা বাড়ছে।
বছরের দু’বার ধান হয়। ধানের উৎপাদন কমছে না। তা হলে খড় কমছে কেন? এই উত্তর বহুমুখী। শুধু একটি ক্ষেত্র থেকে এর উত্তর মিলবে না। যেমন প্রশাসনিক একটি দিক রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই একশো দিনের কাজের প্রকল্প-সহ নানা কারণেই মজুরির আকাল দেখা দিয়েছে। জমি থেকে ধান কাটা, তারপর আঁটি বেঁধে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সময় সাপেক্ষ এবং ঝক্কির কাজ। একে মজুরের আকাল। সেই সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপারও জড়িত। জমি থেকে ধান তুলে খামারে রাখা সমস্যা। খামার বলে পরিচিত জায়গাগুলো এখন অন্য কাজে ব্যবহৃত হয় বেশির ভাগ সময়ে। এরপর রয়েছে ধান ঝাড়া। পুরো প্রক্রিয়াটাই মজুরের নির্ভরশীল। প্রায় নব্বই শতাংশ চাষিই মজুরের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সরকারি নানা প্রকল্পের জেরে এখন ধান কাটার মজুরের যে বড় অভাব! সে কারণেই মজুরের থেকে হারভেস্টার মেশিন জেলার বেশির ভাগ মাঠ দখল করে নিতে শুরু করেছে।
আগে শুধু ধান-আলুই চাষ হত। ফলে মজুরের সমস্যা সেভাবে ছিল না। এখন একশো দিনের কাজ। সেই সঙ্গে নতুন রাস্তা তৈরি বা গ্রাম-শহরের বিভিন্ন কাজে ঠিকাকর্মীর কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছেন একসময় মাঠে কাজ করা শ্রমিকেরা। বছরভর কাজ এবং নগদ টাকা পেয়ে যাওয়ায় আর কেউ মাঠমুখো হচ্ছেন না তাঁরা। তাই দিন দিন ধান কাটা ও ঝাড়াই মেশিন তথা কম্বাইন্ড যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। ততই আকাল দেখা দিচ্ছে খড়ের।
বছর তিন-চারেক আগেও ঘাটাল-সহ গোটা জেলা জুড়েই মাঠে কম্বাইন্ড হারভেস্টার বা ধান কাটার মেশিন পৌঁছয়নি। ফলে তখনও এত খড়ের আকাল তৈরি হয়নি। তখন চাষির খড় নষ্টও হত না। খড় বিক্রি করেও কিছু টাকা পেতেন চাষিরা। গাদা দিয়ে রাখা কিছু খড় পচে যেত ঠিকই। কিন্তু সেই পচা খড়ও আবার জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহার হত। কারণ, পচা খড় জমির উর্ভরতার ক্ষেত্রে ভাল। খড়ের আকালের সঙ্গে চাষ যোগ্য জমি খড়ের উপকারিতা থেকেই বাদ পড়ছে। এখন তার উপরে বাড়ছে মাটির সঙ্গে লড়াই।
হারভেস্টার যন্ত্রের ব্যবহারে খড় পাওয়া যায় না। আবার এই যন্ত্রের ব্যবহারে পরিবেশ দূষণও বাড়ছে। যন্ত্র ধান গাছকে টুকরো টুকরো করে দেয়। ফলে খড় বলে কোনও ব্যাপারই থাকে না। আর জমিতে পড়ে থাকা টুকরোগুলো অন্য কোনও কাজেও আসে না। তাই জমিতেই সেগুলো ফেলে রেখে দেন জমির মালিকেরা। কারণ ওই খড় তুলে নিয়ে যেতেও মজুর লাগে। তাতে অতিরিক্ত খরচ হয়। তাই জমি ফাঁকা করতে ইদানীং সেই সব পোড়ানোর প্রবণতা শুরু হয়েছে।
বিঘার পর বিঘা জমিতে দাউ দাউ করে খড় জ্বলছে। ধান কাটার পরই অবিভক্ত মেদিনীপুরের অধিকাংশ মাঠে এমন দৃশ্য চোখে পড়বে। এর ফলে বায়ুদূষণ বাড়ছে। জমির উপকারী জীবাণু মারা যাচ্ছে। তার জেরে জমির মালিককে রাসায়নিক সারের উপর ভরসা বাড়াতে হচ্ছে। জমিতে ফেলে রাখা খড় পোড়ানো যে ক্ষতিকর তা মানছেন বিশেষজ্ঞরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের কৃষি দফতরের সহ-কৃষি অধিকর্তা দুলাল দাস অধিকারীর বক্তব্য, ‘‘জমিতে খড় পোড়ালে জৈব পদার্থগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মাটির উপরিভাগে কিছু উপকারী জীবাণু থাকে সেগুলো নষ্ট হয়। ফলে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ে। বায়ুদূষণ তো হয়ই।’’ তিনি জানিয়েছেন, খড়গুলো জমিতে পচিয়ে ফেললে উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে। জাতীয় গ্রামীণ জীবন জীবিকা মিশনের জাতীয় পরামর্শদাতা কৃষিবিজ্ঞানী কাঞ্চন ভৌমিক বললেন, ‘‘যন্ত্রে ধান কাটার পরে খড় পোড়ানো হলে কার্বন ডাই এবং মনোঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে। এ ছাড়া শস্য বিশেষে সালফারঘটিত যৌগ নির্গত হয়ে পরিবেশ দূষণ ঘটায়। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’’
চাষি পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম মানছেন, ধান কাটার যন্ত্রের ব্যবহার আটকানো যাবে না। এতে আখেরে চাষিদের লাভ। তবে তারই সঙ্গে খড়ের আকাল যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দিতে অনুরোধ করছেন তাঁরা। এর জন্য অন্তত কিছু জমির ধান মজুর দিয়ে কাটানোর পুরানো অভ্যাস ফিরে আসুক, চাইছেন চাষিদের
নতুন প্রজন্ম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy