সম্পর্কগুলো আগলে রাখা বড় জরুরি।’ কথাটা প্রায়ই শোনা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা সম্পর্কগুলো আগলে রাখি নাকি সম্পর্কগুলোই আমাদের আগলে রাখে?
বিশ-পঁচিশ বছর আগেও এ নিয়ে বিশেষ ভাবতে হত না। সম্পর্কের সাবলীলতায় আমরা আটকে পড়তাম। সম্পর্ক গড়তে হত না, সম্পর্কই গড়ে নিত আমাদের। পাড়া-কালচারে যারা বড় হয়েছি, তারা জানি কী ভাবে পড়শির উঠোন আশ্বস্ত করত আমাদের শৈশবকে। শুধু উঠোন কেন, উঠোনের চারপাশে ফুল, ফলের গাছগুলো পর্যন্ত আমাদের বন্ধু হয়ে যেত। তামাম পাড়ার সকলেই ছিলেন আত্মীয়।
ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির সৌজন্যে এখন পাড়াগুলো ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। একা হতে হতে আমরাও ঢুকে যাচ্ছি সেই ফ্ল্যাটের চৌকো খোপে। সেটাই আমাদের দুনিয়া। কয়েকশো বর্গফুটের জায়গা ঘিরেই স্বপ্ন, হতাশা, সুখ, দুঃখের রোজনামচা। তার পরে এক দিন কোনও ফ্ল্যাট থেকে পচা গন্ধ বেরোয়। পুলিশ আসে। দরজা ভেঙে বের করা হয় নিথর দেহ।
তখন সকলের বাড়িতে টিভি ছিল না। যাদের ছিল তারা ভিআইপি। শনি-রবি কিংবা ছুটির দিনে আমরা ভিড় করতাম সেই বাড়িতে। অ্যান্টেনায় কাক, টিভির পর্দায় ঝিলমিল। ঝিলমিল লেগে যেত আমাদের চোখেও। তার পরেই হেঁশেল থেকে ভেসে আসত জেঠিমার গলা, ‘ওরে আর কতক্ষণ টিভিতে সর্ষে লাফানো দেখবি? এক বাটি মুড়ি মেখে দিচ্ছি। খেয়ে নে।’
এখন টিভি মানেই রঙিন। স্ক্রিন এলইডি। দেওয়াল জুড়ে রাখা সেই ঢাউস টিভির সামনে বসে চিপস খেতে খেতে কার্টুন দেখে আমাদের সন্তান। একা। কাল্পনিক সব চরিত্ররাই তার বন্ধু। আপনজন। কেউ তাকে বলে না, ‘জানলার বাইরে আকাশটাকে দেখো, টিভি দেখো না।’
পাড়ার একটা বাড়ির সদর দরজায় শিউলি ফুলের জোড়া গাছ ছিল। গাছের নিচু ডাল এক হাতে উঁচু করে আমরা সেই বাড়িতে ঢুকতাম। সেই শিউলির ফুল জানান দিত, দুয়ারে শরৎ। আবার ছোটদের অসুখ-বিসুখ হয়েছে শুনলে কাকিমাই গাছ থেকে শিউলি পাতা ছিঁড়ে দিয়ে বলতেন, ‘দু’চামচ মধুর সঙ্গে শিউলির রস মিশিয়ে খাইয়ে দেবে।’ একই ভাবে পাড়ার কালমেঘ, তুলসি-র মতো ভেষজ গাছ কারও একার ছিল না। তার মালিক সকলেই। সকলেরই প্রয়োজনে তা কাজে লাগত। কাউকে চাইতে পর্যন্ত হত না। বাগানগুলো ছিল যৌথ খামার। আর গোটা পাড়াটা যৌথ পরিবার।
শরৎকালে পুজোর গন্ধ পেতে কারও কারও ফ্ল্যাটের জানলায় বেড়ে ওঠে শিউলির চারা। সীমিত মাটি, নিয়ম মাফিক জলে বেড়ে ওঠা সেই গাছ এক দিন ব্যালকনি ছোঁয়। কিন্তু শিউলি কুড়োনোর কেউ থাকে না। ব্যালকনি নামক উঠোনের শোভা বাড়ায় মানিপ্ল্যান্ট, বনসাই, অ্যালোভেরা।
পাড়ায় তখন নিয়ম করে ফেরিওয়ালা আসত। বাড়ির দরজার সামনে বসে তারা গল্প করতে করতেই জিনিসপত্র বিক্রি করত। মা-কাকিমাদের অনুরোধে কোনও কোনও দিন তারা চা-জলখাবারও খেত। দূর থেকে ‘টিন ভাঙা... লোহা ভাঙা...’ শুনলেই আমরা বলে দিতাম রহমান চাচা আসছে। ‘হাড়ি-কড়াই-গামলা...’ শুনলেই সবাই বোঝা যেত মুকুন্দ জেঠা। শীতকালের খবর তো নিয়ে আসত খাজাকাকু। খাজা বিক্রির থেকে আমাদের সঙ্গে গল্প করাতেই তার বেশি আগ্রহ ছিল।
এখন ফেরিওয়ালারা ওই দূরের রাস্তা দিয়ে চলে যায়। আবাসনের কেউ তাকে চেনে না। সে-ও চেনে না কাউকে। বহু বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সদর দরজায় লেখা থাকে—সেলসম্যানের প্রবেশ নিষেধ! এখন বাইরে বেরোনোর আগে সন্তানদের বলে দিতে হয়— ‘কেউ বেল বাজালেই দুম করে দরজা খুলে দেবে না। আই-হোলে চোখ রেখে আগে আমাদের ফোন করবে। তার পরে ফোনটা কানে ধরে রেখেই দরজা খুলবে।’ চারপাশে কত কী যে ঘটছে! শুধু ভয় করে। সকলেই যেন শত্রু। সকলেই যেন ক্ষতি করার জন্য মরিয়া। সকলের চোখেই তাই অবিশ্বাস। সকলের চোখেই সন্দেহ।
দলবেঁধে স্কুলে যাতায়াত করাটাই তখন স্বাভাবিক ছিল। শেষ বেঞ্চে বসার মধ্যেও কোনও অপরাধ ছিল না। শেষ বেঞ্চ থেকেও বহু ‘স্টার’ কিংবা ‘ব্রাইট’ পড়ুয়া উঠে এসেছে। সেই আমরাই এখন আমাদের সন্তানদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি পৃথিবীর সবথেকে দামী শব্দ— ফার্স্ট! তাকে ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে হবে। ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। খেলাধুলায় ফার্স্ট হতে হবে। সাঁতার, আবৃত্তি, নাচ-গান সবকিছুতেই ফার্স্ট হতে হবে। সেকেন্ড হবে অন্য কেউ। অতএব...।
ভাইফোঁটা, রাখি, দোল কিংবা পাড়ার পিকনিকে সবাই মিলে সে কী হুল্লোড়। এখনও সেই উচ্ছ্বাস যে একেবারে নেই তা নয়। তবে বড্ড নিয়ন্ত্রিত, সাবধানী এবং হিসেবি। নিজের ঘরেও প্রাণ খুলে হাসতে নেই। জোরে কথা বলতে নেই। কারণ, দেওয়ালের কান আছে। আর দেওয়ালের ওপারে অন্যের বাস। আধুনিক আবাসনে এখন তাই বহু কিছুই সেকেলে, পুরনো। মুহূর্তে তকমা সেঁটে দেওয়া হয়—‘গ্রাম্য’, কিংবা ‘মান্ধাতা আমলের লোক’। তাই নিজের ঘরেও আড়ষ্ট হয়ে
থাকতে হয়। আড়ষ্ঠ জীবন, আড়ষ্ঠ হয় মন।
এখনও নীল আকাশে মাঝেমধ্যে ঘুড়ি ওড়ে। তবে সেই সব সম্পর্কের ঘুড়িগুলোর সুতো ছিঁড়ে গিয়েছে। এদিক, ওদিক পাক খেতে খেতে ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে কখনও দেখা হলে মনে হয়, হারিয়ে যাওয়া সেই দখিনা হাওয়া আবার বুঝি ফিরে এল!
কিন্তু ফেরা কি এতই সহজ! সভ্যতার চাকার সঙ্গে ছুটতে ছুটতেও পিছুটান থাকে। কিন্তু পিছনে ফেরা যায় না। পিছনে ফিরতে নেই। ফলে ছুটতে হয়। জোরে। আরও জোরে। এ লড়াই অস্তিত্বের। এ লড়াই জীবনের। সেখানে থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু। বাস্তবে পিছু ফেরা তাই অলীক এবং ভয়ঙ্কর কল্পনা।
কিন্তু মনে মনে? মনে লাগাম পরানোর সাধ্যি কার! মনে মনে তাই দিব্যি চলে যাওয়া যায় ছোটবেলায়। এ ভাবেই আসা-যাওয়া চলতে থাকে। ফিরে ফিরে আসে পুরনো মুখ, পুরনো গন্ধ, পুরনো সব সম্পর্ক। ক্ষয়ে যেতে যেতেও আমরা আরও একটু সবুজ হই। আরও এক বার শ্বাস নিতে পারি প্রাণ ভরে। দুম করে টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে সন্তানকে বলতে পারি, ‘চল, ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি...।’
নিজের অজান্তে এ ভাবেই হয়তো সম্পর্কগুলো ফের খুঁজে পায় অন্য মানে। বইতে থাকে জীবনও। জীবন যে একটাই আমরা যেন ভুলে না যাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy