যমপুজো কী করে করতে হয়, কারও জানা আছে? কী তাঁর যজ্ঞের নিয়ম, নৈবেদ্য সাজানোর রীতি, অঞ্জলির মন্ত্র? তা হলে এ দেশের চোদ্দো কোটি পরিযায়ী শ্রমিকদের তরফে পুজোটা চড়ানো যাক। এতগুলো বছর যাঁরা থেকেও ‘নেই’ হয়ে ছিলেন, আজ যে তাঁদের চোখে পড়ছে, সে কার কৃপায়? সবাই গালে হাত দিয়ে বিস্ময়ের ঢঙে বলছে, “ও মা, এই এতগুলো লোক হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছে, রাস্তায় পড়ে মরে যাচ্ছে, ওদের জন্য গাড়ি কই, বাড়ি কই, খাবার কই, ছি ছি, ভারী অন্যায়,” তার কারণ তো মৃত্যুভয়। পুরসভার চোখে যারা অবৈধ দখলদার, ঠিকাদারের চোখে লেবার, শহরবাসীর কাছে দৃশ্যদূষণকারী, রাজনৈতিক দলের কাছে ফালতু অ-ভোটার, পুলিশের চোখে সম্ভাব্য অ-নাগরিক, গৃহকর্ত্রীর চোখে ফাঁকিবাজ, মহামারির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ খুলে সবাই দেখল, তারা মানুষ। এখন ঘেন্নাপিত্তি ঠেলে বলতে হচ্ছে, ওরে ওদের খাবার দে, জল দে। দেখিস, থাকার জায়গায় যেন বেশি ঠাসাঠাসি না হয়।
এ ভাবেই আর এক মারণরোগের আশীর্বাদে তিন দশক আগে বেঁচে উঠেছিল যৌনকর্মীরা। সমাজ এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের পল্লির দরজায়, এইচআইভি-এইডস থেকে বাঁচার উপায় পেতে। গবেষক, সমাজসেবী, প্রশাসনের মেজ-সেজ কর্তারা ছুটেছিলেন এই মেয়েদের সচেতন করতে। এবং অচিরে নিজেরা চেতনা লাভ করেছিলেন, কারা পাচার করে, কারা ওই মেয়েদের রোজগারে খায়, কারা তাদের সন্তানদের থানায় আটকে ঘুষ আদায় করে, স্কুলের দরজা বন্ধ করে জবালাপুত্রদের জন্য, আর কারা কন্ডোম ব্যবহার করতে বললে তেড়ে মারতে আসে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নথি থেকে স্থানীয় এনজিও-র অনুসন্ধান-ধর্মী রিপোর্টে যা লেখা হল তার মোদ্দা কথা, এই মেয়েরা, কিংবা ওই একই কাজে যুক্ত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা, সমাজদেহের টিউমার নয় যে কেটে বাদ দেওয়া যাবে, পুঁজরক্ত নয় যে টিপে ফেলে দেওয়া যাবে। তারা রক্ত-মাংস-মেদ-মজ্জার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট জীবন্ত কোষ। ওরা যে আমরাই এবং আমরাই যে ওরা, ওদের বদলাতে হলে আমাদের বদলাতে হবে, বহু মৃত্যুর মূল্যে সমাজ এই সিদ্ধান্তে এসেছিল।
মনের ভাব প্রকাশের উপায় যেহেতু ভাষা, তাই যে কোনও বদল শুরু হয় ভাষা থেকে। ১৯৮৬ সালে ভারতে প্রথম এইডস রোগী ধরা পড়ল। ১৯৯২ সালে যখন কলকাতার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সোনাগাছিতে কাজ শুরু করেন। সে দিন যারা ছিল বেশ্যা, পতিতা, নষ্ট মেয়েছেলে, তারা ক্রমে নিজেদের জন্য অন্য এক শব্দ দাবি করল। যৌনকর্মী। ১৯৯৭ সালে সর্বভারতীয় যৌনকর্মী সম্মেলন হল কলকাতায়। তাদের প্রতি সমাজের মানসিকতা বদলানোর দাবির প্রকাশ হল নতুন শব্দে। এ ভাবেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, ভিন্ন যৌনতার মানুষ, যাঁদের জন্য কিছু অপশব্দ ছাডা কিছুই বরাদ্দ করেনি ভাষা, তাঁদের জন্য তৈরি হল নতুন নতুন শব্দ। ১৯৯০ সালে ‘বোম্বে দোস্ত’ পত্রিকা বার হল সমকামী পুরুষদের জন্য, তাচ্ছিল্যবাচক ‘হোমো’ শব্দ থেকে সরে এসে ভারত শিখল ‘গে,’ ‘এলজিবিটিকিউ’ শব্দবন্ধ। ১৯৯৪ সালে মহামারি-বিশেষজ্ঞরাই প্রথম ব্যবহার করলেন, ‘মেন হু হ্যাভ সেক্স উইথ মেন।‘ বাংলাতে ক্রমে জলচল হল ‘তৃতীয় লিঙ্গ,’ ‘সমকামী,’ আরও পরে ‘রূপান্তকামী।‘
আজ আমরা ফের দেখছি, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে মানসিকতা বদলানোর তাগিদ অনুভবের গোড়াতেই বদলে যাচ্ছে ভাষা। কেরল সরকার বলছে, পরিযায়ী নয়, অতিথি শ্রমিক। ২০১৮ সালে শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ়্যাক, বাজেট বক্তৃতায়। এ বছর করোনা-সঙ্কটে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের দফতর থেকে শব্দটি ব্যবহার হচ্ছে শ্রমিকদের আশ্বস্ত করতে যে, তাঁদের সব দায়িত্ব রাজ্য সরকার নিচ্ছে। অতিথি বলা মানে মর্যাদা দেওয়া, প্রয়োজনের স্বীকৃতি দেওয়া, তা মেটানোর দায় স্বীকার করা।
অন্যরা ওদের কী বলে? ১৯৭৯-এর আইন (ইন্টারস্টেট ওয়ার্কম্যান মাইগ্রেশন অ্যাক্ট) ওদের বলেছে ‘ওয়ার্কম্যান।‘ মুনিষ। মহিলাদের স্বীকৃতি তো নেই-ই (যদিও তাঁদের অন্যত্র কাজে যাওয়ার হার পুরুষদের চাইতেও দ্রুত বাড়ছে), শ্রমিক (ওয়ার্কার, লেবার) কথাগুলোও নেই। শ্রমিকদের মধ্যেও দ্বিতীয় শ্রেণির শ্রমিক, উপেক্ষিতের মধ্যে উপেক্ষিত। দেশে লকডাউন হওয়ার সময়ে ওদের কথা কেউ মনে রাখেনি, আশ্চর্য কী। ওদের কখনওই কেউ মনে রাখেনি।
বিত্তবানের থেকে পরিযায়ী শ্রমিক যত দূরে, ততই কাছে। আমাদের গাঁথনির ইটে, ছাদের ঢালাইতে, শাড়ির জরি, হাতের কাঁকন, শিশুর খেলনাতে তাঁদের শ্রম। তাঁরাই দুমকা থেকে বর্ধমান, উত্তরপ্রদেশ থেকে হরিয়ানা গিয়ে ধান কাটেন, তাঁরাই ডাইমন থেকে কলকাতা, গোসাবা থেকে দিল্লি গিয়ে ভাত রাঁধেন। ন্যায্য পারিশ্রমিকের চাইতে কম টাকায় কাজ (এমব্রয়ডারির কাজে প্রতি পিস মজুরি কমছে), ঘুপচি ঘরে বসবাস (প্রায়ই দাহ্য বস্তুর সঙ্গে, তালাবন্দি হয়ে)। কেন আইনি অধিকার, প্রকল্পের সুবিধের কোনওটাই ওদের স্পর্শ করতে পারেনি, কেউ জানতে চায়নি। অবশ্য জানতে চাইলে কয়েক হাজার ইটভাটার কোনও একটাতে লেবারদের থাকার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেই হয়। পাঁজা করা ইটের দরজা-জানলাহীন খুপরিতে যাঁদের বাস, যাঁরা তীব্র গরম, বৃষ্টি, ক্ষুধা-রোগ-যৌন অত্যাচার থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারেন না, তাঁরা কী করে বাঁচবেন রোগ থেকে? এইডসের সামনে সমাজ বুঝেছিল, যাঁরা নিত্য-নির্যাতিত, তাঁদের রোগ এড়ানোর উপায় জানা থাকলেও কাজে লাগানোর ক্ষমতা নেই। আজ ফের সমাজ নিজেকে বাঁচাতে অবমানব এক কর্মীগোষ্ঠীকে মানুষের শ্রেণিতে তুলতে চাইছে। এই হল পরিবর্তনের সূচনার লগ্ন।
তাকে গতি জোগাবে কে? বড় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য গা ঘামাবে, সে আশা নেই। স্বাস্থ্য আন্দোলন, দলিত, নারী বা ছাত্র আন্দোলন? ভরসা হয় না। রাজনৈতিক দল ঠিকাদারদের ঘাঁটাবে না। হাতে রইল প্রশাসকের সক্রিয়তা। দৃষ্টান্ত কেরল। যে রাজ্য আগত শ্রমিকদের রাজ্য সরকারের শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্পের সুবিধে (২৫ হাজার টাকার স্বাস্থ্যবিমা, এক লক্ষ টাকার জীবনবিমা, সন্তানের শিক্ষা-অনুদান, সুলভ আবাসন) দিচ্ছে। অন্যকেও কর্তব্য স্মরণ করাচ্ছে – এখন কেরলের মজুর-শিবিরগুলোতে চাল দিচ্ছেন ঠিকাদারেরা।
প্রশাসনের নীতি দাঁড়িয়ে থাকে পরিসংখ্যানের উপরে। ১৯৯৮ থেকে সে রাজ্যের একটি গবেষণা সংস্থা নিয়মিত সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে চলেছে, রাজ্য থেকে কত লোক বাইরে কাজ করতে যাচ্ছে, কত জন আসছে অন্য রাজ্য থেকে। পশ্চিমবঙ্গে সে কাজটা এক-একবার শুরু হয়েছে ভিনরাজ্যে শ্রমিক খুন হওয়ার পর, তার পর সে কাজেরও অকালমৃত্যু হয়েছে। হয়তো ভিনরাজ্যে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যাটা কত বড়, তা ধরা পড়ার আশঙ্কায়। যে রাজ্য সর্বোচ্চ কর্মদিবস তৈরির দাবি করে, সেখানে কর্মহীনতার চেহারাটা কে-ই বা দেখাতে চায়?
অথচ সংখ্যা না হলে নীতি বদল হবে না, বদলাবে না মজুরের কপাল। তাই রাজ্য সরকারকে এই কাজটা করতে চাপ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কত পরিযায়ী শ্রমিক, গণনা চাই, নিয়মিত জেলাওয়াড়ি তথ্য প্রকাশ হওয়া চাই। এই তথ্যের অধিকারের উপরেই আজ দাঁড়িয়ে শ্রমিকের নিরাপত্তার অধিকার, রাজ্যবাসীর অকালমৃত্যু এড়িয়ে পূর্ণ আয়ুষ্কাল বাঁচার অধিকার। সমস্যা লুকোলে রোগ বাড়বে গোপনে। ওই তালিকা এখনই চাই। এই হল শুরুর শুরু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy