মৃণালদেবী
নানা কারণে আমার পক্ষে এখন মুর্শিদাবাদ যাওয়া সম্ভব নয়— এর জন্য আমি দুঃখিত। মুর্শিদাবাদ জেলায় মহিলা সমিতির কাজ প্রসার লাভ করিতেছে জানিয়া আমি সুখী হইয়াছি। নারী সমাজে জাতীয়তার বাণী প্রচার করা বিশেষ প্রয়োজন এবং কাজের জন্য মহিলা সমিতির ও মহিলা কর্ম্মীর বিশেষ আবশ্যকতা আছে।’
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ সালে ৩১ জুলাইয়ে লেখা এক চিঠিতে মণিমালা রায়কে এই কথাগুলো বলেছিলেন। মণিমালাদেবী মৃণালদেবীর দিদি। মৃণালদেবীর বয়স তখন কমবেশি বছর পঁচিশেক। তাঁর জন্ম তারিখ নির্দিষ্ট ভাবে জানা যায় না। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি মানলে তাঁর জন্ম ১৯১৪ সালের নভেম্বরে। বাবা শিবচন্দ্র রায় ছিলেন জঙ্গিপুর আদালতের আইনজীবী। মা সুশীলাসুন্দরীদেবী গৃহবধূ। তাঁরা থাকতেন রঘুনাথগঞ্জে, পুরভবনের কাছে নিজেদের বাড়িতে। ওই বাড়িতেই ১৯৮২ সালের ১০ কিংবা ১১ সেপ্টেম্বর নাগাদ মারা যান শেষ জীবনে প্রায় নির্বান্ধব মৃণালদেবী।
তিন বোনের মধ্যে মেজো মৃণালদেবী বালিকাবেলা থেকে বেশিরভাগ সময় থাকতেন জিয়াগঞ্জের ভট্টপাড়ায় দিদির বাড়িতে। দিদি মণিমালাকে সুভাষচন্দ্রও দিদি বলে ডাকতেন। তিনিও ছিলেন মহিলা সমিতির সংগঠক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। জেলা কংগ্রেসের নেতা ডাক্তার সুকুমার অধিকারীর উৎসাহে মণিমালা ১৯২১ সালে সুভাষচন্দ্রের সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন করাচি কংগ্রেসে। সুকুমারবাবু ছিলেন মণিমালার ভাসুর। অধিকারী পরিবারের দুয়ার সর্বদা অবারিত থাকতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য। সুকুমারবাবুর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েই সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম জিয়াগঞ্জে আসেন বলে জানা যায়। মৃণালদেবী সুভাষচন্দ্রের সংস্পর্শে আসেন ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের সময়। তবে তিনি জিয়াগঞ্জ থেকে নাকি অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামের শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতা গিয়েছিলেন সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। সে সময় কয়া গ্রামটি ছিল অবিভক্ত নদিয়া জেলার অন্তর্গত।
তখনকার রীতি অনুযায়ী অল্প বয়সেই মৃণালদেবীর বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর বয়স তখন বড়জোর ১২ বছর। স্বামী ফণিভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মৃণালদেবীর বয়সের ব্যবধান কমপক্ষে ৩০ বছর। মৃণালদেবীর শ্বশুরবাড়ি ছিল তৎকালীন স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম আঁতুড়ঘর। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত রাখিবন্ধন পালনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল ওই পরিবার। ১৯২৯ সাল। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা তথা নেতাজির ঘনিষ্ঠ সহযোগী যতীন দাস তখন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে লাহোর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। ওই একই জেলে বন্দি রয়েছেন ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত। রাজবন্দিদের প্রতি অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে এবং জেল আইন সংস্কারের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করলেন যতীন দাস। এ দিকে বাংলার জেলগুলিতেও তখন হাজার হাজার রাজবন্দি প্রতিনিয়ত নিপীড়িত হচ্ছেন।
১৯২৯ সালের মার্চে গ্রেফতার করা হয় বিপ্লবী সতীন সেনকে। তিনি বরিশাল জেলে বন্দি ছিলেন। জেলবন্দিদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন সতীন সেন। ২১ সেপ্টেম্বর বরিশাল টাউন হলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র আহ্বান জানান, ‘‘দেশবাসী যেন এমন এক উত্তাল ও বিধ্বংসী আন্দোলন চালিয়ে যান যা শ্রীযুক্ত সেনকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য করবে।’’ দেশের নানা প্রান্তে নানা ভাবে শুরু হয় প্রতিবাদ। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কয়া গ্রামে বাঁধা হল অনশন মঞ্চ। মঞ্চে অনশন শুরু করলেন মৃণালদেবীও। দৈনিক সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশিত হল অনশন-সংবাদ। সেই সংবাদে আলোড়িত হল সারা বাংলা। বিচলিত হলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি স্বয়ং সুভাষচন্দ্রও। কংগ্রেসের এক জন বাধ্য সৈনিক হিসেবেই তিনি হয়তো সে দিন ভিন্ন মত সত্ত্বেও কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে চাননি। তিনি একটি চিঠি পাঠিয়ে মৃণালদেবীকে অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। সে অনুরোধ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন মৃণালদেবী।
সুভাষচন্দ্রের আহ্বানে ১৯২৯ সালের ৬ অক্টোবর পালিত হয় নিখিলবঙ্গ সতীন সেন দিবস। সেই কর্মসূচি মৃণালদেবীকে আরও প্রাণিত করে। শেষ পর্যন্ত ঠিক কত তারিখে তিনি অনশন ভঙ্গ করেছিলেন তা নির্দিষ্ট ভাবে জানা না গেলেও শোনা যায়, অনশন চলেছিল টানা ৩৯ দিন। মৃণালদেবীর এই অনশন-সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল লাহোর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি ভগৎ সিংয়ের কাছেও। মৃণালদেবীকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন ভগৎ সিং। ১৯২৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় লাহোরে। সেই সময় দিদি মণিমালাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে মৃণালদেবী লাহোর গিয়েছিলেন এবং জেলবন্দি ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন বলে মণিমালাদেবীর পুত্র সুহাস অধিকারীর সাক্ষাৎকার ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। আরও জানা যায় যে, ভগৎ সিং তাঁকে ওয়াটারম্যান কোম্পানির একটি কলম উপহার দিয়েছিলেন যেটি সারা জীবন তিনি সযত্নে রক্ষা করেছিলেন।
বিশিষ্ট সিপিআই নেতা প্রয়াত সনৎ রাহা ১৯৮২ সালের ১ অক্টোবর এসইউসিআই নেতা অচিন্ত্য সিংহকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘১৯৩৮ সালে মৃণালদেবী সুভাষবাবুর বাম সমন্বয় কমিটির কার্যকরী সমিতির জেলায় সদস্যপদ লাভ করেন।... দেশপ্রেমিক সে যে কোনো দলের হলেও মৃণালদেবীর প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।’’ ওই চিঠি থেকে আরও জানা যায়, ১৯৩১ সালে বহরমপুরে অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে মহিলা বিভাগের সহ-সভানেত্রী ছিলেন মৃণালদেবী। মহিলা সম্মেলনের সভানেত্রী ছিলেন নিরুপমাদেবী। ১৯৩২ সালে জিয়াগঞ্জ থেকে প্রথম সত্যাগ্রহী মৃণালদেবী আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন এবং বহরমপুর জেলের মহিলা ওয়ার্ডে তাঁকে রাখা হয়। বাল্যবিধবা মৃণালদেবী জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম সারির নেতৃত্ব লাভ করেন। ১৯৩৩-৩৪ সালে বহরমপুর সংঘের যোগমায়া ভবনে জেলা রাষ্ট্রীয় (কংগ্রেস) সমিতির মহিলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলে তার সভানেত্রী পদে মৃণাল দেবী নির্বাচিত হন।
মৃণালদেবী মুর্শিদাবাদকে তাঁর মূল কর্মক্ষেত্র করে নিয়েছিলেন। তবুও রাজ্য স্তরেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩৯ সালের ৩০ জুলাই কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল জনসভা। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে নেতাজি ঘোষিত জাতীয় সংগ্রাম সপ্তাহের প্রস্তুতি উপলক্ষে আয়োজিত সেই সভায় অন্যতম বক্তা ছিলেন মৃণালদেবী। অনশনরত রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সে দিন সরব হয়েছিলেন এই মহিলা। ১৯৩৯ সালের ১ অগস্ট হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় মৃণালদেবীর বক্তব্যের উল্লেখ করে একটি সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়।
মৃণালদেবী শুধুমাত্র এক জন একনিষ্ঠ লড়াকু নেত্রীই ছিলেন না, ছিলেন সমাজসেবীও। বন্যার্তদের সাহায্যে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন আন্তরিক ভাবে। স্বাধীনতা পরবর্তী কালেও যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। বিশেষত শেষ বয়সেও ভাষা-শিক্ষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে নেমে এসেছেন রাজপথে। তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়েছে সে সময়ের প্রবাসী, ভারতবর্ষ, দেশ-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। শুধু কবিতা নয়, গানও লিখেছেন। এমন এক জন মহিলাকে আমরা মনে রেখেছি কি?
তথ্যঋণ—
১) জঙ্গিপুর বহ্নিশিখা মৃণালদেবী বিশেষ সংখ্যা, সম্পাদনা— কবিতা সিংহ ২) মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র: পুলকেন্দু সিংহ ৩) জাগরণ ও বিস্ফোরণ: কালীচরণ ঘোষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy