দী পাবলি আসিয়াছে। দূষণও। যথারীতি। পরিবেশমন্ত্রীর ভাষায়— পরম্পরা অনুসারে। বাজির শব্দে কান পাতা দায়, বাজির ধুঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হইবার উপক্রম। দম চাপিয়া কয়টি দিন পার করিয়া দিতে পারিলে ফের এক বৎসরের জন্য নিস্তার মিলিবে। যাঁহারা পারিবেন না, তাঁহাদের খবর রাখিবার দায় উৎসবের নাই। বস্তুত, উৎসবের সহিত অসুবিধা সৃষ্টির সম্পর্কটি ক্রমে স্বতঃসিদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। আর পাঁচ জনের জীবন বিষাইয়া দিতে না পারিলে যেন কোনও আনন্দই সম্পূর্ণ হয় না। অর্থনীতির যুক্তি এই প্রবণতার একটি ব্যাখ্যা দিবে— বাজি পুড়াইবার ফলে যে উপভোগ, তাহা নিতান্তই ব্যক্তিগত, কিন্তু দূষণ সর্বজনীন। দুই অর্থে সর্বজনীন: এক, নিজের পোড়ানো বাজি হইতে যে দূষণ হয়, তাহাতে শুধু নিজের ক্ষতি হয় না; এবং দুই, কোনও ব্যক্তি নিজে দূষণ করুন আর না-ই করুন, যত ক্ষণ অবধি অন্যান্যরা বাজি পুড়াইতেছে, তত ক্ষণ দূষণের ভাগ তাঁহাকেও লইতে হইবে। ফলে, যে কোনও নেতিবাচক অতিক্রিয়ার ন্যায় বাজির দূষণকেও বাজারের নিয়মে ঠেকাইবার উপায় নাই। রংমশালের বিষবাষ্প ফুসফুসে জানান দিতেছে, সাধারণ মানুষ নিজের সংকীর্ণ এবং তাৎক্ষণিক আনন্দকে অতিক্রম করিয়া সমাজের এবং নিজের, দীর্ঘমেয়াদি মঙ্গলের কথা ভাবিতে শিখে নাই। সেখানেই প্রশাসনের গুরুত্ব। কিন্তু নিষিদ্ধ বাজির স-আওয়াজ এবং স-ধোঁয়া উচ্ছ্বাস বলিয়া দিবে, প্রশাসনও তাহার দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়াছে। ফলে, শহর জুড়িয়া নিষিদ্ধ বাজি বিক্রয় চলিতেছে।
আনন্দের নামে মারণযজ্ঞের পিছনে একটি কারণ যদি প্রশাসনিক গয়ংগচ্ছতা হয়, অন্য কারণ তবে সচেতনতার অভাব। শব্দবাজি লইয়া তবুও খানিক চেতনা আছে। বোমা-পটকার বাড়াবাড়ি হইলে এখনও কেহ কেহ থানার নম্বরে ফোন করিয়া থাকেন। কিন্তু হয়তো সেই ‘সচেতন’ নাগরিকদের একটি অংশও সন্তানের হাতে নির্ভাবনায় রংমশাল, সাপবাজি, তুবড়ি তুলিয়া দেন। ভাবেন, নির্দোষ শিশুভোগ্য বাজি। তাহার নিঃশব্দ ধোঁয়ায় শিশু-ফুসফুসের কী অবস্থা হইতেছে, সেই খোঁজ রাখিবার কথা ভাবেন না। এখানে প্রশাসনের দায় দ্বিগুণ। এক, সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি তাহাদেরই কর্তব্য ছিল। দুই, বাজিতে কোন মশলা ব্যবহার করা হইতেছে, তাহার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাও প্রশাসনেরই কাজ। রাজ্যের কর্তারা সেই দায়িত্ব সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়াছেন। পুলিশও গা ছাড়িয়া দিয়াছে। দুই দিন বই তো নহে, মানুষের আনন্দে বাধা দিয়া লাভ কী— এহেন প্রশ্রয়েই রাজ্য জুড়িয়া বাজির রমরমা।
অথচ, এক কালে এই পশ্চিমবঙ্গই দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশে সর্বাগ্রগণ্য ছিল। শব্দবাজির বিরুদ্ধে কঠোরতম আইনও এই রাজ্যেই বর্তমান। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কি সেই ইতিহাসের কথা ভুলিয়াছে? আতসবাজির বিরুদ্ধে পর্ষদের নামমাত্র সক্রিয়তাও নাই। কুটিরশিল্পে বাজি তৈরি হইতেছে, তাহার কেনাবেচা চলিতেছে। কেহ যদি এই প্রবণতাটিকে রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতির সহিত মিলাইয়া পড়িতে চাহেন, তাঁহাকে দোষ দেওয়া যায় কি? এই রাজ্যে এখন সবাই রাজা। নির্দিষ্ট দেবতাকে নৈবেদ্য চড়াইতে থাকিলে কোনও কাজেই বাধা নাই। অনুমান করা চলে, যাঁহারা বাজি বানাইতেছেন এবং যাঁহারা সেই বাজি বেচিতেছেন, উভয় পক্ষই দেবতাদের সন্তুষ্ট রাখিয়াছেন। অতএব, কেহ আর কেঁচো খুঁড়িতে সাহস করেন না। বাকি থাকেন ক্রেতারা। তাঁহারা জনগণেশ। এবং, তাঁহাদের মাথাগুলিও নিতান্ত হাতবিহীন নহে। তাঁহারা যদি কয় দিন বাজি ফাটাইয়া আনন্দ করিতে চাহেন, আপত্তি করে, সাধ্য কাহার! ফুসফুস যদি জ্বলিয়া যায়, কান যদি ফাটে— কোল্যাটারাল ড্যামেজ। পরিবেশমন্ত্রীর পরম্পরাকে বাঁচাইতে আনুষঙ্গিক ক্ষতিটুকু মানিতে হইবে বইকি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy