ডিজ়গাইজ়ড আনএমপ্লয়মেন্ট বা ‘প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব’ কথাটি অনতিঅতীতে বিপুল চর্চার বিষয় ছিল। বিশেষত, ভারতীয় কৃষি সংক্রান্ত আলোচনায় শব্দবন্ধটি ঘুরিয়া-ফিরিয়া আসিত। ধরা যাউক, একটি নির্দিষ্ট আয়তনের ক্ষেত্রে চার জন কৃষক কাজ করিলে যতখানি শস্য উৎপন্ন হয়, পাঁচ অথবা ততোধিক কৃষক কাজ করিলেও উৎপাদনের পরিমাণ আর বাড়িবে না। এই ক্ষেত্রে, পঞ্চম কৃষক হইতে প্রত্যেকেই প্রচ্ছন্ন বেকার। অর্থাৎ, তাঁহারা কাজ করিতেছেন, কিন্তু তাহাতে মূল্য সংযোজন হইতেছে না। আশঙ্কা হয়, অনতিভবিষ্যতে ভারতীয় শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন বেকারত্বের ধারণাটি প্রযুক্ত হইবে। অবশ্য, খানিক বদলাইয়া লইয়া। যে কর্মীর যতখানি উৎপাদনশীল হইতে পারিবার সামর্থ্য, তাঁহাকে যদি তুলনায় অনেক কম উৎপাদনশীল কাজে নিয়োগ করা হয়— বাণিজ্য শাখায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীকে যদি কোনও অ্যাপের ডেলিভারি বয় হইতে হয়— তবে তাহাকে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব না বলিবার বিন্দুমাত্র কারণ আছে কি? তাহাতে সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তির ক্ষতি— তাঁহার যে টাকা রোজগারের সম্ভাবনা ছিল, কাজ হইতে যতখানি তৃপ্তি পাইবার ছিল, প্রকৃত অর্জন তাহার তুলনায় অতি কম। তাহাতে দেশেরও ক্ষতি— প্রথমত, শিক্ষা খাতে ব্যয়ের অপচয়; এবং দ্বিতীয়ত, যুবশক্তির সম্ভাবনাকে ব্যবহার না করিবার ফলে ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ডটি সম্পূর্ণ হাতছাড়া হয়। ভারতে এই প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব বাড়িতেছে। ‘কোনও কাজই ছোট নহে’ জাতীয় নীতিকথায় এই বিপদ ঢাকা পড়িবে না। কাজগুলি ছোট না হইতে পারে, উৎপাদনশীলও নহে। নেতারা যতই বলুন না কেন, এই কাজের জোরে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটিতে রুমাল পাতিয়া আসা যাইবে না।
দিল্লির রাজপথে যে ছাত্ররা কর্মসংস্থানের দাবিতে মিছিল করিলেন, তাঁহারা ডেলিভারি বয় হইতে চাহেন নাই। পকোড়া (বা, বাঙালির তেলেভাজা) বেচিতেও তাঁহাদের আগ্রহ নাই। ফাঁস হইয়া যাওয়া কর্মসংস্থান সমীক্ষা জানাইয়াছে, গত প্রায় অর্ধশতাব্দীতে ভারতে কখনও কর্মসংস্থানহীনতার হার এত বাড়ে নাই। কিন্তু, যত লোক ‘চাকুরি’ পাইয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যেও প্রচ্ছন্ন বেকার কত জন, সমীক্ষা বলে নাই। মিছিলে হাঁটিয়া ছাত্ররা ‘প্রকৃত’ চাকুরি দাবি করিতেছেন। কর্মীর উৎপাদন-সম্ভাবনার সিংহভাগ ব্যবহার করিতে পারা প্রকৃত চাকুরির জরুরি শর্ত। কিন্তু, একমাত্র নহে। সেই চাকুরির পরিবেশ ও পরিস্থিতি মানবিক হওয়া বিধেয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রসঙ্গ আপাতত বকেয়াই থাকুক, সংগঠিত ক্ষেত্রেরও যে সব ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকাশ্যে আসে, তাহাকে প্রকৃত চাকুরি বলা দুষ্কর। কাজের চাপ এমনই যে কর্মীরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ারও অবকাশ পান না, ডায়াপার পরিতে বাধ্য হন— এমন ঘটনা শুধু চিনে ঘটে না। কাজ করি অথবা না-ই করি, চাকুরি থাকিবে— এ হেন নিশ্চয়তা কর্মসংস্কৃতির ক্ষতি করে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাহার বিপ্রতীপে হাঁটিতে আরম্ভ করিয়া ‘নিয়োগ ও ছাঁটাই’-এর নীতি এমনই অবস্থানে পৌঁছাইয়াছে যে কর্মীরা মানসিক রোগগ্রস্ত হইতেছেন— এমন উদাহরণও ইদানীং না খুঁজিতেই মিলে। এ হেন অনিশ্চয়তা মাথায় লইয়া প্রত্যহ যে কাজ করিতে হয়, তাহাকেও কি প্রকৃত চাকুরি বলা চলে? পরিস্থিতি শুধরাইবার দায় কতখানি বাজারের আর কতখানি সরকারের, সেই তর্ক থাকিবে। কর্মীদেরও ‘চাকুরি’ বস্তুটিকে নূতন ভাবে চিনিতে হইবে কি না, সেই আলোচনাও জরুরি। কিন্তু, সর্বাগ্রে সমস্যাগুলিকে স্বীকার করা প্রয়োজন। ‘অর্থনীতি যখন চলমান, তখন চাকুরিও নিশ্চয় হইতেছে’, সরকার যদি এ হেন বায়বীয় বিশ্বাসের ভরসায় থাকে, তবে সমস্যা ক্রমে বাড়িবে। প্রচ্ছন্ন বেকারত্বের সমস্যাটি তীব্রতর হইবে। মিছিল বলিতেছে, তাহার ফল রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষেও ভাল নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy