মহামারি বার বার পর্যুদস্ত করেছে ভারতকে। তা কলেরাই হোক বা গুটিবসন্ত কিংবা প্লেগ বা ইনফ্লুয়েঞ্জা... জীবাণু বা ভাইরাসঘটিত এ সব মহামারীর আক্রমণের ধরনটি কিন্তু নিঃশব্দে ছিল না। সংক্রমণযোগ্য এই অসুখগুলি প্রকট হত সুস্পষ্ট লক্ষণ নিয়ে। ঝটিতি আক্রমণে তারা ঘায়েল করতে রোগীকে।
কিন্তু আজ প্রবল আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন একটি অসুখ যা সেই অর্থে সংক্রামক নয়। কিন্তু নিঃশব্দ আক্রমণে সে তছনছ করে দিচ্ছে স্বাস্থ্যের সংসার। এই অসুখটির নাম ডায়াবিটিস মেলাইটাস তথা মধুমেহ।
ডায়াবিটিসে রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অগ্ন্যাশয়ের ‘বিটা সেলস অব ল্যাংঙ্গারহ্যানস’ থেকে যে ইনসুলিন তৈরি হয় তা রক্তের গ্লুকোজকে কোষের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেয়। ডায়াবিটিসের কারণ হল শরীরে এই ইনসুলিনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভাব। প্রত্যক্ষ অভাবে হয় টাইপ-ওয়ান ডায়াবিটিস যেখানে শরীরের ব্যর্থতা ইনসুলিন তৈরি হওয়ার মধ্যেই। স্বভাবতই এটি শুরু হয় কম বয়সেই। আর পরোক্ষ অভাব সৃষ্টি হয় যখন স্থুলত্ব ইত্যাদি কারণে শরীরে ‘ইনসুলিন-প্রতিরোধ’ তৈরি হওয়ায় উপস্থিত ইনসুলিন ঠিকঠাক কাজ করতে পারে না। এটিই টাইপ-টু ডায়াবিটিসের কারণ। যা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের হয়। এ ছাড়াও রয়েছে জেসটেশনাল বা গর্ভাবস্থার ডায়াবিটিস। এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গর্ভাবস্থা শেষ হওয়ার পরে ঠিক হয়ে গেলেও শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ডায়াবিটিস রোগীদের ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশই টাইপ-টু ডায়াবিটিসের রোগী। যা আজ
সঙ্কটের কারণ।
ডায়াবিটিসের বিপজ্জনক দিক হল এর নীরবে ক্ষতিসাধন করতে পারার ক্ষমতা। আক্রান্ত হওয়ার সাত থেকে দশ বছর পর্যন্ত বা রোগ নির্ণয় হওয়ার পরেও রোগীর মনোযোগ পাওয়ার মতো কোনও বহির্লক্ষণ নাও থাকতে পারে। এ ভাবেই শব্দহীন পদচারণায় ডায়াবিটিস আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে একবিংশ শতাব্দীর এক অন্যতম ভয়াল অসুখ। এ বছরেই নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতে ডায়াবিটিসে আক্রান্ত প্রায় প্রতি দু’জনের এক জন জানেন না তাঁর এই অসুখের কথা। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবিটিক ফেডারেশন-এর প্রকাশিত ডায়াবিটিস অ্যাটলাস অনুযায়ী, ভারতে ২০০৭ সালে ডায়াবিটিস রোগীর সংখ্যা ছিল চার কোটি। ২০১৭ সালে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় সোয়া সাত কোটিতে। তাঁদের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৪৫-এ এই সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে তেরো কোটিতে। ভয়াবহ তথ্য! এখনই ভারতকে পৃথিবীর ডায়াবিটিসের রাজধানী বলা শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও এখনও ভারতের আগে আছে চিন। কিন্তু বলা হচ্ছে সংখ্যাবৃদ্ধির এই হারে ভারত আগামী পাঁচ বছরে চিনকে ছাপিয়ে যাবে।
ভারতবর্ষ ডায়াবিটিসের প্রায় অবাধ মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার কারণ হিসেবে দু’টি উপাদানকে চিহ্নিত করা হয়। প্রথমটি ভারতীয়দের জিনগত প্রবণতা। দেহের সার্বিক স্থূলত্ব যদিও বা না থাকে, কিন্তু ভারতীয়দের উদরের চর্বিস্ফীতি তৈরি করে ইনসুলিন-প্রতিরোধ। দ্বিতীয় উপাদানটি পরিবেশগত। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নগরায়ন, দ্রুত জীবন, যন্ত্রনির্ভরতা এনেছে ভারতবাসীর জীবনশৈলীতে ঋণাত্মক পরিবর্তন। তার মধ্যে প্রধান, দৈহিক পরিশ্রমরহিত জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন। খাদ্যে ফাইবারসমৃদ্ধ খাবারের জায়গা নিচ্ছে উচ্চক্যালরিযুক্ত শাকআনাজবিহীন পরিশোধিত সূক্ষ্ম খাবার, ভাজাভুজি, ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড। এ সবের পরিণতি স্থূলত্ব, যা বোধন ঘটাচ্ছে ডায়াবিটিসের।
মানবসভ্যতা বিগত তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ডায়াবিটিসকে চিহ্নিত করেছে, সংগ্রাম করে চলেছে তার প্রতিকারের জন্য। ডায়াবিটিসের প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ১,৫০০ শতকে। এটি মিশরের তৃতীয় রাজবংশের চিকিৎসক হেশিরা উল্লেখ করেন এবার্স ভূর্জপত্রে। অসুখটিকে বর্ণনা করা হয় ‘খুব বেশি মাত্রার মূত্রত্যাগের অসুখ’ বলে। বর্ণিত হয় তার কিছু চিকিৎসাও।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকেরাও এই অসুখকে চিহ্নিত করেন এবং নাম দেন ‘মধুমেহ’। ডায়াবিটিস রোগীর প্রস্রাবে পিঁপড়ে আকৃষ্ট হচ্ছে কি না দেখে রোগ নির্ণয় করা হত। ভারতীয় চিকিৎসক চরক এবং শুশ্রুত টাইপ ওয়ান এবং টাইপ টু ডায়াবিটিসকে আলাদা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁরা লক্ষ করেছিলেন প্রথমটি কম বয়সের সঙ্গে এবং পরেরটি বেশি বয়স ও স্থূলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
ডায়াবিটিস রোগটির রহস্য উন্মোচন হতে শুরু করল উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে। ১৮৮৯ সালে এক শারীরবৃত্তীয় গবেষণা করতে গিয়ে ফ্রান্সের স্ট্রামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী অস্কার মিনকোউসকি এবং জোসেফ ভন মেরিং সেরেনডিপিটি বা কাকতালীয় ভাবে আবিষ্কার করেন অগ্ন্যাশয় বাদ দিলে কুকুর ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ, অগ্ন্যাশয়েই আছে সেই নিয়ন্ত্রক যা ডায়াবিটিসের কারণ।
১৯২০ সালে শুরু হল চরম সাফল্যের অধ্যায়। মোজেস ব্যারন নামে এক আমেরিকান প্যাথলজিস্ট-এর ‘আইলেটস অফ ল্যাংঙ্গাহ্যানসের সঙ্গে ডায়াবিটিসের সম্পর্ক’ শীর্ষক লেখা পড়ে ফ্রেডেরিক গ্রান্ট ব্যান্টিং-এর মস্তিষ্কে জন্ম নিল ইনসুলিন-এর ধারণা। তাঁর উদ্যোগ ১৯২১ সালে ইনসুলিনের আবিষ্কার হল। সঙ্গে ছিলেন আরও তিন বিজ্ঞানী। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাটির পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জন জেমস রিকার্ড ম্যাকলয়েড। ব্যান্টিং-এর সর্বক্ষণের গবেষণা-সহায়ক ছিলেন চার্লস হার্বার্ট বেস্ট।
আর অগ্ন্যাশয়ের নির্যাসকে বিশুদ্ধকরণের দায়িত্ব ছিলেন জৈবরাসায়নিক জেমস বার্ট্রাম কলিপ। ১৯২৩ সালের ২৫ অক্টোবর ব্যান্টিং এবং ম্যাকলয়েড ইনসুলিন আবিষ্কারের জন্য পেলেন নোবেল পুরস্কার। ব্যান্টিং খোলা মঞ্চে বেস্ট-এর ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য তাঁর সঙ্গে সমান ভাবে ভাগ করেন। ম্যাকলয়েডও অর্থমূল্য সমান ভাগে ভাগ করে নেন কলিপ-এর সঙ্গে ।
ডায়াবিটিস বা ইনসুলিনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে আরও নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা। ১৯২৩ সালে ফ্রেডেরিক স্যানগার নোবেল পান ইনসুলিন গঠন আবিষ্কারের জন্য, ১৯৫৯ সালে নোবেল পান আরএস ইয়েলো এবং সলোমন বার্ন ‘ইমিউনো-অ্যাসে’ পদ্ধতিতে রক্তে ইনসুলিনের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য। ১৯৪২ সালে আবিষ্কৃত হল ডায়াবিটিসের জন্য মুখে খাওয়ার ওষুধ সালফোনাইলইউরিয়া। এবং পরে ক্রমশ আরও অনেক ওষুধ।
ডায়াবিটিসের চিকিৎসা বিজ্ঞানের হস্তগত হলেও এই রোগের প্রকোপ থেকে পরিত্রাণ মিলছে না নিছক সচেতনতার অভাবে। নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবিটিস মানেই মৃত্যু অথবা পঙ্গুত্ব। ডায়াবিটিস থেকে জটিলতার কারণে বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতি সেকেন্ডে এক জন না এক জনের পা শল্যচিকিৎসায় বাদ দিতে হচ্ছে। আক্ষেপের কথা, এর শতকরা ৭৫ ভাগই নিবারণযোগ্য। চিকিৎসাগত সচেতনতার অভাবে ভারতবর্ষে ডায়াবিটিস রোগীর (১৫ বছরের অসুখেই) তিন-চতুর্থাংশ ভোগেন চোখের অসুখে (রেটিনোপ্যাথি), এক-তৃতীয়াংশ শিকার হন কিডনির অসুখের (নেফ্রোপ্যাথি) এবং শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ভোগেন স্নায়ুগত জটিলতায়।
ডায়াবিটিস ঠেকানোর জন্য প্রয়োজন জীবনশৈলীর ধনাত্মক পরিবর্তনের। দরকার দৈহিক সক্রিয়তা ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের অভ্যাস। যা দূরে রাখবে স্থূলত্ব এবং সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবিটিসকেও। ডায়াবিটিস হয়ে গেলে প্রয়োজন চিকিৎসা ও রক্তের শর্করার ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ।
ব্যান্টিং-এর জন্মদিন ১৪ নভেম্বর। এই জন্মদিনটি ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবিটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) উদ্যোগে উদ্যাপিত হয় ‘বিশ্ব ডায়াবিটিস দিবস’ হিসেবে। ডায়াবিটিস রোগীর পরিবারের ভূমিকা ও সচেতনতার অনুষঙ্গে এই দিবসে এই বছরের থিম ছিল ‘পরিবার এবং ডায়াবিটিস’।
আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy