ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, উঠল বাজনা বাজি, ভোটের সময় এল কাছে! ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরটা গোড়া থেকেই ব্যস্তসমস্ত কাটে। প্রায় প্রতি বার ফেব্রুয়ারি মাসে ভোটযাত্রার উদ্বোধন— দুই পার্টির অভ্যন্তরীণ প্রচারের শুরু। তবে ফেব্রুয়ারি ২০২০’তে হইচইটা অনেক গুণ বেশি, বিস্তর উত্তেজনা দেশ জুড়ে। গণতন্ত্র মরবে না বাঁচবে, না কি মরে ভূত ইতিমধ্যেই— তা নিয়ে চূড়ান্ত হেস্তনেস্ত হবে এ বার ট্রাম্প জেতেন না হারেন তা-ই দেখে।
অভূতপূর্ব ঘটনা সব। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হল। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস-এ দোষী প্রমাণিত হয়ে উচ্চকক্ষ সেনেট-এ নির্দোষ ঘোষিত হলেন ট্রাম্প— হরেদরে ‘নির্দোষ’। প্রসঙ্গত, প্রায় আড়াইশো বছরের গণতন্ত্রে প্রেসিডেন্ট-এর বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া ঘটতে দেখা গেল মাত্র তৃতীয় বার। (মতান্তরে, চতুর্থ বার।) প্রথম: অ্যান্ড্রু জনসন, ১৮৬৮ সালে। দ্বিতীয়: বিল ক্লিন্টন, ১৯৯৮ সালে। (এঁদের দুই জনের মাঝে আছেন আর এক জন— রিচার্ড নিক্সন, ১৯৭৪ সালে যাঁকে ইমপিচ করার প্রস্তাব গৃহীত হলে তিনি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন।) সুতরাং তৃতীয় (মতান্তরে চতুর্থ) স্থান অধিকার করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, ২০১৯ সালে। জনসন, ক্লিন্টন ও ট্রাম্প— তিন জনই সেনেট ট্রায়ালে মুক্তি পেয়েছেন, শেষ অবধে ইমপিচড্ হতে হয়নি কাউকেই।
তবু ট্রাম্পের সঙ্গে বাকি দুই জনের বিরাট পার্থক্য। এত বারের মধ্যে এই প্রথম বার— ইমপিচড্ হতে-যাওয়া প্রেসিডেন্টদের মধ্যে ট্রাম্পই আবার নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী। জনসন প্রার্থী হতে চাননি। ক্লিন্টনের বেলায় প্রশ্নটাই ওঠেনি, কেননা সেটা ছিল তাঁর দ্বিতীয় দফা। তা ছাড়া, জনসন ও ক্লিন্টন দুই জনেই প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। ট্রাম্প বলেছেন— ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই নেই, যাঁরা অভিযোগ এনেছেন তাঁরাই আসল দোষী।
আরও বলেছেন ট্রাম্প। বলেছেন, তিনি আবার প্রেসিডেন্ট হয়ে এলে আবারও তাঁকে ইমপিচ করতে হতে পারে! অর্থাৎ তিনি আবারও ‘অ-সাংবিধানিক’ কাজকর্ম করতেই পারেন। কেননা এই গোটা ঘটনায় তিনি জেনে গিয়েছেন যে, আক্ষরিক ভাবে যা-ইচ্ছে-তাই করলেও সাংবিধানিক ‘পদ্ধতি’ দিয়ে কেউ তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। আর তাই, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট-এর বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার হওয়ার কথা একটি অতীব ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ, যা কালে-ভদ্রে বিশেষ বিবেচনাসাপেক্ষে গৃহীত হয়, গভীর বিপজ্জনক কোনও সংবিধান-অমান্যের ক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যাকে দেখা হয়, কিংবা মার্কিন গণতন্ত্রের বিখ্যাত ‘চেকস-অ্যান্ড-ব্যালান্সেস’ নামক রক্ষাকবচের গুরুতর অংশ হিসেবে যাকে গণ্য করা হয়, সেই বিষয়টাকে ট্রাম্প শেষ অবধি সম্পূর্ণ হাসিঠাট্টার স্তরে নামিয়ে আনতে পারলেন। টিটকিরি দিয়ে বলতে পারলেন, দেখ বাবাজি দেখবি নাকি, আমায় ইমপিচ করলে তোদের কী হাল হয়! আমার যা করার আমি করব, করে যাবই। এই ভাবে গোটা ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি শুধু স্বয়ং বিপুল ভাবে জয়ী হয়ে বেরিয়ে এলেন না— কংগ্রেস বা আদালতের সমস্ত রকম গণ্ডি-সীমা অতিক্রম করে প্রেসিডেন্ট-এর ক্ষমতাকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলার একটা ব্লুপ্রিন্ট উপহার দিলেন দুনিয়ার গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে।
এটাই বুঝিয়ে দেয়, ট্রাম্পের সঙ্গে আগেকার অভিযুক্ত প্রেসিডেন্টদের তফাতটা ঠিক কোথায়। তফাত এতটাই যে, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ফর্সা হতে বসেছে ট্রাম্পের সৌজন্যে। সঙ্কীর্ণতম স্বার্থসন্ধান ছাড়া আর কিছুই দেখতে চান না, অথবা পান না এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট, বিশ্বের তাবড় ডিকটেটরদের মতোই। নিজের স্বার্থ আর দেশের স্বার্থের পার্থক্য করতে পারেন না তিনি, নিজের সিদ্ধিকেই দেশের সিদ্ধি বলে মনে করেন। অমিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর প্রভূত অর্থতন্ত্রের সমন্বয় ঘটলে গণতন্ত্রের সংবিধান-টংবিধান তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে যে কোনও প্রক্রিয়া বানচাল করা যায়, যে কোনও তন্ত্র ছাপিয়ে একনায়ক ওঠা যায়, ট্রাম্প তা দেখিয়ে দিয়েছেন।
নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করাকেই ‘দেশের কাজ’ ভাবেন যিনি, স্বভাবতই তাঁর হাতে পড়ে নির্বাচনের হালচালও যাচ্ছে পাল্টে। আপাতত তাঁর প্রচার— দেশের ক্ষমতা সুস্থিত রাখতে চাইলে সকলে যেন তাঁকেই সমর্থন করেন, কারণ ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প, দ্য ডিফেন্ডার অব ডেমোক্র্যাসি’! প্রহসনও যে ঐতিহাসিক মাত্রায় পৌঁছতে পারে, ট্রাম্প-যুগ তার প্রমাণ। প্রথম বছরের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বুলির প্রচার শেষ বছরে এসে দাঁড়াল ‘ট্রাম্পই আমেরিকার ধ্বজাধারী’, এই দাবিতে। স্বভাবতই, এই যুক্তিতে, যে কোনও প্রতিবাদী বা প্রতিস্পর্ধী মুখ-খোলামাত্র হয়ে যান আমেরিকার স্বার্থবিরোধী, দেশের শত্রু।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ধ্বনিটি মার্কিন নাগরিকের কানে কেমন শোনাতে পারে, আন্দাজ করা সহজ। এখানেই ট্রাম্পের বিরাট সাফল্য। ঠিক বুঝে নেন তিনি, কোন কোন ধ্বনি দিয়ে মার্কিন সমাজের মধ্যে একটা খাড়াখাড়ি মেরুকরণ করে ফেলা যাবে, এবং সেই দ্বিমেরু সমাজের একটা অংশের সমর্থন অটুট থাকলে অন্য অংশের মতামত নিয়ে মাথাও ঘামাতে হবে না। সংবিধানের বিধি কিংবা দেশের আইন কিংবা বিচারের রায়, এই সব কিছুকেই পদ্ধতিগত ভাবে অকেজো করে দেওয়া যাবে, যদি সমাজের একটা বড় সমর্থন সঙ্গে থাকে, এবং অনবরত সংবাদমাধ্যম কিংবা সমাজমাধ্যমে সেই সমর্থন প্রতিষ্ঠিত হয়। ট্রাম্প দেখিয়ে দিয়েছেন, আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগকে নিজের প্রভাববলয়ে টেনে আনা অত্যন্ত সহজ, আর বিচারবিভাগকে টানাও খুব কঠিন নয়! এই যেমন, গুরুতর অপরাধে যখন তাঁর এক বন্ধু-রাজনীতিকের বিচার চলছিল, সামান্য টুইটার হ্যান্ডলের সাহায্যে সেই বিচারের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দিলেন ট্রাম্প। এত গোলযোগ তৈরি করলেন যে উল্টো পক্ষের আইনজীবীরা মামলা থেকে অব্যাহতি চাইলেন।
ট্রাম্পের অন্য একটি সাফল্যও আছে— প্রচ্ছন্ন, কিন্তু আরও সফল, আরও বিধ্বংসী। জনসমাজকে ‘খেপিয়ে’ দিলেই তো হল না, জনপ্রতিনিধিদের বাগে আনাও জরুরি, হয়তো জরুরিতর, কেননা তাঁরাই তো ভোটটা দেবেন ইম্পিচমেন্ট-এর পক্ষে-বিপক্ষে। দেখা গেল, আমেরিকার জন্ম থেকে যে রিপাবলিকান পার্টি বড় বড় কাজ করেছে, দেশকে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সামাজিক অধিকারের কঠিন সব সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’ এ বার ‘অঁ মাস’ অর্থাৎ প্রায় সামগ্রিক ভাবে মারাত্মক-অভিযোগে-অভিযুক্ত প্রেসিডেন্টের পিছনে দাঁড়াল। ইউক্রেনের সরকারকে দিয়ে নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন-এর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করাচ্ছিলেন ট্রাম্প, যা নিঃসন্দেহে কোনও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নীতির বিরোধী, ঘৃণ্য নিকৃষ্ট প্রতিহিংসা। এ বিষয়ে নিজের বিরুদ্ধে যা কিছু মোক্ষম তথ্যপ্রমাণ, সব চাপা দেওয়ার জন্য নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি, যা গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র, উভয়ের পক্ষেই ভয়ানক। মিথ্যার পর মিথ্যা সাজিয়ে ‘অভিযুক্ত’ (ভিলেন) ট্রাম্প দ্রুত নিজেকে সাজিয়ে তুললেন ‘অন্যায়ের শিকার’ (ভিকটিম)। কিন্তু তবু, প্রেসিডেন্টের স্বার্থ=দেশের স্বার্থ, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট=দেশ— রিপাবলিকানরা কেউ এই সমীকরণ অমান্য, অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করলেন না। রাষ্ট্রীয় অবমাননা ঢাকা পড়ে গেল দলবাধ্যতা ও ব্যক্তিগত চাওয়াপাওয়ার তলায়।
কী ভাবে তৈরি হল এই বিশাল ‘পার্টিজ়ান’ বা দলতান্ত্রিক ঐকমত্য? প্রথমত, অর্থমনর্থম্। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং কর্পোরেট লবির সখ্য ও পারস্পরিক আস্থা আজ এমন একটা পর্যায়ে যে এই অক্ষ ভেঙে উল্টো দিকে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো বুকের পাটা কারও নেই। কী করে থাকবে, নিজেদের অঞ্চলে কাজকর্মের জন্যও তো জনপ্রতিনিধিরা অর্থ-মুখাপেক্ষী হন, প্রভাব-প্রতিপত্তির দ্বারস্থ হন। সেই দিক দিয়ে বলা যায়, এখন যা দেখা যাচ্ছে, ধনতন্ত্র ও গণতন্ত্রের গাঁটছড়াটি এত শক্ত ভাবে বাঁধা হয়নি আগে কখনও!
দ্বিতীয়ত, অর্থের সঙ্গেই যুক্ত স্বার্থ। জনপ্রতিনিধিই হোন, আর হোয়াইট হাউসের কর্মীই হোন— এই পর্বে যাঁরা সামান্য পরিমাণেও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যাওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছেন, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে শাণিত অস্ত্র নিয়ে নেমেছেন ক্রোধোন্মত্ত প্রেসিডেন্ট, তাঁরা কেউই আর চাকরিক্ষেত্রে বা জীবনক্ষেত্রে নিরাপদ নন। যে হেতু ইম্পিচমেন্টের ভোট গোপন ব্যালটে হয় না, প্রতিনিধিরা সর্বস্ব পণের ঝুঁকিটি নেননি। সব দেখে মনে পড়ে যায় এডমন্ড বার্কের অমোঘ কথাটি— ‘‘দি ওনলি থিং নেসেসারি ফর দ্য ট্রায়াম্ফ অব ইভ্ল ইজ় ফর গুড মেন টু ডু নাথিং’’। ভাল লোকেরা কেউ কিছু না করলেই আর খারাপ লোকের বিশ্বজয় করতে কোনও অসুবিধে হয় না।
আসলে, ‘গণতন্ত্র’ যাঁরা তৈরি করেছিলেন, সকলে মনে করেছিলেন, একে রক্ষা করার দায়িত্বটা সকলের— কারও একার নয়। মার্কিন গণতন্ত্রও নিজেকে অন্যতম সেরা বলে মনে করেছিল এই ভেবে যে, তার জিয়নকাঠিটি আছে অনেকের হাতে একত্র ধরা, কারও একার হাতে নয়। একটা কথা কি তুলনায় কম ভাবা হয়েছিল এত দিন? ভাবা কি হয়েছিল— জ্ঞাত বা অজ্ঞাত কারণে ‘সকলে’, অন্তত বিরাট পরিমাণ ‘অনেকে’, যদি এক দিকে গিয়ে ‘একা’র সুরে সুর মিলায়, কে তবে বাঁচাবে সকলকে?
ট্রাম্প ঐতিহাসিক। অব্যর্থ নজরে তিনি গণতন্ত্রের ব্যবস্থার ফাঁকটি ধরে ফেলেছেন। অভ্রান্ত কৌশলে তা কাজে লাগিয়েছেন। দেশজোড়া ফাঁদ পেতেছেন, আধেক ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছে তাতে। বাকি আধেকও হয়তো পড়বে, পরের নির্বাচনটির অপেক্ষা শুধু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy