ছবি: সংগৃহীত
অন্ধকার গাঢ় হইয়াছে দিল্লিতে। তবু বিজেপির হিন্দু কাউন্সিলর যখন মুসলিম পরিবারকে নিজগৃহে আশ্রয় দেন, দলিতেরা রাত জাগিয়া মুসলিমদের ঘর পাহারা দেন, তখন এক অত্যাশ্চর্য দ্যুতি বিদ্বেষ-তমিস্রার সীমা দেখাইয়া দেয়। শিখরা আটটি গুরুদ্বারের দরজা উন্মুক্ত করিয়াছেন, দাঙ্গাসন্ত্রস্ত এলাকায় হিন্দু ও মুসলিম নাগরিকেরা একত্র মিছিল করিয়াছেন। এই প্রতিরোধ কোনও রাজনৈতিক নেতার আহ্বানে হয় নাই, প্রাণের ঝুঁকি লইয়াই হিংসার আস্ফালনের সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রতিবেশীকে রক্ষা করিতেছেন সাধারণ নাগরিক। তাঁহাদের নামের কৌলীন্য নাই, শিক্ষার গর্ব নাই, রাজনৈতিক শক্তি নাই। আছে কেবল সেই সর্বজনীন অথচ দুর্লভ বস্তুটি: মানবিকতা। বিদ্বেষের অন্ধকার হইতে এই আলোর উৎসার। মানুষই পারেন অপরের আবেগ-অনুভূতি অন্তরে অনুভব করিতে। এই ক্ষমতাই নৈতিকতার ভিত্তি, যাহা বুদ্ধিমান স্তন্যপায়ী জীবকে ‘মানুষ’ করিয়া তোলে। ইহাই সেই সম্পদ, যাহার মূল্য কেহ নির্ধারণ করিতে পারে না, কিন্তু যাহার দ্বারা সকল প্রার্থিত বস্তুর মূল্য নির্ধারিত হয়। দেশভাগ ও তাহার পরবর্তী সাত দশকে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা কম দেখে নাই ভারত, কিন্তু সেই অমূল্য সম্পদ হারায় নাই। বীভৎসতার বিবরণে চাপা পড়িয়াছে সেই সব কাহিনি, যেখানে অপরিচিতকে আশ্রয় দিতে জীবন বিপন্ন করিয়াছেন অগণিত মানুষ। বলিয়াছেন, ‘আমি থাকিতে তোমার ভয় নাই।’
কুটিল হিংসাকে রুখিয়া দেয় যে সহজ মানবিকতা, তাহার গল্প থাকিয়া যায় ব্যক্তিগত পরিসরে। হয়তো ইহার কুশীলবেরা ‘বলিবার মতো’ কিছু দেখিতে পান না। প্রতিবেশী আশ্রয় দিবে প্রতিবেশীকে, মানুষ বাঁচাইবে মানুষকে, ইহাই তো স্বাভাবিক। তাহা প্রচারের প্রয়োজন কী? মানবিক গুণগুলি লুকাইয়া থাকিতে চাহে বলিয়াই তাহার শক্তি বুঝে না শাসক। যাঁহারা ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গড়িতে চাহেন তাঁহাদের প্রকৃত লড়াই মুসলিমদের বিরুদ্ধে নহে। এই সহজ কর্তব্যবোধ, যাহার অপর নাম মানবিকতা, তাহাই আসল প্রতিপক্ষ। তাই হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের প্রতি যত নিষ্করুণ, ততই খড়্গহস্ত সেই হিন্দুদের উপর যাঁহারা মুসলিমবিদ্বেষে রাজি নহেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ (‘সেকুলার’) শব্দটি এখন প্রয়োগ হয় গায়ে কাদা ছুড়িবার ন্যায়। দাবি উঠে— অবিদ্বেষী মাত্রেই ভণ্ড। আশ্চর্য কী?
আশ্চর্য বরং ইহাই যে, ছয় বৎসর ধরিয়া রাষ্ট্রশক্তির প্রাণপণ চেষ্টাতেও বিদ্বেষবৃক্ষের শিকড় তেমন পোক্ত হইল না। অন্য ধর্মের মানুষ দেখিলেই ঘেউঘেউ চিৎকারে পাড়া হইতে তাহাকে খেদাইবার কাজটিকে লোকে ‘পবিত্র কর্তব্য’ মনে করিল কোথায়? করিলে দাঙ্গাকারীকে পাহারা দিবার জন্য পুলিশ মোতায়েন করিতে হইত না। মুসলিমের নাগরিকত্বে আঘাত হানিয়া হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ করিতে চাহিয়াছে মোদী সরকার। কার্যক্ষেত্রে এক ভিন্ন মেরুকরণ ঘটিল— সমতাবাদী ভারত বনাম আধিপত্যবাদী ভারত। যে ভারত সংবিধান আশ্রয় করিয়া, হিন্দু-মুসলিম পরিচয় ভুলিয়া, শাহিন বাগে, পার্ক সার্কাসে পঞ্চাশটি রাত জাগিল, তাহার শক্তি দেখিয়াই কি দিল্লি প্রাসাদকূটের ঘুম ছুটিয়াছে? এই হিংস্র আক্রমণ কি ফের বিদ্বেষ উস্কাইবার মরিয়া চেষ্টা? এই আক্রমণে বহু মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন। কিন্তু যত দিন একটিও হিন্দু পরিবার দরজা খুলিবে মুসলিমের জন্য, হিন্দুর শিশুকে রক্ষা করিবেন এক মুসলিম ব্যক্তি, তত দিন ভারত বাঁচিয়া থাকিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy