গত এক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে কেবল রাজধানী দিল্লির নহে, বৃহত্তর দেশের বাস্তব পরিস্থিতির উপর নানা দিক হইতে নূতন আলো পড়িয়াছে। সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন, এমনকি আদালত— বিভিন্ন ক্ষেত্র বা প্রতিষ্ঠানের যে বহুমাত্রিক স্বরূপ এই আলোকে উদ্ভাসিত, তাহাতে অল্প ভরসা এবং বিস্তর আশঙ্কার কারণ আছে। দুষ্টের দমনে প্রশাসনের বিপুল অনাগ্রহের পাশেই ইতস্তত দেখা গিয়াছে প্রতিবেশীর স্বাভাবিক মানবিকতার ছবি, আবার অন্যায়ের প্রতিকারের সুচেষ্টায় উদ্যোগী মানবাধিকার কর্মীদের সহৃদয় তৎপরতার জবাবে মহামান্য বিচারপতিরা জানাইয়াছেন: পরিস্থিতি এখনই এফআইআর— ফার্স্ট ইনফর্মেশন রিপোর্ট— গ্রহণের উপযোগী নহে। যাহার নিকট যে আচরণ প্রত্যাশিত, সে তেমন পথে চলিলে বিস্ময়ের কারণ থাকে না; শাসক দল ও তাহার নায়কদের/নায়কের দ্বারা চালিত প্রশাসনের কীর্তিকলাপ যত ভয়ানকই হউক, অপ্রত্যাশিত বলা চলিবে না। বিচারবিভাগের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রশ্ন থাকিয়াই যায়; দুঃশাসনের প্রতিকারে আদালতের নিকট নাগরিকের প্রত্যাশা আরও অনেক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক নহে কি? আদালতই হয়তো এই সংশয়ের নিরসন করিবেন, কাল না হউক, কোনও এক নূতন যুগের ভোরে।
কিন্তু বিরোধী শিবির? শাসকের অন্যায়ের প্রতিবাদ যাহাদের প্রথম কর্তব্য? তাহারা এই অন্ধকারে কী করিতেছে? নির্বাচনে জয়ী হইয়া রাজ্য সরকারের গদিতে ফিরিয়া আসিয়াছেন অরবিন্দ কেজরীবাল। নির্বাচনী প্রচারে তিনি অতি যত্নে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমালোচনা এড়াইয়াছিলেন। বেণি না ভিজাইবার কৌশল এখনও সমানে চলিতেছে। প্রথম পর্বে সেনা নামাইবার দাবি উচ্চারণ এবং হাসপাতালে আক্রান্তদের পরিদর্শন সারিয়া তিনি নীরব হইয়াছিলেন, অবশেষে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নানা সাহায্য ঘোষণা করিয়া পরবর্তী কর্তব্য সম্পন্ন করিয়াছেন, কিন্তু রাজধর্ম হইতে কেন্দ্রীয় সরকারের এই ভয়াবহ বিচ্যুতি বোধ করি তাঁহার নজরে পড়ে নাই। তাঁহার দলের বহুলপ্রচারিত জনসংযোগ ও সংগঠন থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টির বা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াইবার প্রত্যাশিত উদ্যোগ দেখা যায় নাই। কানহাইয়া কুমার বিষয়ে তাঁহার সিদ্ধান্ত সঙ্কেত দেয়, অতঃপর হয়তো বেণির সহিত মাথাও শুষ্ক থাকিবে। অন্য দিকে, কংগ্রেসের বিরলদর্শন সাংসদ রাহুল গাঁধী টুইট যোগে পবিত্র সংসদীয় কর্তব্য সারিয়াছেন, দলের ‘কার্যনির্বাহী’ সভাপতি সনিয়া গাঁধী সপারিষদ রাষ্ট্রপতি ভবনে নালিশ জানাইয়া আসিয়াছেন। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ময়দানে অবতীর্ণ হইবার আগে কংগ্রেস ব্রিটিশ শাসকদের নিকট আবেদন-নিবেদনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত ছিল, বোধ করি এখন তাহারা আবার সেই শিকড়ে ফিরিবার সাধনা করিতেছে। অবশিষ্ট বিরোধীদের মধ্যে বামপন্থীরা কিছুটা সক্রিয়, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও। কিন্তু তাঁহাদের সামর্থ্য সীমিত বলিলেও কম বলা হয়। অন্যরা, কংগ্রেসের মতোই, স্মারকলিপি জমা দিয়া ঘরে ফিরিয়া সম্ভবত ‘হিন্দু ভোট’ মাপিতেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভার বহন করিতেছেন ছাত্রছাত্রীরা, সংখ্যালঘু মানুষ, এবং নাগরিক সমাজের একাংশ, বিশেষত মানবাধিকারের সুরক্ষায় দায়বদ্ধ কিছু সংগঠন।
এই পরিস্থিতি গণতন্ত্রের পক্ষে স্বস্তির কারণ হইতে পারে না। নাগরিক সমাজের পরিচালনায় ‘দলহীন’ আন্দোলনের শক্তিতে শাসকের অনাচারের প্রতিরোধের প্রকল্প আদর্শ ও ভাবনার পরিসরে মূল্যবান, কিন্তু তাহাকে কার্যকর করিয়া তুলিবার জন্য সংগঠিত দলীয় রাজনীতি জরুরি। এই মুহূর্তে সেখানেই বড় রকমের ঘাটতি, বিশেষত সর্বভারতীয় পরিসরে। ইহার একাধিক কারণ রহিয়াছে, যেমন জাতীয় স্তরে প্রতিস্পর্ধী নেতৃত্বের অনটন, বিভিন্ন বিরোধী দলের পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাব, দলনেতাদের অনেকেরই নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ইত্যাদি। কিন্তু এই ঘাটতির গভীরে নিহিত রহিয়াছে একটি মৌলিক সঙ্কট। হিংস্র, সঙ্কীর্ণ ও অসহিষ্ণু হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী উদার ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের সহিত জনসাধারণের সামনে পেশ করিতে না পারিবার সঙ্কট। এই সঙ্কটের দায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দল-সহ, প্রতিষ্ঠানের। সেই দায় স্বীকার করিয়া যথার্থ উদার সহিষ্ণুতার আদর্শকে তুলিয়া ধরিতে পারিলে, অর্থনৈতিক সমতার সন্ধানী সর্বজনীন উন্নয়নের ভিত্তিতে সেই আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলে, তবেই গণতন্ত্রের শাপমুক্তির পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy