রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার (রেপো রেট) আবার কমিয়েছে। ন’বছরের মধ্যে এই হার এত কম কখনও হয়নি। ভবিষ্যতে সুদ আরও কমতে পারে, তার আভাসও আছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের নতুন নীতিপত্রে। এই প্রবণতা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। সুদের হার কমানোর জন্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপর অনেক দিন ধরে প্রচণ্ড চাপ দেওয়া চলছে। কিন্তু সুদের হার কমানোর পিছনে কতটা অর্থনীতির যুক্তি, কতটা নিছক স্বার্থসিদ্ধির তাগিদ? সদুত্তর দিতে হলে কিছু অপ্রিয় কথা বলতে হয়। যাঁদের তা বলার দায়িত্ব ছিল, সরকারি মহলের অর্থনীতির মানুষেরা, তাঁরা সরকারের গোসার ভয়ে মুখ বুজে আছেন, আর বিরোধী পক্ষ ভোটে কাবু। তাই দেখা যাক, সুদ কমানো কেন বহু মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর এবং এতে দেশেরও সামগ্রিক কোনও উপকার না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
প্রচলিত যুক্তি হল, সুদ কমালে লোকে বেশি খরচ করবে, উৎপাদন বাড়বে, জাতীয় আয়বৃদ্ধি হবে, জাতীয় আয়বৃদ্ধির হার বাড়বে। এখন, অর্থনীতির ছাত্রজীবনে এই কথাগুলো এই ভাবে লিখে দিলে শিক্ষকেরা আমাদের আহাম্মক বলতেন। কারণ এক বার জাতীয় আয় বাড়া আর জাতীয় আয়বৃদ্ধির হার বাড়া মোটেই এক কথা নয়। জাতীয় আয় আজ ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হল, সেটা বোঝা গেল, কিন্তু কালকে কী হবে, আবার সুদ কমাবেন, আবার আমি ধার করে একটা বাড়ি কিনব? আরও একটা সেলফোন কিনব? ঘটনা হল, শুধু আজ খরচ বাড়িয়ে এক বারের জন্য আয়ের খানিকটা বৃদ্ধি হতে পারে, কিন্তু আয়বৃদ্ধির হার তাতে বাড়বে কেন?
হ্যাঁ, যদি সুদের হার কমার ফলে বিনিয়োগের হার বাড়ে, তা হলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার বাড়বে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এ কথা লিখে লিখে হন্যে হয়ে গিয়েছেন যে, সুদ কমিয়ে দীর্ঘকালীন বিনিয়োগ বাড়ানো যায় না। তাই সুদ কমানোর সঙ্গে জাতীয় আয়বৃদ্ধির গতি বাড়ানোর কোনও সম্পর্ক নেই। আমাদের দেশেও নানা গবেষণায় এটা দেখা গিয়েছে। ব্যাঙ্ক ধার দিচ্ছে না বলে কর্পোরেট সেক্টর বিনিয়োগ করতে পারছে না— এটা দীর্ঘ কাল ধরে চালু একটা রূপকথা। টাকার অভাব বড় ব্যবসায়ীদের হয় না, তাঁরা মুনাফা দেখলে তবে বিনিয়োগ করেন।
এ কথা বলতেই হবে যে সম্প্রতি ব্যাঙ্কিং কোড নীতি এবং ধার শোধ না দিলে চটজলদি ডিফল্টার হয়ে যাওয়ার নীতির ফলে অনাদায়ী ঋণের ক্ষেত্রে সুবিধে হচ্ছে। বস্তুত, বিগত সরকারের এই নীতিগুলোই বলবার মতো। এখন, এর ফলে যদি ব্যাঙ্কের হাতে টাকা বেড়ে যায়, তা ধার দিতে হবে। অর্থনীতির অবস্থা যদি এমন হয় যে, বিনিয়োগ করলে যথেষ্ট মুনাফার সম্ভাবনা, সে ক্ষেত্রে সুদের হার কমালে ব্যবসায়ীদের ঋণের চাহিদা বাড়তে পারে। অর্থাৎ, সুদ কমিয়ে দেশের উন্নতি আনা যায় না, আর্থিক উন্নতি হতে শুরু করলে তাকে ত্বরান্বিত করার জন্য হয়তো সুদ কমানোর দরকার পড়ে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সুদ কমালে দীর্ঘমেয়াদি লাভ না হয় না-ই হল, কিন্তু ক্ষতিই বা কী? ক্ষতি বহু সাধারণ মানুষের। আমাদের মতো দেশে সাধারণ মানুষ সঞ্চয় করে ব্যাঙ্কে রাখেন আর বড়লোক ব্যবসায়ী ধার করে ব্যবসা করেন। সুদের হার কমলে বড়লোকদের সুবিধে, কারণ তাঁরা ধার নেন আর গরিবদের অসুবিধে, কারণ তাঁরা ব্যাঙ্ক মারফত ধার দেন। ফলে সুদ কমালে খুশি হন বড় ব্যবসায়ীরা, আর খুশি হন তাঁরা যাঁরা শেয়ার বাজার দাপিয়ে বেড়ান, অর্থাৎ অন্যের টাকা ধার করে সম্পদ বাড়ান। সুদ কমলে সাধারণ সঞ্চয়ী মানুষের ক্ষতি।
সরকার চাইছে সবাই ব্যাঙ্ক ছেড়ে বাজারে টাকা ঢালুক। যাঁরা ঝুঁকি নিয়ে শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতে চান, সুদ কমালে তাঁদের সঞ্চয় বেশি অনুপাতে শেয়ার বাজারে যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য বা ইচ্ছা অনেক কম। সঞ্চয়ে তাঁরা প্রধানত সুদ-নির্ভর। এটাও মনে রাখতে হবে, ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে নির্ভর করে সামাজিক সুরক্ষার উপর। যদি অসচ্ছল মানুষেরা জানতেন যে তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা আছে অর্থাৎ শিক্ষা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো কিছু মৌলিক ব্যবস্থা সরকার বিনা পয়সায় করে দেবে, যেটা ভদ্র সভ্য দেশে হয়ে থাকে, তা হলে তাঁরাও হয়তো ব্যাঙ্ক ছেড়ে শেয়ার বাজারে দৌড়তেন। কিন্তু ব্যাঙ্কের সুদ কমলেও এঁরা কম রোজগার আঁকড়ে বসে থাকবেন।
তা হলে? সুদ কমিয়ে যদি বিনিয়োগ, আয়বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের হার না বাড়ানো যায়, তবে তার উপায় কী? উপায় সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, তার সঙ্গে যথাসম্ভব শিল্প-বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যবস্থা করে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে উৎসাহ সৃষ্টি। এবং মানুষকে যথাসম্ভব সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া। যদি সুদ কমাতেই হয়, তা হলে দরকার বয়স্ক গরিব এবং মধ্যবিত্তদের প্রাপ্য সুদের হার না কমানো। এবং দরকার বড়, মাঝারি বা ছোট শিল্প বিনিয়োগ করলে কর ছাড় দেওয়া। এক সময় চিনে বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথম বেশ কয়েক বছর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর নেওয়া হত না। এ ছাড়া, বিদেশের বাজারে ভাল ফল করলে বিনিয়োগে বিশেষ সুবিধা দেওয়া যায়, যেমন করেছিল দক্ষিণ কোরিয়া। এই সবই ভাল নীতি। যে রোগী খানিকটা রক্তাল্পতায় ভুগছে, তাকে সস্তায় রক্ত জোগাড় করতে বললে লাভ হয় না। যা খেলে দেহে রক্ত তৈরি হয়, সেটা খেতে হয়।
তাই, সরকারকে বলি, দয়া করে আয়বৃদ্ধির হার নিয়ে চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবেন না। ভারত পৃথিবীর তুলনায় মোটামুটি ভালই করছে। অর্থনীতির শিক্ষাকে একটু গুরুত্ব দিন।
সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy