Advertisement
১১ জানুয়ারি ২০২৫

শৌরীন্দ্রনাথকে কি মুর্শিদাবাদ মনে রেখেছে?

শৌরীন্দ্রনাথের সৃজনশীল কাজ দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে স্থায়ী ভাবে শান্তিনিকেতনে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিছু দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়ে নিজেকে আরও দক্ষ ভাবে গড়ে তোলেন শৌরীন্দ্রনাথ। লিখছেন সৈয়দ খালেদ নৌমান কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শৌরীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি ১৯২৯ সালে সামতাবেড় থেকে শৌরীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন—‘‘শৌরীন, যখনি তোমার কবিতা পড়ি, কেবলই মনে হয়, যেন কার যাদুবলে হঠাৎই এই পৃথিবীর পর্দা সরে গিয়ে এই নিষ্পাপ আদিম পৃথিবী জেগে উঠেছে, আর তারই কোলে দাঁড়িয়ে অমৃতের সন্তানেরা যেন আবার আনন্দে বীণা বাজাচ্ছে।

কবি শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।

কবি শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৯ ০১:৩৯
Share: Save:

নীরবে চলে গেল রবীন্দ্রযুগের অন্যতম কবি শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিন কেন, জন্মদিনেও কবিকে স্মরণ করতে ভুলে গিয়েছি আমরা। কারণ, কবি বর্তমান সময়ে বিস্মৃত হয়ে গিয়েছেন। বিস্মরণের পথে ঠেলে দিয়েছি আমরা। যদিও এই অবহেলা ও অবজ্ঞা কবির প্রাপ্য ছিল না। শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর সমকালে এক জন বিশিষ্ট কবি হিসেবে বিশেষ খ্যাতি ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত আটটি কাব্যগ্রন্থ ছিল চার দশকের ফসল। ‘নির্মাল্য’ (১৯১১), ‘মন্দাকিনী’ (১৯১৬), ‘ছন্দা’, ‘পদ্মরাগ’ (১৯৩০), ‘বাংলার বাঁশী’ (১৯৩২), ‘বৃন্দা’, ‘হোমাগ্নি’ ও ‘বাঁশীর আগুন’ (১৯৫৮)।

কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শৌরীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি ১৯২৯ সালে সামতাবেড় থেকে শৌরীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন—‘‘শৌরীন, যখনি তোমার কবিতা পড়ি, কেবলই মনে হয়, যেন কার যাদুবলে হঠাৎই এই পৃথিবীর পর্দা সরে গিয়ে এই নিষ্পাপ আদিম পৃথিবী জেগে উঠেছে, আর তারই কোলে দাঁড়িয়ে অমৃতের সন্তানেরা যেন আবার আনন্দে বীণা বাজাচ্ছে। সেখানে যেন কোন দুঃখ নাই, কেবলই সুখ, আনন্দ ও শান্তি। তোমার কবিতায় আছে সেই দুঃখ, জরা, মরণহীন আনন্দলোকের বার্তা, আর তুমি মানুষের সেই দুঃখমুক্তির চারণ কবি।’’

শৌরীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে (বঙ্গাব্দ ২৬ মাঘ, ১২৯২) অখণ্ড বাংলার পাবনা জেলার বাগমারি গ্রামে, তাঁর মাতুলালয়ে। তাঁর পৈতৃক বাসভূমি ছিল পাবনারই কাওয়াখোলা গ্রামে। তাঁর পিতামহ রমানাথ সার্বভৌম বহরমপুরের কাছেই কাশিমবাজারে চলে আসেন। তিনি কাশিমবাজারের অকালপ্রয়াত রাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের পত্নী রানি স্বর্ণময়ীর এবং একই সঙ্গে ছোট রাজবাড়ির আন্নাকালী দেবীর সভাপণ্ডিত ছিলেন। শৌরীন্দ্রনাথের পিতা রমাপতি তর্কভূষণও ছিলেন মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর প্রধান সভাপণ্ডিত। সে কারণে শৌরীন্দ্রনাথ আশৈশব কাশিমবাজারেই মানুষ। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি এই কাশিমবাজারেই। পরবর্তী কালে তিনি সৈয়দাবাদ হার্ডিঞ্জ স্কুলে (বর্তমানে যা মণীন্দ্রচন্দ্র বিদ্যাপীঠ নামে পরিচিত) পড়াশোনা করেন। শৈশবে মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা রচনা করেছিলেন। ছবি আঁকার ঝোঁকও ছিল তাঁর আশৈশব।

শৌরীন্দ্রনাথের মধ্যে কবিপ্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল কাশিমবাজারেই। কিন্তু তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করলেও, এক জন চিত্রশিল্পী হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল। ১৯০৭ সালের নভেম্বরে (১৭-১৮ কার্তিক, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ) দু’দিন ধরে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ও অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষে সভাপতি মণীন্দ্রচন্দ্রের আমন্ত্রণে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কাশিমবাজার রাজবাড়িতে। এই সম্মেলনের মঞ্চসজ্জা এবং তোরণ নির্মাণের সমূহ দায়িত্বভার মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র অর্পণ করেছিলেন কবি ও শিল্পী শৌরীন্দ্রনাথের উপর। অপূর্ব সেই মঞ্চসজ্জার মাধুর্য এবং সুদৃশ্য সেই তোরণের শিল্পরূপ মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্রকে যেমন খুশি করেছিল, তেমনই তা মুগ্ধ করেছিল সম্মেলনে আগত অতিথি ও প্রতিনিধিদেরও। এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও ওই সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের রূপে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছিলেন। শৌরীন্দ্রনাথকে তিনি স্থায়ী ভাবে শান্তিনিকেতনে থাকার জন্য বিশেষ আমন্ত্রণ জানান এবং বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের সেই আমন্ত্রণ উপেক্ষা না করে, কিছু দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়ে নিজেকে আরও দক্ষ ভাবে গড়ে তোলেন তিনি। তবে কাশিমবাজারের টানে এক সময়ে ফের তিনি ফিরেও আসেন।

কবি শৌরীন্দ্রনাথের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মরাগ’ ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটিই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে সে সময়ে সবিশেষ প্রশংসিত ও আদৃত হয়। ‘পদ্মরাগ’ কাব্য তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। তাঁর বৈষ্ণব ভাবের কবিতার মধ্যে ‘শ্রীকৃষ্ণ’, ‘শ্রীরাধা’, ‘জন্মাষ্টমী’, ‘রসরাজ’, ‘নরনারায়ণ’ এই কবিতাগুলি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। শৌরীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘বাংলার বাঁশী’। ১৯৩২ সালে এটি প্রকাশিত হয়। শৌরীন্দ্রনাথ ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ‘মুর্শিদাবাদ বন্দনা’ শীর্ষক কবিতাটি রচনা করেন এবং এই কবিতা রচনার পর তিনি ‘মুর্শিদাবাদ বন্দনা-র কবি’ হিসাবে বিশেষ খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করেন। ওই বছরই ১৬ মে বহরমপুরে প্রাদেশিক প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই অধিবেশনে শৌরীন্দ্রনাথের ‘মুর্শিদাবাদ বন্দনা’ নামে কবিতাটিতে সুরারোপ করে গাওয়া হয়।

শৌরীন্দ্রনাথের কবিতায় রোমান্টিকতার প্রাচুর্য থাকলেও তিনি সমকালীন দেশ ও জাতির কথা ভুলে যাননি। জাতির অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদির কথা তিনি কবিতায় রূপায়িত করেছিলেন। শৌরীন্দ্রনাথের কবি-জীবনের শুরুতে স্বদেশ প্রেম ও স্বদেশ প্রীতির বীজ উপ্ত হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাঁকে প্রায় তিন বছর গৃহবন্দি থাকতে হয়। এই সময়েই তাঁর ‘নির্মাল্য’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তাঁর এই স্বদেশ চেতনা অনেক কবিতায় পরিলক্ষিত হয়। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বাঁশীর আগুন’ (১৯৫৮) স্বদেশ চেতনামূলক কাব্যের সংকলন।

১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনকালে সিপাহিদের প্রতি নানা অবিচারের প্রতিবাদে সারা দেশ জুড়ে সিপাহি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। বহরমপুরের সিপাহিদের মধ্যেও সেই বিদ্রোহের ঢেউ আছড়ে পড়ে। ব্যারাকের সিপাহিরা দলে দলে ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানে তাঁদের বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁদের উপরে ব্রিটিশ শাসকের দমন-পীড়ন চলে, অনেকেই শহিদ হন।

সিপাহি বিদ্রোহের শতবর্ষে ১৯৫৭ সালে শহিদ সিপাহিদের স্মরণে বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। এই স্মৃতি স্তম্ভের জন্যে শহিদ সিপাহিদের স্মৃতির উদ্দেশে কয়েক পংক্তি শ্রদ্ধার্ঘ রচনার অনুরোধ জানানো হয় কবি শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে। তিনি অসুস্থ অবস্থায়ও চার পংক্তির একটি শ্রদ্ধার্ঘ রচনা করে দেন, যা সেই স্মৃতিস্তম্ভে আজও শোভা বর্ধন করছে। কবিতায় রচিত সেই শ্রদ্ধার্ঘ হল—‘স্বপ্ন হেথা টুটেছিল মহা স্বপ্ন আঁকি/ জীবনের মহামন্ত্রে বেঁধেছিল রাখী/ পাষাণ শৃঙ্খল ভাঙি জাগিল যে নাম, / শতবর্ষ পরে আজি করিনু প্রণাম।’

কবি শৌরান্দ্রনাথের আরও একটি স্মরণীয় কবিতা ‘মুর্শিদাবাদ মা-কে’। ওই কবিতাটি কাশিমবাজারে থাকাকালীন শেষ কবিতা। কবির পত্নী বিয়োগের ফলে প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতা এবং অসুস্থতার কারণে ওই কবিতাটি রচনার কিছু দিন পরে একমাত্র কন্যা নমিতা চক্রবর্তীর কাছে কলকাতার ঢাকুরিয়ায় চলে গিয়েছিলেন। তার কয়েক মাস পরে ১৯৫৯ সালে (১৩৬৬ সালের ৮ ভাদ্র) কবি প্রয়াত হন।

অন্য বিষয়গুলি:

Poet Shourindranath Bhattacharya Murshidabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy