ছবি পিটিআই।
পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি তাহার জন্ম ইস্তক এত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখে নাই। বঙ্গোপসাগরে শতাধিক বৎসরে এমন প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় নাই। সেই ঝড় পশ্চিমবঙ্গকে তছনছ করিয়া দিয়াছে। অর্থাৎ ইতিহাস এবং সাধারণ জ্ঞান উভয়ই বলিতেছে, বর্তমান রাজ্যপাল যাহাকে ‘ন্যূনতম’ ক্ষতি বলিয়াছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহার মাপ আক্ষরিক অর্থে কল্পনাতীত। তিন লক্ষ হেক্টর কৃষিজমির ক্ষতি হইয়াছে। রাজ্য সরকারের একটি সূত্রের হিসাব, যত ধান চাষ হইয়াছিল, তাহার মাত্র ত্রিশ শতাংশ কাটা শেষ হইয়াছিল— বাকি ফসল মাঠেই ছিল। ঝড়-জলে তাহা শেষ। পানের বরজ হইতে আনাজের ক্ষেত, মাছের ভেড়ি হইতে ফলের বাগান, আমপানের রোষে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্র সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। কয়েক লক্ষ বাড়ি ধূলিসাৎ। স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সব পরিকাঠামোরই বিপুল ক্ষতি হইয়াছে। রাস্তা নষ্ট হইয়াছে, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়াইয়াছে। ক্ষতির মোট আর্থিক পরিমাণ কত, পাকা হিসাব মিলিতে এখনও সময় লাগিবে। কিন্তু, অভিজ্ঞ সূত্রের মত, মুখ্যমন্ত্রী যে অঙ্কটি বলিয়াছেন, সেই এক লক্ষ কোটি টাকা মোটেও অবাস্তব সংখ্যা নহে। একটিই ইতিবাচক কথা— এত বড় ঝড়ে প্রাণহানির সংখ্যা তুলনায় কম।
আমপানের এই ধ্বংসলীলাকে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ বলা হইবে কি না, সেই তর্কের সময় এখন নহে। এই মুহূর্তে প্রধান কর্তব্য হইল এই কথাটি বোঝা যে পশ্চিমবঙ্গের সাহায্য প্রয়োজন। যত বেশি সাহায্য পাওয়া সম্ভব, ততই ভাল। কারণ, এই মুহূর্তে রাজ্যটিকে কার্যত নূতন ভাবে গড়িয়া তুলিতে হইবে। যে বিপুলসংখ্যক মানুষ গৃহহীন, তাঁহাদের বাড়ির ব্যবস্থা করিতে হইবে। যাঁহারা জীবিকা হারাইয়াছেন, তাঁহাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। শুধু কৃষির ক্ষতির পরিমাণটি দেখিলেই বুঝা সম্ভব, সেই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা কত কঠিন। তাহার উপর, ধ্বংস হওয়া পরিকাঠামো ফের গড়িয়া তুলিতে হইবে। এবং, একই সঙ্গে স্মরণে রাখিতে হইবে, দুই মাসব্যাপী লকডাউন রাজ্যের অর্থনীতিকে, মানুষের আর্থিক সামর্থ্যকে দুর্বল করিয়াছে। ফলে, এখন পশ্চিমবঙ্গের অর্থসাহায্য প্রয়োজন। যত বেশি পাওয়া যায়, যত দ্রুত পাওয়া যায়, ততই ভাল। তাঁহার শেষ টেলিভিশন বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলিয়াছিলেন, ২০০১ সালের ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত গুজরাতকে কী ভাবে কার্যত নূতন করিয়া গড়িতে হইয়াছিল। অতএব, এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের ঠিক কী চাই, তাঁহার জানিবার কথা। রাজনৈতিক বিবাদ ভুলিয়া, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন ভুলিয়া এখন সর্বশক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পার্শ্বে দাঁড়ানোই একমাত্র কর্তব্য।
নবীন পট্টনায়ক যেমন দাঁড়াইয়াছেন। তাঁহার রাজ্য বারংবার প্রকৃতির রোষের শিকার হয়। ফলে, তিনি জানেন, এই বিপর্যয়ে বাহিরের সাহায্যের গুরুত্ব কতখানি। তাঁহার ৫০০ উদ্ধারকর্মীকে পশ্চিমবঙ্গে প্রেরণ এবং অন্যান্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতির কথা পশ্চিমবঙ্গ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করিবে। ভারতের অন্য রাজ্যগুলিও যাহাতে পশ্চিমবঙ্গের দিকে সাহায্যের হাত বাড়়াইয়া দেয়, তাহার উদ্যোগ করিবার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে লইতে হইবে বইকি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই ঝড়ের খবরকে যতখানি গুরুত্ব দিয়াছে, তাহাতে বোঝা যায়, বিদেশে এই বিষয়ে সচেতনতা যথেষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সেই আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়া সম্ভব। তাহার ব্যবস্থা করাও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তব্য। তাঁহারা দুইটি কথা স্মরণে রাখিতে পারেন। এক, পশ্চিমবঙ্গের পুনর্গঠন শুধু এই রাজ্যের স্বার্থেই নহে, গোটা দেশের স্বার্থে প্রয়োজন। ফলে, তাহার জন্য সর্বভারতীয় স্তরেই উদ্যোগ জরুরি। এবং দুই, এই বিপর্যয়ও যদি তাঁহাদের রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার বাহিরে না আনিতে পারে, ইতিহাস তাঁহাদের ক্ষমা করিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy