Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Cyclone Amphan

দাওয়াই যত শক্তিশালী হবে, ততই ক্ষত দ্রুত মেরামত হবে

বিজ্ঞান গবেষণা হোক বা সীমান্তে পাহারা দেওয়া, কোনওটাই খালি পেটে সম্ভব নয়। ফলে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা বজায় রাখতে এবং রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের ভারসাম্য রাখতে এই প্রান্তিক মানুষগুলির পাশে থাকা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই ছবিটা অবশ্য নতুন নয়। ওড়িশায় ২০১৩ সালে পাইলিন এবং ২০১৯ সালে ফণী, এই দু’টি ভয়ঙ্কর প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘কভার’ করার সূত্রে দেখেছি, গোটা মাঠের উপর দিয়ে যেন কেউ বুলডোজ়ার চালিয়ে দিয়েছে।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০২০ ২২:১৯
Share: Save:

সামনে বয়ে চলা ডাঁসা নদী। পিছনে বিস্তৃত পুকুর, চাষের মাঠ। যেন প্রকৃতির মাঝেই ঘর বেঁধেছিলেন রঞ্জিত সিংহ, রমাপদ হাউলি, চন্দ্রশেখর মণ্ডলেরা। কিন্তু সে সব এখন পুরোই স্মৃতি।

ঘূর্ণিঝড় আমপানের ধাক্কায় বাঁধ ভেঙে বাড়ি ভেঙেছে। আদিগন্তবিস্তৃত নোনা জলের তলায় কোনটা যে নদী, কোনটা চাষের খেত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ত্রাণ মিলছে বটে। কিন্তু সে সব আর ক’দিন। তার পরে কী ভাবে পেট চলবে জানেন না মানুষগুলো।

আমপানবিধ্বস্ত হাসনাবাদের ঘুণি গ্রামের বাসিন্দা সৌরভ মণ্ডল আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘‘মাটিতে নুন ধরে গিয়েছে। নোনা কাটিয়ে মাঠে চাষ করতে আগামী দু’-তিন বছর লাগবে।’’

উপকূলীয় এলাকাগুলি না-হয় নোনা জলের তলায় গিয়েছে। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনার বাকি এলাকা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমানের মতো ভাগীরথী-হুগলি লাগোয়া এলাকার জমিও তো অতিবৃষ্টি-ঘূর্ণিঝড়ে জলের তলায়। একরের পর একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। সেখানেও ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই ছবিটা অবশ্য নতুন নয়। ওড়িশায় ২০১৩ সালে পাইলিন এবং ২০১৯ সালে ফণী, এই দু’টি ভয়ঙ্কর প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘কভার’ করার সূত্রে দেখেছি, গোটা মাঠের উপর দিয়ে যেন কেউ বুলডোজ়ার চালিয়ে দিয়েছে। ২০১৯ সালে ওড়িশায় প্রায় প্রায় দেড় লক্ষ একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল বলে প্রশাসন জানিয়েছিল। আমপানে এ রাজ্যের অবস্থাও তথৈবচ। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চাষিরা ধারকর্জ করে চাষ করা শুরু করেন। ফলন ভাল হলে ফসল বিক্রির টাকায় ধার শোধ করেন।

কিন্তু ফসলের আগেই যদি এমন দুর্যোগ আসে, তা হলে উপায় কী?

উপায় কী, সেটা জানার আগে একটু ক্ষতির ধরন জেনে নেওয়া যাক। যেহেতু ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ বহু আগে বলা সম্ভব নয় (এ ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন, এখন ঘূর্ণিঝড় হামলে পড়ার বেশ কিছু দিন আগে থেকে আবহাওয়া দফতর নির্দিষ্ট এবং নিখুঁত পূর্বাভাস দেয়। তার ফলে এ বারও বহু জমির বোরো ধান কেটে গোলা ভর্তি করা গিয়েছে), ফলে এই বিপদের কথা মাথায় রেখেই চাষ করতে হয় এবং প্রবল বেগে ঝড় ও অতিবৃষ্টির ফলে ফসল নষ্ট হয়।

নষ্ট হওয়া ফসলের মধ্যে বোরো ধান তুলনামূলক ভাবে কম। বেশি রয়েছে আনাজপাতি এবং ফল। ধান পেকে যাওয়ায় তড়িঘড়ি কেটে নেওয়া গিয়েছে। কিন্তু আনাজ ও ফসলের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয়নি। পটল, ঢেঁড়স, লঙ্কার মতো বহু আনাজের ক্ষেত্রেই এক বারে কেটে ফেলা হয় না। বরং নিয়মিত পরিপক্ক ফসল তুলে হাটে পাঠাতে হয়। দ্বিতীয়ত রয়েছে কলা, আম। মোচা থেকে কলা হয়ে পাকতে সময় লাগে। ফলে সেগুলি আগেভাগে নামানোর উপায় ছিল না। আম, জাম, কাঁঠালের মতো গাছে বছর-বছর ফল ধরে। গাছ ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে চারা লাগিয়ে তা বড় করা সময়সাপেক্ষ।

এ তো গেল উপকূল থেকে ভিতরে থাকা জেলাগুলির কথা। উপকূলীয় জেলাগুলির ক্ষেত্রে সেই পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর। নোনা জল দীর্ঘদিন জমিতে আটকে থাকায় জলের লবণতা মাটিতে মিশে গিয়েছে। ঠিক ২০০৯ সালে আয়লার ক্ষেত্রে যেমন হয়েছিল। গোসাবা ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মাটির কয়েক ফুট গভীরেও লবণতা ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন মাছের ভেড়িতেও নোনা জলের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। বহু মানুষ বাড়িতে ছাগল, মুরগি পুষতেন। সেগুলিও অনেকাংশ মারা গিয়েছে বা ভেসে গিয়েছে। এ সবের পরে সর্বোপরি মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মতো রয়েছে করোনা বিপদ এবং তদ্বজনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট।

আয়লার পরে দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার প্রান্তিক এলাকাগুলি থেকে বহু মানুষ শ্রমিক বা দিনমজুরের কাজ খুঁজতে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। জমি-পুকুর কয়েক বছর পরে থাকলেও দু’মুঠো অন্নের সংস্থান হয় তো করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আমপানের ধাক্কা সামলানোর পরে সেই রাস্তা কবে খুলবে বা কতটা খুলবে তা-ও অজানা। ফলে নিজেদের ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে হবে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, কী ভাবে বাঁচবেন ওঁরা? প্রশ্নটি যে খুবই সঙ্গত এবং প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে গোড়াতেই যে শর্তপূরণ প্রয়োজন, তা হল সরকারি সাহায্য। এই বিপদের দিনে প্রান্তিক মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য। হাসনাবাদ এলাকায় গিয়ে দেখা হয়েছিল পশ্চিম বঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক মিলন গাইনের সঙ্গে। কথায়-কথায় মিলনবাবু বলছিলেন, ‘‘এই মানুষগুলি চাষ করে খাবার তৈরি করেন বলেই আমরা নিশ্চিন্তে পড়াশোনা বা কাজ করতে পারি। যদি নিজেদের খাবার নিজেদের উৎপাদন করার চিন্তা মাথায় থাকত, তা হলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষক তৈরি হত না। কাজেই এই মানুষগুলিকে বাঁচানো দরকার।’’

তাঁর কথার সূত্র ধরেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব উঠে আসে। বিজ্ঞান গবেষণা হোক বা সীমান্তে পাহারা দেওয়া, কোনওটাই খালি পেটে সম্ভব নয়। ফলে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা বজায় রাখতে এবং রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের ভারসাম্য রাখতে এই প্রান্তিক মানুষগুলির পাশে থাকা প্রয়োজন। ফণীর পরে ওড়িশা সরকার কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও ভরতুকির প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। এখানেও কৃষি-ঋণ এবং আনুসঙ্গিক প্যাকেজ প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজনে বিকল্প আয়ের সংস্থান করা প্রয়োজন। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, অনেক ক্ষেত্রেই খানকয়েক হাঁস, মুরগি, ছাগল কিংবা ভেড়ার ছানা দিয়ে বলা হয়, বিকল্প আয়ের সংস্থান করা হল। কিন্তু কী ভাবে তা পালন করতে হয়, ওই পশুপাখি বড় হলে কোথায় তা ন্যায্য দামে বিক্রি করা যাবে, সে সব বহু ক্ষেত্রেই অন্ধকারে থাকে। কিন্তু বিপর্যস্ত মানবগোষ্ঠীকে বাঁচাতে হলে এই পুরো প্রক্রিয়াতেই একটি প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য প্রয়োজন। তা না-হলে বিকল্প কর্মসংস্থানের বদলে বিষয়টি নেহাত অনুদান বা ‘ডোল’ হিসেবেই রয়ে যাবে।

তবে এর পাশাপাশি দায়িত্ব রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলিরও। মনে রাখতে হবে, যে গাছের শিকড় যত মজবুত, তাকে টলানো তত কঠিন। ডালপালা ভেঙে গেলেও ফের নতুন ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে জানে সে। তেমন ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষজনকে নিজেদের শিকড় সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সুন্দরবনে একদা নোনা জল, মাটি সইতে পারে এমন প্রজাতির ধান (হ্যামিলটন, দুধেশ্বর, মাতলা, তালমুগুর, নোনা খরিষ) চাষ হত। কিন্তু পরবর্তী কালে উচ্চফলনশীল সংকর প্রজাতির ধান চাষে সেই সব প্রজাতি হারিয়ে গিয়েছিল। আয়লার পরে মাটি নোনা হয়ে যাওয়ায় ফিরে এসেছিল সাবেক চালের বীজেরাই। তা দিয়েই ফের লাভের মুখ দেখেছিলেন চাষিরা। এ বারেও দুর্গত এলাকার মানুষজনকে চাষের ক্ষেত্রে নতুন ভাবে ভাবতে হবে।

সব শেষে বলা যায়, বারবার ঘূর্ণিঝড় সয়েও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন গরিব মানুষ। ইতিহাসই তার সাক্ষী। কিন্তু তার যন্ত্রণা উপশমে দাওয়াইয়ের কাজ করে সরকারি বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাহায্য-অনুদান। দাওয়াই যত শক্তিশালী হবে, ততই ক্ষত দ্রুত মেরামত হবে। এবার আমপান বিধ্বস্ত মানুষের কাছে সেই দাওয়াই কত দ্রুত এবং কতটা জোরালো ভাবে পৌঁছোয়, সেটাই এখন দেখার।

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Amphan Cyclone Agriculture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy