বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘোর ঘনঘটা’’— গিরিশ ঘোষ রচিত সেই অমর বিলাপই আজ বার বার মনে পড়ছে। আজ কত দিন হল চলছে করোনাপ্রসূত অতিমারির অব্যাহত অভিযান, প্রতি দিন টেলিভিশনের পর্দায় দেখি পরিযায়ী শ্রমিকের চূড়ান্ত দুর্দশা, তারই মধ্যে ফুঁসে উঠল বঙ্গোপসাগরের বুকে এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়, ইংরিজিতে যাকে বলে ‘সুপার-সাইক্লোন,’ নাম আমপান (নামটি, যত দূর জানি তাইল্যান্ডের দেওয়া)। শহুরে বাঙালির এ নিয়ে জানার কোনও কারণ নেই, কিন্তু বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সাইক্লোনের সম্পর্কটি পুরনো। বিষণ্ণ মুখ্যমন্ত্রীর মুখেই শুনলাম ১৭৩৭ সালের সাইক্লোনের কথা। এক হিসেব অনুযায়ী, সেই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ মারা যান ও ধ্বংস হয় কুড়ি হাজার জাহাজ ও নৌকো। বস্তুত ইংরিজি ‘সাইক্লোন’ শব্দটার জন্মই কলকাতায়। ১৮৪০-এর দশকে, খুব সম্ভবত ১৮৪৮ সালে, হেনরি পিডিংটন নামে এক সাহেবের হাতে। তিনি বাণিজ্যপোতের কাপ্তেন হিসেবে কলকাতা এসেছিলেন। বঙ্গোপসাগরের ঝড় ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ে গবেষণায় তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ, তাঁর নানান গবেষণা নিয়েই আজকাল গবেষণা হয়। সাপের কুণ্ডলী পাকানো আকৃতিকে গ্রিক ভাষায় বলা হয় ‘কুকলস’, সেই শব্দটি অবলম্বনেই তিনি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিলেন ‘সাইক্লোন’। এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত পিডিংটন সাহেবের রচনাগুলো দেখলে বোঝা যায়, বঙ্গোপসাগরে বেশ ঘন ঘন ঘূর্ণিবাত্যা হত। আমপান কিন্তু আরও বেশি কিছু— ‘সুপার-সাইক্লোন’। ‘সুপার-সাইক্লোন’-এর বাংলা নাম কী হবে? কটক থেকে ফণী-ভুক্তভোগী এক বন্ধু জানালেন, ওঁরা ওড়িয়া ভাষায় বলেন ‘মহাবাত্যা’।
যেটা ভাবায় তা হল এই যে, বেশ কিছু দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরের জলের উপরিভাগের তাপমাত্রা বাড়ছে ও তার ফলে এই সব ঘূর্ণিঝড় আরও শক্তিশালী ও ঘন ঘন হবে। আমপান হয়তো ভবিষ্যতের ইঙ্গিতই দিয়ে গেল। ফলে এই যে মাঝে মাঝে বলা হচ্ছে যে এ রকম একটা ঝড় একশো বছরে এক বার হয়, সেই হিসেবটা হয়তো আর কাজে না-ও লাগতে পারে। লোভী ও বড়লোক দেশ— শুধু দেশ নয়, মানুষেরাও— তাদের শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদির প্রসার করে পাহাড়-নদী-খালবিল-জঙ্গল ধ্বংস করেছে, মায় সমুদ্রেরও অনেক ক্ষতি করেছে। অনেক দূরে বা যাই কেন? রাজস্থানে আরাবল্লি পর্বতমালায় ৩১টি পাহাড় ‘হারিয়ে যাওয়ার’ কথা তো ভারতীয় কাগজেই পড়েছি। আর নদীর বুক চিরে বালি-ডাকাতির কথা আমরা কে না জানি? এরই ফলে আজ আশ্রয়হীন বন্য প্রাণীর শরীর থেকে নানান নতুন ও সাংঘাতিক সব অসুখ মানুষের শরীরে ঢুকছে। বন্য প্রাণীর শরীর থেকে আসা তেমনই একটি ভাইরাস এই করোনাভাইরাস। তারই সৃষ্টি এই অতিমারি, যার সমাধানসূত্র আজও আমাদের হাতে আসেনি। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অন্য একটি প্রকাশ মহাবাত্যার শক্তি ও সংখ্যাবৃদ্ধিতে। তবে সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়া ও ঘূর্ণিঝড় শক্তিশালী হওয়াটা এক অদৃশ্য শক্তির ফল। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ জলবায়ুর সঙ্কট। তার পিছনে মূলত আছে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রয়োজনীয় এনার্জির সন্ধানে ফসিল-জ্বালানির ব্যবহার।
এগুলো পৃথিবীর সমস্যা। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা এমনকি ভারতও পৃথিবীর বাইরে তো নয়, আর তারা একা কী করবে? অথচ এই সব গ্লোবাল সমস্যারই আজ দাম দিচ্ছি, তা সে করোনাই বলুন আর আমপানই। খবরে পড়ছি পশ্চিমবঙ্গে সাত-আটটি জেলা বিধ্বস্ত, দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগনায় জীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। এমনকি বহু জেলায় সংযোগব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। ক্লান্ত, ব্যথিত মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে শুনছি এক মর্মভেদী বিলাপের সুর: ‘সর্বনাশ হয়ে গেল।’ ভাবি, বস্তিতে বা গ্রামে কাঁচা ঘরে থাকেন যে সব মানুষ— যাঁদের খেত, খেতের ফসল গিয়েছে নষ্ট হয়ে, ঘরের দেয়াল গিয়েছে ধসে বা আর মাথার ওপর কোনও চালা নেই, তাঁদের কী অবস্থা? মৃত্যুর সংখ্যা তুলনায় কম। সরকারি তৎপরতায় প্রাণে বেঁচেছেন অনেকেই। কিন্তু এ বারে তো ভাইরাস ব্যাকটিরিয়ার মোচ্ছব শুরু হওয়ার আশঙ্কা। এ বারে কি করোনা ও কলেরার আক্রমণ এক সঙ্গে চলবে? এক ধাক্কায় তিন ধাক্কা দিয়ে গেল আমপান? গরিব মানুষের কপালে কি শুধুই এই?
কলকাতার বন্ধুরা— যাঁদের ফোনে পাচ্ছি বা যাঁরা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করতে পারছেন— অনেকেই বলছেন এমন ভয় তাঁরা কোনও দিন পাননি। ছাদ থেকে ঢল নেমে ঘরে জল ঢুকে এসেছে, কেউ খাটে বসে নিরুপায় দেখছেন ঘর ভরা জলে তাঁদের হাওয়াই চপ্পল ভাসছে! কারও বাড়ির কাচের জানলা ভেঙে গেছে, বা বাড়ির অন্য কোনও অংশ উড়ে গেছে। বাড়ির পাশের বস্তির ছবি পাঠিয়েছেন কেউ, সেখানে মানুষ আরও বেশি অসহায়। কোথাও দেখছি ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে। বন্ধুরা কেউই ঝড়ের আওয়াজ ভুলতে পারছেন না। এক বন্ধু বললেন, ‘এই রকম আওয়াজ কোনও দিন শুনিনি। এই ঝড় যেন ছিল এক দানোর মতো বিশাল, ক্রুদ্ধ, মত্ত কোনও জন্তু।’ কেউ ভয় পাচ্ছিলেন, ঝড় বুঝি সত্যি ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে যাবে। পাঠানো ছবি থেকে চেনা শহরটাকে আমরাও চিনতে পারছিলাম না। বিবেকানন্দ রোড এক বহতা নদী। অতি প্রিয় ও পরিচিত কলেজ স্ট্রিটে জল থইথই শুধু নয়, সেই জলে ভাসছে ছেঁড়া বইয়ের পাতা। পার্ক স্ট্রিট, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ভরা ঝড়ে-ওপড়ানো বড় বড় গাছ। তাদের ছড়ানো ডালপালা ও পাতার সম্ভারে জীবনের স্বাদ ও স্মৃতি, আর তাদের জোর করে উপড়ে-তোলা শেকড়ে ঝড়ের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন। সবার মুখেই একটা অনিশ্চিতির ছাপ। কবে শহর চালু হবে? তত দিন কী ভাবে চলবে? শহরের সচ্ছল মানুষও দিশাহারা।
দেখলে মনে হয় যেন একটা গোটা সমাজই এলোমেলো, অবিন্যস্ত করে দিয়ে চলে গিয়েছে ঝড়। এই যে পড়ছি কলকাতা শহরেই কমবেশি পাঁচ হাজার গাছ পড়ে গেল, সেই সব গাছের তো একটা সামাজিক জীবনও ছিল। আমাদের শহরে রাস্তার গাছ কখনওই শুধু গাছ নয়, তাদের ঘিরে মানুষের জীবনযাত্রা গড়ে ওঠে— গাছের নীচে বসার বেদি, বা সিঁদুর-মাখানো পাথর বসিয়ে ছোট্ট একটি মন্দির। অথবা কোনও চায়ের দোকান। গাছের সঙ্গে সঙ্গে শহরের সেই জীবনও আজ ঘরছাড়া হল। মানুষেরই এই অবস্থা দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না, পশুপাখিদের কী অবস্থা সহজেই অনুমেয়। গাছগুলোতে যে সব শহুরে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী ও অন্য প্রাণী বাস করত, তারা এখন কোথায়? রাস্তার অন্যান্য পশুরা? সুন্দরবনের পশুপাখি, বাঘ? এই সব প্রাণীদের মৃত্যুর কোনও অভিঘাত কি মানুষের ওপর পড়বে? এই যে শুনি লকডাউনে আকাশ পরিষ্কার হচ্ছিল কলকাতার, নতুন নতুন পাখি আসছিল, তারা এখন এলে কোথায় বসবে? এ কোনও শৌখিনতার প্রশ্ন নয়, ডাক্তারি শাস্ত্রে এটা প্রমাণিত সত্য যে জীববৈচিত্র মানুষের মন ভাল রাখে।
বলা বাহুল্য, আগামী দিন ও মাসগুলোতে ত্রাণের প্রশ্নটাই সবচেয়ে জরুরি। এত গরিব মানুষ তাঁদের জীবন ও জীবিকা থেকে উৎখাত হয়েছেন যে তাঁদের পুনর্বাসনই, তাঁদেরকে তাঁদের জীবন আবার গড়ে তুলতে মদত দেওয়াই আমাদের সবার প্রাথমিক কর্তব্য। স্বাস্থ্যের দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ— অতিমারির বিপদ মোটেই যায়নি। শুধু ভয় হয়, সামনে ভোট তো, তাই এই মানুষগুলোর জীবন নিয়েও আবার রাজনীতি না হয়, বিশেষত, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।
এ তো গেল আশু সমস্যার কথা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তথা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বকে এটাও ভাবতে হবে যে, আজ বিশ্বজোড়া মনুষ্যসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে যদি আমাদের থাকতেই হয়— অর্থাৎ যদি আরও অতিমারি আর সুপার-সাইক্লোন আসে, এবং সত্তর কি একশো বছরের হিসেবে নয়, তার অনেক আগেই— তা হলে আমাদের কি কোনও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির প্রশ্ন আছে? না কি আমরা ঢেউয়ের মুখে খেলনার নৌকোর মতোই শুধু ভাসব, জীবন একটা লটারি হয়ে থাকবে?
ইতিহাস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy