দুরন্ত শৈশব। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
নানা অভিজ্ঞতায় এগিয়ে চলেছে জীবন। কিছু ভাল, কিছু মন্দ। জানি এ ভাবেই চলে। তবু প্রশ্ন জাগে আগেও কি এত বৈচিত্র্য ছিল অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। উত্তর খোঁজা শুরু হয়। ফিরে তাকাই শৈশব কৈশোরের সাদামাটা দিনগুলিতে। জীবন যখন প্রায় বাঁধাধরা চেনা সরলরেখায় অতিবাহিত হত। পরিবার ছিল একান্নবর্তী। ‘আমার’ শব্দের খুব বেশি ব্যবহার ছিল না, ছিল ‘আমাদের’— কথায় ও কাজে। বাড়ির পুরুষরেরা বাইরের জগৎ সামলাতেন আর মহিলারা যৌথ ভাবে বাড়ির ভিতর। ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা নয়। তবে এই চেনা ছন্দেই বেড়ে উঠত বাড়ির ছোটরা। এক সাথে কাকা, জ্যাঠার ছেলেমেয়েরা সবাই মিলে। পোশাকি নাম যার—যৌথ পরিবার।
সেদিনের বেড়ে ওঠায় খুব বেশি চমক, জাঁকজমক ছিল না। প্রাতরাশে থাকত না কোনও বিদেশি আহার। সাদামাটা মুড়ি, অন্তত গ্রামের মানুষের প্রাতরাশ সারা হতো মুড়ি দিয়েই। তার পরেই যে যার কাজে লেগে পরা। বড়রা বড়দের মত। ছোটদের পড়া। তারপর স্কুল। ফিরে অবশ্যই মাঠে। সন্ধ্যেয় হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসা। নিজের অজান্তেই বইয়ের খোলা পাতায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরা। মাঝে মাঝে ভাইবোনের খুনসুটি। তখনই ভাব তখনই আড়ি— সব নিয়ে শৈশবের বেড়ে ওঠা। এই আপাত আটপৌরে জীবনের মাঝেই খুব সুক্ষ্মভাবে যে বিষয়টি গাঁথা হয়ে যেত মনের মধ্যে, তা বোধহয় ‘বোধ’, ‘চেতনা’। কোনও পরিবারেই মা, কাকিমা, জেঠু, জেঠিমা, দাদু, ঠাকুমা কেউ আলাদা করে বোধের পাঠ দিতেন বলে তো জানা নেই। তবু কী সহজ ভাবেই কিছু চেতনা, কিছু বোধ ক্রমে গড়ে উঠত প্রায় সকল ছোটর মনে। ~আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও@ নীতিতেই হয়তো বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা। এর সুফল শুধু ছোটরা কুড়োয়নি, ভোগ করেছে সমগ্র সমাজ।
শিশুরা চিরসরল। প্রাণচঞ্চল। তাদের মধ্যে আচরণগত ভিন্নতা দেখা যায় তার পরবর্তী কালে। খুব কাছ থেকে অসংখ্য কৈশোর ও যৌবনেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বেশ কিছুটা তারতম্য দেখা যায় এ সময়। সমবয়সি একটা শ্রেণিকে দেখা যায় অত্যন্ত নম্র, বিনয়ী। অবশ্য নম্রতা বলতে আমরা অনেক সময় বুঝি (ঠিক বা ভুল যাই হোক না কেন) বড়দের সব কথা মেনে চলা। আমি সে নম্রতার কথা বলছি না। সঠিক ও সত্যকে গ্রহণ করেও, প্রয়োজনে সে সত্যের প্রকাশে বলিষ্ঠতা রেখেও আচার ব্যবহারটুকু যেখানে কোমল, প্রশান্ত—সেই নম্রতার কথাই বলতে চাইছি। তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। অন্য দিকে আর একদল কৈশোর যৌবন, যারা নিজেদের কর্তব্য-কাজ বিষয়ে একেবারেই সজাগ নয়। এমনকি আচরণেও নম্রতা, বিনয় চোখে পরে না। অবজ্ঞা, অসম্মান প্রদর্শনেই যেন আনন্দ। কর্মসূত্রে বা চলতে পথে যখন এ সব চোখে পরে, ভয় হয় অজানা আশঙ্কায়।
এখানেই প্রশ্ন এসে যায় ওদের মাথার ওপর বড় সেজে থাকা সমস্ত স্তরের অভিভাবকত্বের উপরে। পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ— সমস্ত স্তর। এ দায় কি আমরা কেউ এড়িয়ে যেতে পারি? অবুঝ ঔদ্ধত্যের আঘাত মনে ব্যথা দিলেও মন ভারাক্রান্ত হয় এই ঔদ্ধত্যের মূলের কথা ভেবে। যেটাকে অনায়াসেই আমরা বড়রা সাজিয়ে তুলতে পারতাম। পারিনি। হয়তো বা করিনি। আমাদের অল্প অল্প উদাসীনতাই আজ হয়তো ওদের এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তাই এই অবক্ষয় রোধে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে পারিবারিক অভিভাবকদের।
সন্তানের খাওয়া-পড়ার ব্যবস্থাপনাই অভিভাবকের একমাত্র কর্তব্য হতে পারে না। তার মননের যথার্থ বিকাশ ঘটানোও তাঁদের অন্যতম কর্তব্য। অনেক সময় আমরা এই মননের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যায়। বিপত্তির সূচনা সেখান থেকেই। এক্ষেত্রে খুব জরুরি একটি বিষয় আমার অন্তত মনে হয়, বাড়ির বড়দের বলা ও চলা (জীবন-যাপন) যা ছোটদের অনেক মন্ত্রই শেখায়। ন্যায়-অন্যায় বোধ, উচিত-অনুচিতের ধারণাও এখান থেকেই গড়ে ওঠে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি কখনও কখনও ছোটদের সামনেই বাড়ির বড়দের অনবধানতাবশত কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণির প্রতি কটূক্তি করে উষ্মা প্রকাশ করতে। সেই উষ্মা গেঁথে গেল ছোটদের মনেও। বড়রা কী ভাবে দিনযাপন করছেন, কী খাচ্ছেন, কী পরছেন, কী দেখছেন, কী বলছেন— এ সবের দ্বারা আসলে কচি প্রাণগুলি পরিচর্যা পায় সবার অলক্ষে। তাই সামান্য অসাবধানতার অর্থ তাদের অযত্ন, অসম্পূর্ণ বিকাশ। যার কুফল ভোগ করতে হতে পারে বৃহত্তর সমাজকে। তবে এই বিকাশে ভালর ধারণা যেমন দেওয়ার প্রয়োজন, তেমনই মন্দের ধারণাও তাদের দেওয়া দরকার বলে মনে হয়। না হলে ঠিক ভুলের যাচাইয়ে তারা ব্যর্থ হতে পারে। চেতনার বীজটি আজ তাই সচেতন ভাবেই বপন করা আবশ্যক সব শিশু -কিশোর মনে। তার নিজের ভাল-মন্দের চেতনা, পরিজন, পরিবেশ, প্রতিবেশের চেতনা। যে চেতনা তার মধ্যে এনে দেবে দৃঢ়তা।
অভিভাবকত্বের প্রশ্নে অনেক সময় বাবা-মায়ের প্রথাগত শিক্ষার প্রসঙ্গ আনা হয়। তাঁদের শিক্ষার উপরেই অনেকাংশে বিষয়টি নির্ভরশীল বলে মনে করেন অনেকে। এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে আমার ধারণা। কারণ জীবনের শিক্ষা যতটা জীবন থেকে মেলে পুথিগত বিদ্যা থেকে অনেক সময় ততটা নয়। তাই সব অভিভাবকের পক্ষেই সম্ভব সন্তানকে ঠিক পথ দেখানো। যার উপমা আমাদের কাছে অনেক। ঠিক এর পরেই পথ দেখানোর কাজটি অর্থাৎ ছোটদের মধ্যে সুন্দর একটা মন, সজাগ দৃষ্টি, সুদূরপ্রসারী চিন্তাশক্তি যারা গড়ে তুলতে পারেন যাঁরা, তাঁরা শিক্ষাক্ষেত্রের অভিভাবক।
যে বয়সের সঙ্কট নিয়ে কথা, তাদের অনেকটা সময় যেহেতু কাটে শিক্ষাঙ্গনে, তাই ছোটদের ‘মানুষ’ করার দায়িত্ব অনেকটাই বর্তায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপরে। যদিও জানি সরকারি স্কুলগুলির বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা কম। সে কারণেই সব সময় সব ছাত্র-ছাত্রীর প্রতি সমান নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। এটা বাস্তব। আবার এ-ও ঠিক লেখাপড়ার প্রতি সবার আগ্রহ সমান থাকেও না। তা হলে কি স্কুলের, সমাজের একটা বড় অংশ মূল ধারার উন্নয়নের বাইরেই থেকে যাবে? তা হলে উপায় কী?
যে কোনও উপায়ে ছেলেমেয়েদের আগ্রহ বুঝে সেই অনুযায়ী স্কুলের নানা কাজে তাদের দায়িত্ব প্রদান, স্কুলের নানা কার্যকারিতায় আরও বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। সব পড়ুয়াকেই যে প্রয়োজন, সকলেরই যে সমান গুরুত্ব, সেকথা তাদের উপলব্ধিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আত্মিক যোগ গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে তাদের মধ্যে ক্রমশ দৃঢ় হয়ে উঠবে ভাল কিছুর সঙ্কল্প।
একটা সময় ছিল যখন ছোটরা ভয় পেত পাড়ার বড়দের। তাঁদের অনুশাসন মেনে নেওয়াও ছিল যেন খুব স্বাভাবিক। আজ আর সে-সব চোখে পরে না। পাড়াতুতো অভিভাবকের দেখা আজ কোথায় মেলে? না-মানার সংস্কৃতিতে হয়তো স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিয়েছেন। এ অবক্ষয় রোধে তাঁদের প্রয়োজনীয়তাও বোধ করি খুব। কারও উপরে অভিমানের সময় এখন নয়, উদাসীনতা নয়, মুখ ফিরিয়ে থাকার সময়ও নয়। সকলের সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থেই এগিয়ে আসতে হবে পাড়াতুতো সেই অভিভাবকদের। পরিবার, স্কুল, প্রতিবেশীর সক্রিয়তা, যথাযথ দায়িত্ব পালনই গড়ে তুলতে সক্ষম কাঙ্ক্ষিত সমাজ। ভাঙা নয়, গড়ার সমাজ। ভালর আলো সকলে মিলে দেখার সমাজ।
(লেখক লাভপুর সত্যনারায়ণ শিক্ষানিকেতন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy