রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। বিশ্বকবি হওয়ার অনেক দায়: বিশ্বসুদ্ধ লোকে টানাটানি করতে থাকে, কাউকে না বলার জো নেই। ‘কবির বয়স’ কবিতায় বেচারা স্পষ্ট বলছেন, রাজ্যের ছেলে-বুড়ো, প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে গৃহত্যাগী বিবাগী, সকলে এমনভাবে তাঁকে তলব করতে থাকে যে তাঁর আক্ষরিক অর্থেই মরার সময় নেই।
তাই তিনি অমর, অমর তাঁর মতো কালজয়ী কবির দল। সাহিত্যের পেশাদার পাঠকেরা একটা তত্ত্ব খাড়া করেছে যে সাহিত্যের তাৎপর্য লেখকের সজ্ঞান অভিপ্রায়ে ফুরিয়ে যায় না, আবদ্ধ থাকে না রচনাবিশেষের গঠন ও ভাষার গণ্ডিতে। সেই রূপায়িত সৃষ্টিটা ঘিরে থাকে এক অশেষ সম্ভাবনার জগৎ, আদি রচনাকে বাড়িয়ে-বদলিয়ে, হয়তো একেবারে উল্টে দিয়ে। এ ভাবে যুগ-যুগ ধরে দেশে-দেশে নতুন সৃষ্টির রসদ জোগায় যে সাহিত্যকীর্তি, সেটাই যথার্থ ক্লাসিক। রামায়ণ-মহাভারত, ইলিয়াড-অডিসির উপকরণ নিয়ে কত সাহিত্য রচনা হয়েছে গুনে ওঠা অসম্ভব। শেক্সপিয়রের গোটা চল্লিশ নাটক ভাঙিয়ে কবিতা-নাটক-গল্প হয়েছে কে জানে কত হাজার। প্রাক্-খ্রিস্টীয় হোমারের চরিত্র ইউলিসিসকে চতুর্দশ শতকের গোড়ায় খ্রিস্টান নরকে নিক্ষেপ করে তার মুখে একটা আনকোরা নতুন কাহিনি বসিয়েছিলেন বিধ্বস্ত ইতালির নির্বাসিত বিফল রাজনীতিক-কবি দান্তে; সেই গল্প নিয়ে উনিশ শতকে টেনিসন লিখলেন আর এক কবিতা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবিস্তারের ভরা জোয়ারের ভাবাদর্শ মিশিয়ে।
এ সব দেখে আমরা ছি ছি করি না, বরং পরীক্ষার খাতায় বাছা-বাছা উদাহরণের তারিফ করি; কালক্রমে সেই উদাহরণগুলিও হয়ে ওঠে ক্লাসিক। স্বদেশের সাহিত্যসম্পদ কিন্তু আমরা সিন্দুকে আটকে রাখতে পছন্দ করি। ভারত জুড়ে রামায়ণ-কাহিনির বহু বিচিত্র রূপান্তর আছে; বাল্মীকির সঙ্গে মেলে না বলে নব্য-ব্রাহ্মণ্যবাদ সেগুলো পুঁতে ফেললে বাঁচে। কয়েক বছর আগে এ কে রামানুজনের মতো বিশিষ্ট লেখকের রচনাও এই কারণে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তার পাঠ্যক্রম থেকে ছেঁটে দেয়। এমন জঙ্গি মূর্খতার কাছে আমরা উত্তরোত্তর অসহায় হয়ে পড়ছি; কিন্তু দায়িত্বশীল বৌদ্ধিক সমাজও এমন ক্ষেত্রে সর্বদা বড় উদার নন। রবীন্দ্রনাথ নামক মহাকাশযানটিকে বিশ্বভারতী যত দিন সম্ভব কলকাতা-বোলপুর রেললাইন ধরে মাটি কামড়ে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের সেই আইনি ক্ষমতা আর নেই, কিন্তু কিছু বিজ্ঞ বঙ্গসন্তান এখনও রবীন্দ্রসৌধের দেউড়ি পাহারায় ব্যস্ত।
অমুক ব্যাখ্যায় গুরুদেবকে হেয় করা হচ্ছে, অমুক গানে তমুক বাজনা চলবে না, তমুক অভিনয়ে নাটকের (অতএব যেন নাট্যকারের) চরিত্রহনন হয়েছে— এমন শুদ্ধতাবাদ সত্যিই অযৌক্তিক। গীত গান, মঞ্চস্থ নাটক, আরও বেশি মাত্রায় কোনও কাহিনির চলচ্চিত্ররূপ— এ সবই এক-একটা স্বাধীন শৈল্পিক প্রয়াস, কবির রচনা তার ভিত্তি বা অনুপ্রেরণা মাত্র। তার মানে এই নয় যে এমন সব রূপায়ণকে আমাদের তারিফ করতে হবে। শিল্পের বিচারে অনেকগুলি হয়তো চূড়ান্ত অসফল বা উদ্ভট; সেই নিরিখে তাদের তুলো-ধোনা আমাদের অধিকার, কিন্তু শুদ্ধতার খাতিরে এমন প্রচেষ্টা বন্ধের অধিকার নেই। অনেক লোকে বেঢপ জামা পরে বলে দেশসুদ্ধ মানুষকে উর্দি পরানো চলে না।
ফি-বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময় এ সব চিন্তা বেশি করে মাথায় ঘোরে। আরও বেশি ঘোরে অন্য ক’টা প্রশ্ন, যার সঙ্গে শিল্পের বিচারের চেয়ে সমাজের স্বাস্থ্য বেশি জড়িত।
সব কিছুর মতো রবীন্দ্রনাথকে রাজনীতিকরা নিজেদের কর্মকাণ্ডে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। আশ্চর্যের কিছু নেই এতে, ছুঁতমার্গের প্রশ্নও নেই। বিশ্বের সেরা সাহিত্যে রাজনৈতিক উপাদান প্রচুর। দান্তের ‘দিভিনা কম্মেদিয়া’ (যা অনেকে ইউরোপের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি মনে করেন) যতটা ধর্ম-দর্শন, প্রায় ততটাই রাজনীতিতে ঠাসা। কিন্তু মহৎ কবি কাব্যের বৃহৎ পরিসরে রাজনীতিকে স্থান দিলে এক জিনিস, তাতে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আরও গভীর পূর্ণাঙ্গ মাত্রা পায়। উল্টোটা ঘটলে, মহৎ সাহিত্যকে বাজারি রাজনীতির সেবায় যুতে দিলে বিপদ: তাতে সাহিত্যের মহত্ত্ব ক্ষুণ্ণ হয়, সার্বিকতা হারিয়ে যায় গোষ্ঠীবিশেষের তাৎক্ষণিক তাগিদে। সাহিত্যের চূড়ান্ত সামাজিক মূল্য মুক্ত মানবিকতার প্রকাশ হিসাবে, বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গি যা-ই হোক না কেন। তার নিরপেক্ষ পাঠ সমাজে যে শুভ প্রভাব বিস্তার করতে পারত, এমন অবস্থায় সেটা চাপা পড়ে যায়, বিশ্বকবি হয়ে পড়েন খণ্ডস্বার্থের কবি।
একটু তত্ত্বের উদ্ভাবন করছি, সমাজবিদরা বিচার করবেন। সাহিত্য-শিল্প (বা মননের যে-কোনও ফসল) দু’ভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হতে পারে। একটা হল কোনও লেখক বা চিন্তানায়ককে সোজাসুজি কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমর্থনে, এমনকী মুখপাত্র বা আদর্শগুরু হিসাবে তুলে ধরা। এটাকে বলা চলে শিল্প-চিন্তনের কট্টর রাজনীতিকরণ, ‘হার্ড পলিটিসাইজেশন’। এক দশক আগে একটি সর্বভারতীয় দল রবীন্দ্রনাথকে এ ভাবে ক্যাডার বানিয়েছিল, সম্প্রতি আর একটি দল বিবেকানন্দকে বানাচ্ছে আরও অনেক প্রকট ভাবে। এই মনীষীদের কিছু উক্তি হয়তো সাজিয়ে-গুছিয়ে দলের অবস্থানের সঙ্গে মেলানো যায়; আরও বড়সড় সঙ্কলন হতে পারে বিপরীতধর্মী উদ্ধৃতির। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ এঁরা সমসাময়িক কোনও গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখেননি, ভবিষ্যতের অর্বাচীন সংগঠনের চাহিদা তো দূরের কথা। সেই সংগঠনের অনেক কীর্তিকলাপ শুনলে তাঁরা আঁতকে উঠতেন। এ ভাবে আত্মসাৎ করাটাই কবি-শিল্পী-চিন্তানায়ককে সত্যিকারের অপমান, তাঁদের কীর্তির অবমূল্যায়ন।
অন্য ধারাটাকে বলা যায় ‘সফ্ট পলিটিসাইজেশন’। এখানে লেখকের চিন্তা বা আদর্শ টেনে-হেঁচড়ে অপহরণ করা হয় না, সূক্ষ্মভাবে যুক্ত করা হয় দলের প্রচারিত মনোভাবের সঙ্গে; মিলিয়ে দেওয়া হয় দেশ, ভাষা, অঞ্চল বা ধর্মভিত্তিক কোনও ভাবাবেগে, যা সেই দল রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। সাহিত্যপাঠের ভাষায় যাকে ‘ক্যাননাইজেশন’ বলে, সাহিত্যের সেই প্রামাণ্যতা লাভ অনেকটা নির্ভর করে সামাজিক ও রাজনৈতিক হেতুর উপর। নজরুল অবশ্যই বড় মাপের কবি, কিন্তু বহুদিন ধরে যে তাঁকে সাংস্কৃতিক সভায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসানো হচ্ছে, তা কি নিছক সাহিত্যগুণের বিচারে? বাম আমলে এঁদের পাশে সুকান্তকে রেখে এক ত্রয়ী সৃষ্টি হয়েছিল; রাজনীতি ছাড়া অন্য বিচারে এর ব্যাখ্যা চলে না।
তবে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই আমাদের বিশেষ আবদারের পাত্র। জীবদ্দশায় তিনি গুচ্ছের সামগ্রীর সার্টিফিকেট দিতেন শোনা যায়, আজও সেই দায় থেকে রেহাই পাননি। একটি হৃদরোগের হাসপাতাল কেন তাঁর নামাঙ্কিত হবে, মুম্বইগামী ট্রেন বা শহরতলির মেট্রো স্টেশনের নাম হবে ‘গীতাঞ্জলি’, বোঝা শক্ত। মেট্রোর প্রায় প্রতিটি নতুন স্টেশনই রাস্তা বা এলাকা নয়, শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতার নামে চিহ্নিত, হদিশ চিনে নামা দুষ্কর। এই প্রবণতা উৎকট আকার নিয়েছে মোড়ে-মোড়ে তীব্র নিনাদের রবীন্দ্রসংগীতে। ক’জন পথচারী আমোদিত হচ্ছেন জানি না, তল্লাটের বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ। এক কৃতী বিদেশবাসী বঙ্গসন্তান আছেন, যিনি তাঁর বিশ্বখ্যাত বইগুলির অনেকটা লিখতেন কলকাতায় পৈতৃক বাড়িতে অজ্ঞাতবাসে। অভ্যাসটা ত্যাগ করতে হয়েছে, কারণ কাছের চৌমাথায় চিৎকৃত রবীন্দ্রসংগীতে স্বভাবত তাঁর লেখার ব্যাঘাত ঘটে, স্বাস্থ্য-শান্তির কথা ছেড়েই দিলাম। রবীন্দ্রনাথের আমলে যদি লাউডস্পিকার থাকত, এই রীতি সম্বন্ধে তিনি কী বলতেন?
সদ্য-বিগত রবীন্দ্রজয়ন্তী যে পাড়ায়-পাড়ায় হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ আয়োজক সংগঠনগুলি আজ আপাদমস্তক রাজনীতিপুষ্ট। আপত্তিরও কিছু থাকা উচিত নয়; কবির প্রবেশ বঙ্গসমাজের সর্বত্র, সর্বজনীন রাজনীতিতে তবে নয় কেন? ‘সমস্তের ঘোলা গঙ্গাস্রোতে’ নামতে না পেরে কবি আক্ষেপ করেছিলেন, এ বার সেই দুঃখ ঘুচল। প্রশ্ন একটাই। আমাদের জীবনে রাজনীতির বিস্তারের যে সব লক্ষণে আমরা সন্ত্রস্ত (যথা দিবারাত্র লাউডস্পিকার, বা স্থানীয় নেতাদের উৎকট প্রাধান্য), রবীন্দ্রনাথের মোড়কে পুরে সেগুলি কি গ্রহণীয় করার চেষ্টা হচ্ছে? এটাও কিন্তু তাঁর অপব্যবহার, অতএব অপমান।
শেষে যে কথাটা বলব, তাতে গাম্ভীর্যহানি ঘটতে পারে। রবি ঠাকুর নামেই আছেন, আমরা আছি বেঁচে। তাঁকে আসন থেকে টলায় সাধ্য কার, কিন্তু আজকের যে মানুষগুলো শিল্প-সাহিত্য-চিন্তা-অধ্যয়নে ব্যস্ত, তাঁরা নিজেদের অবস্থান কীভাবে বিচার করছেন, কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন? সমাজই বা তাঁদের কী চোখে দেখছে?
যার যেটুকু বিদ্যাবুদ্ধি আছে, সতর্ক ব্যক্তিরা সেটা সভয়ে লুকোতে শুরু করেছেন, কারণ ‘বিদ্বজ্জন’ বা ‘বুদ্ধিজীবী’ আখ্যা রাজনৈতিক আনুগত্যের অস্বস্তিকর তকমায় পর্যবসিত হয়েছে। লেখক, শিল্পী, পণ্ডিতরা চিরকাল রাজনীতি করেছেন; কিন্তু সচরাচর তা বিরোধিতার, প্রতিবাদের রাজনীতি। অতীতে রাজারাজড়ার কাছে দক্ষিণাভিক্ষার প্রচলন ছিল। কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে যত-না বিশিষ্ট শিল্পী-সাহিত্যিক সরকারি প্রসাদ লাভ করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি জেল খেটেছেন, দেশত্যাগী হয়েছেন, অনাদরে দিন কাটিয়েছেন; অধিকাংশই নিজের মতো জীবনযাপন করে সমাজের শ্রদ্ধা-ভালবাসা পেয়েছেন।
তাই কৌতূহল হয় যখন দেখি আজকের কোনও রাজন্য নিরানব্বই রত্নে বেষ্টিত হয়ে আছেন, কয়েকটি খাঁটি রত্নও তার মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছেন। রাজনীতি করার অধিকার সকলের আছে, শিল্পী-সাহিত্যিক-গায়ক-অভিনেতা-খেলোয়াড়দের আছে সমান মাত্রায়। কেউ-কেউ বরাবর সে অধিকার প্রয়োগ করেছেন; কিন্তু কখনও এমন হিড়িক দেখা যায়নি, দেখা যায়নি এত প্রকাশ্য আনুগত্য জাহির, যুক্তি-বিবেচনা শিকেয় তুলে টিভির আড্ডায় দলবিশেষের অপকীর্তির এমন অবিশ্রান্ত সওয়াল।
এই ব্যক্তিরা নিশ্চয় গুণী; তবু কৌতূহল হয়, এই দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে গিয়ে এঁদের একাগ্রতা হোঁচট খায় না? সংঘাত বাধে না রাজনীতির সাধনার সঙ্গে শিল্পের কারিগরির? রবীন্দ্রনাথ থেকে একটা শেষ উদ্ধৃতি: ‘দুই নৌকায় পা দিবামাত্রই যে টানাটানি বাধিয়া যায় তাহা ভালো করিয়া সামলাইতে গেলে সাহিত্য-সার্কাসের মল্লগিরি করিতে হয়।’ রবীন্দ্রনাথ কথাটা সাদা মনে বলেছিলেন বাংলা ভাষায় সংস্কৃত আর দেশজ শব্দের ব্যবহার নিয়ে। আজ সামাজিক স্তরে, বৌদ্ধিক জগতের প্রসঙ্গে কথাটার বড় মর্মান্তিক নতুন ব্যাখ্যা সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ গুরুদেব, মহাপুরুষ, সুতরাং ভবিষ্যদ্বক্তা হতে বাধা নেই। আগেই বলেছি, ক্লাসিক লেখকের কালজয়ী রচনা এ ভাবেই নতুন-নতুন প্রয়োগে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের মতো লিলিপুটবাসীদের তা হলে কী হবে?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy