যে কোনও ভাইরাসকেই আসলে জড় পদার্থ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু এরা এক বার কোনও জীবের ভিতরে প্রবেশ করলে তার জীবন সঞ্চালন প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে জীবিত জীবাণুর রূপ নেয়, এবং তার সাহায্যে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি করে। পরিণামে সেই জীবের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
বৈজ্ঞানিক বিবেচনায় প্রত্যেকটি ভাইরাস অনুগত ভাবে এক প্রকার প্রাণী বা পশুতে সংক্রমিত হয়। কিন্তু গত দু’দশক যাবৎ আমরা দেখছি যে বেশ কয়েকটি পশু-নির্দিষ্ট ভাইরাস তাদের নির্ধারিত লক্ষ্য ছেড়ে আমাদেরও আক্রমণ করছে। এই ধরনের ভাইরাস নিজেদের জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে পশু থেকে লাফ দিয়ে মানুষকে তাদের লক্ষ্য বানিয়েছে। তার পর ঘাতক রূপ ধারণ করে আমাদের অবধারিত মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে। এ রকম ভাইরাসের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমাদের অস্তিত্বকে তারা আজ রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
শুরুতেই এইচআইভি-র নাম আসে। তার পর চিকুনগুনিয়া, সার্স, মার্স, ইবোলা, মারবুর্গ, ওয়েস্ট নাইল, এভিয়ান এইচ৫এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা (বার্ড ফ্লু), এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা (সোয়াইন ফ্লু), নিপা ও জিকা-র মতো মারাত্মক জীবননাশক ভাইরাস। এরা আগে কোনও দিন আমাদের আক্রমণ করেনি, কিন্তু আজ এদের আক্রমণেই আমরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছি। এদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক তৈরি করে উঠতে পারছি না। করোনাভাইরাস এদেরই মতো; সার্সের উত্তরসূরি।
কী বৈশিষ্ট্য এই নোভেল করোনা বা সার্স-কোভ-২ ভাইরাস এবং তার ঘটানো কোভিড-১৯ রোগের, যে তা থেকে আমাদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে? উত্তর বোধ হয় একটাই— এই ভাইরাসটির অভূতপূর্ব সংক্রমণ এবং মারণ ক্ষমতা, যা এর আগে কোনও জীবাণুতে দেখা যায়নি। ভাইরাসটির জিন গঠন থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সে পরিকল্পিত ভাবে এই দু’টি বৈশিষ্ট্যের মিল ঘটিয়ে আমাদের মধ্যে কেবল দ্রুত ছড়িয়েই যাচ্ছে না, ফুসফুসে রোগ ধরিয়ে আমাদের মৃত্যুও ডেকে আনছে। এই ভাইরাসটির আরও এক ভয়ঙ্কর বৈশিষ্ট্য, তা এক জন মানুষকে কোনও ভাবে অসুস্থ না করেও তার ভিতরে ২১ থেকে ২৫ দিন অবধি বিস্তার করতে পারে। এ রকম ব্যক্তিদের তাই কোভিড-১৯’এর ‘অ্যাসিম্পটম্যাটিক’ (রোগের কোনও উপসর্গ নেই) বা লক্ষণবিহীন বাহক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ব্যক্তিরাই ভাইরাসটি ছড়ানো বা ‘কমিউনিটি স্প্রেডিং’-এ মূল ভূমিকা পালন করে। এই ধরনের সংক্রমিত ব্যক্তিরাই এই রোগকে স্টেজ ২ (নির্দিষ্ট এলাকায় সীমিত) থেকে স্টেজ ৩ (গোষ্ঠীর মধ্যে ছড়ানো) পর্যায়ে নিয়ে যেতে সবচেয়ে সাহায্য করে। এখনও আমরা ঠিক জানি না যে এই রকম কত জন লক্ষণবিহীন ভাইরাস বাহক আমাদের দেশে অজান্তে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এর প্রধান কারণ, আমরা সেই পরিমাণে মানুষের মধ্যে ভাইরাসটির পরীক্ষা করে উঠতে পারিনি। তাই আমাদের দেশে এই সঙ্কটের ঠিক ছবিটা এখনই পাওয়া কঠিন।
কিন্তু যে বিষয়টি পৃথিবীকে সব থেকে বেশি হতভম্ব করছে, তা হল এত সতর্কতা সত্ত্বেও কী করে এই ভাইরাসটি এত দ্রুত ছড়াচ্ছে? সম্প্রতি ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এর এক প্রতিবেদন দেখিয়েছে যে এই ভাইরাসটি হাওয়ায় (অ্যারোসল) তিন ঘণ্টার বেশি এবং প্লাস্টিক বা স্টিলের ওপর ২-৩ দিন বেঁচে থাকতে পারে। এই তথ্য যদি ঠিক হয়, তা হলে কি এটি হাওয়াতেও সংক্রমণ ঘটানোর বা ‘এয়ারবোর্ন’ হওয়ার ক্ষমতা রাখে? এর চেয়েও চিন্তার বিষয়, যদি ভাইরাসটি জড় বস্তুর (ফোমাইট) ওপরে এত দিন বেঁচে থাকতে পারে, তা হলে ৭২ ঘণ্টা অবধি সেটির সংস্পর্শে যে আসবে, সে-ই ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই যে কোনও খোলা পড়ে থাকা জিনিসই পরিষ্কার না করে ছুঁলে আমাদের বিপদ হতে পারে।
এই করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য আমাদের কী করণীয়? যে কোনও যুদ্ধ জেতার জন্য চাই ঠিক কৌশল আর অস্ত্র। এ ক্ষেত্রে আমরা এখনও অস্ত্রবিহীন, তাই পুরো যুদ্ধটা আমাদের লড়তে হবে ঠিক প্রতিরোধ কৌশল নিয়ে। যে হেতু এই ভাইরাসটি শুধু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়, তাই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা নিজেদের শরীরে ভাইরাস বহন করব না, বা অন্যকে সংক্রমিত হতে দেব না। সেই হিসেবে আমাদের এই ‘ঘরবন্দি’ হওয়ার সঙ্কল্প একেবারে ঠিক পদক্ষেপ। এতে আমাদের মধ্যে যারা কোভিড-১৯’এর উপসর্গ ছাড়া ভাইরাসটি বহন করছে, (অ্যাসিম্পটম্যাটিক ক্যারিয়ার্স), তাদের জনসাধারণের বা ‘কমিউনিটি’র মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা অনেক কমে যাবে। যদিও তাদের কাছের লোকেদের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তাই আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে যে ‘ঘরবন্দি’ হয়ে সামাজিক দূরত্ব (সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং) রাখা মানে এ-ই নয় যে অবাধে বাড়ির সবার সংস্পর্শে আসা। বরং খেয়াল রাখতে হবে যে বাড়ির প্রবীণ আর অসুস্থরা (বিশেষ করে ডায়াবিটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী) যেন একেবারে বাড়ির অন্যদের থেকে আলাদা থাকেন। কেননা, তাঁদের কোভিড-১৯ হলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হতে পারে। এই সময় আমরা কাউকে বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকতে দেব না। কাউকে যদি কোনও জরুরি কারণে বাড়ির বাইরে যেতে হয়, ফিরেই তাকে জুতো খুলে কিছু স্পর্শ না করে সোজা বাথরুমে ঢুকে যেতে হবে। তার পুরো পোশাক গরম ডিটারজেন্ট জলে চুবিয়ে রাখতে হবে অন্তত ১৫ মিনিট। গরম জল ও সাবান দিয়ে স্নান করতে হবে। শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করতে হবে। তবেই যেন সে বাড়ির কোনও জিনিস স্পর্শ করে। আমরা যেন বাড়িতে অনাবশ্যক জিনিসে হাত না দিই, এবং মুখে হাত দেওয়ার আগে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিই। আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। যে হেতু কোভিড-১৯’এর উপসর্গগুলোর (যেমন, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা) সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে মিল রয়েছে, তাই এই সময় ঠান্ডা লাগানো চলবে না। এই রকম কোনও উপসর্গ দেখা দিলে তা বাড়িতে অকারণ ত্রাস সৃষ্টি করবে। এ ছাড়াও, যারা আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছে বা আসছে, তাদের পরীক্ষা করে যেতে হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য কর্মীদের অথবা কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত দেশগুলি থেকে যারা ফিরছে তাদের পরীক্ষা দরকার, যাতে সংক্রমিতদের আস্তে আস্তে শনাক্ত করা যায়।
এটা বোঝা দরকার যে শত্রুর থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখে হয়তো আমরা সাময়িক ভাবে তার হাত থেকে নিস্তার পেতে পারি, কিন্তু সে যত ক্ষণ দোরগোড়ায় বসে থাকবে, তত ক্ষণ সে আবার আমাদের আক্রমণ করতে পারে। তাই এই ‘ঘরবন্দি’ একটি স্বল্পমেয়াদি বা ‘শর্ট টার্ম’ পরিকল্পনামাত্র, যাতে এই ভাইরাসের দ্রুত প্রসার রোখা যায়। তার সঙ্গে কার্যকর দীর্ঘমেয়াদি বা ‘লং টার্ম’ পরিকল্পনার মাধ্যমে এই ভাইরাস নিৰ্মূল করার পদক্ষেপও করতে হবে, যাতে তা আর ভবিষ্যতে এমন দুর্ভোগ ঘটাতে না পারে। যদিও এই ভাইরাস ঠেকাতে টিকা তৈরি নিয়ে সারা পৃথিবীতে খুব উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তা কতটা কার্যকর হবে সেটা সময়ই বলবে। এই ধরনের ভাইরাস খুব দ্রুত তাদের ভোল পাল্টে এই রকম টিকাকেও অক্ষম করে দিতে পারে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই এ রকম জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারার ফলে এই ধরনের মহামারির ক্রমশ উপশম ঘটেছে। প্রধানত, এরাই শেষ অবধি সবাইকে জীবাণুটির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলা হয়ে থাকে। করোনার বিরুদ্ধেও ‘হার্ড ইমিউনিটি’ গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন। চিন হয়তো তা করেও ফেলেছে। আমরা যদি কোভিড-১৯’এর স্টেজ ৩-এ ঢুকে পড়ি, আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা হবে, ১৩০ কোটির মধ্যে প্রায় ৮৫ কোটি নাগরিকের বয়স ৩৫ বছরের নীচে, এবং এরা এই ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমিত হলেও প্রবল ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা কম। বরং এরাই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তৈরি করে বাকি সবাইকে ‘হার্ড ইমিউনিটি’র সুরক্ষা দিতে পারে। তাই এই ভাইরাসের প্রকোপ বাড়লেও আমরা আশানুরূপ ভাবে সেটা হয়তো কাটিয়েও উঠতে পারব।
জৈবপ্রযুক্তি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy