বিশ শতকের মাঝামাঝি জোনাস সাল্ক আবিষ্কার করে ফেললেন পোলিয়োর টিকা: মানবসভ্যতায় চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সে এক যুগান্তকারী অবদান। সাল্ককে যখন জিজ্ঞেস করা হল, “টিকাটির পেটেন্ট কার?” উত্তরে সাল্ক বলেন, “জনগণের। অর্থাৎ, কোনও পেটেন্ট নেই। সূর্যের কী পেটেন্ট নেওয়া সম্ভব?” ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০১২-র এক নিবন্ধে হিসেব কষা হয়েছে, পোলিয়ো টিকার পেটেন্ট না নিয়ে সাল্ক হারিয়েছেন প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার!
কোভিড-১৯ অতিমারির ইতিবৃত্তের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সম্ভাব্য টিকা নিয়ে দুনিয়া-কাঁপানো মাতামাতি। এ যেন সূর্যের আলোকে মুঠোয় বন্দি করার একুশ শতকের অভীক্ষা। এক মারণ-ভাইরাস দুনিয়াটাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে খোলসের মধ্যে, আর অভূতপূর্ব তৎপরতায় টিকা তৈরির প্রতিযোগিতায় বিশ্ব জুড়ে নেমেছে শতাধিক সংস্থা। পৃথিবী জুড়ে বিপুল বাজারের খানিক অংশ পকেটস্থ করাই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির মূল চালিকাশক্তি। এখন ‘সাল্ক ভ্যাকসিন’-এর মতো কোনও ব্যক্তির নামে টিকাকে চিহ্নিত করাও হয় না। আজকের টিকা ‘ফাইজ়ার ভ্যাকসিন’, ‘মডার্না ভ্যাকসিন’, ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা ভ্যাকসিন’ এ রকম নামে পরিচিত। কোনও টিকার দাম ৩০ ডলার, কোনওটার হয়তো ৪০। তবে স্বাস্থ্যবিমা কিংবা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির আওতায় দুনিয়ার সকলের যে টিকা জুটবে না, তা নিশ্চিত। ভারতে নাকি হাজার টাকায় মিলবে অক্সফোর্ড টিকার দু’টি প্রয়োজনীয় ডোজ়। গরিব দেশের কোটি কোটি মানুষের টিকার খরচ আসবে কী ভাবে, সেটা মোটেই স্পষ্ট নয়।
টিকাকরণের আয়োজনটাও হতে চলেছে দৈত্যাকার। দেশের কোণে কোণে টিকার ডোজ় পৌঁছে দেওয়া, তার সংরক্ষণ, টিকাকরণের পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়াও সহজ নয়। ভারতের সবাইকে টিকা দিয়ে উঠতেই নাকি হয়ে যাবে ২০২৪ সাল। এ দিকে টিকার কার্যকারিতা মাসকয়েকের বেশি স্থায়ী হবে বলে মনে করছেন না অনেকেই। কার্যকারিতা স্বল্প স্থায়ী হলে এবং তিন বছর ধরে টিকাকরণ চলতে থাকলে, সকলকে টিকা দিয়ে ওঠার অনেক আগেই টিকা-নেওয়া বিপুল জনতা কিন্তু বেরিয়ে যাবে টিকার রক্ষাকবচের বাইরে। তা হলে কি টিকাকরণটাই হয়ে উঠবে এক প্রবহমান প্রজেক্ট? দেশের অন্তত ৮০-৯০% জনতাকে টিকার রক্ষাকবচের আওতাতে আনা বাস্তবে কতটা সম্ভব?
টিকা নিয়ে টিপ্পনীর জায়গা অনেক। ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের ছদ্ম মোড়কে ঢাকা পড়েছে টিকা-সংক্রান্ত গবেষণাও। কখনও বা তৃতীয় পর্যায়ে টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা শুরুর আগেই ঘোষণা হয়ে যায় তার ‘সাফল্য’। কখনও টিকা হয়ে ওঠে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার মাধ্যমও। কোভিড-১৯’এর বর্ষপূর্তি হতে না হতেই সাফল্যের রিপোর্ট কার্ড হাতে হাজির হরেক প্রতিষ্ঠান। কারও ঘোষিত সাফল্যের হার ৯০%, কারও আবার ৯৫%। আমজনতার কাছে এই শতাংশগুলোর অর্থ অস্পষ্ট হলেও, শুনতে বেশ। কোনও এক কোম্পানি তাদের পরীক্ষাধীন টিকার ৯০% সাফল্যের হিসেব দেওয়ার ক’দিনের মধ্যেই প্রতিযোগী কোম্পানি ৯৫%’এর হিসেব দেয়। ক’দিন বাদে আগের টিকাটির সাফল্যের সংশোধিত খতিয়ান আসে, ৯৫%। এ বড় মজার ইঁদুর দৌড়!
সাধারণ ভাবে টিকা আবিষ্কারের সময়সীমা অনিশ্চিত হলেও, বা টিকা তৈরিতে দশ-বিশ বছর লাগলেও, কোভিড-১৯ হল এক নজিরবিহীন প্রতিযোগিতার নাম। বছর ঘোরার আগেই এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ না হতেই টিকা প্রায় তৈরি। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে কিন্তু সাবধানবাণী, যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোভিড-১৯’এর টিকার জন্য তাড়াহুড়ো করা অনুচিত।
তবু, দুনিয়া জুড়ে এক অভাবনীয় তাড়না। দুনিয়াবাসী ভাবতে শিখেছে, অতিমারি-বিধ্বস্ত দুনিয়াতে কোভিডের টিকাই স্বাভাবিক জীবনে ঢোকার ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্র। এক অতি-আবশ্যক বাধ্যবাধকতা। তাই পৃথিবীর নানা দেশেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি নিয়ম আলগা করেছে কোভিডের টিকার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বা তার অনুমোদনে। বিভিন্ন কোম্পানির টিকা পরীক্ষাকরণের বয়স কিন্তু মাত্র কয়েক মাস। তাই তাদের সাফল্যের গল্পে দীর্ঘমেয়াদি রক্ষাকবচ হয়ে ওঠার কোনও আশ্বাসবাণী থাকা সম্ভব নয়, নেইও। টিকার সুরক্ষা কয়েক মাসের মধ্যেই হারিয়ে যাবে কি না, তাও জানা নেই। সাফল্যের শতাংশগুলি স্বল্পমেয়াদেই প্রযুক্ত। তড়িঘড়ি তৈরি হওয়াতে জানা নেই টিকার সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি বা মধ্যমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও। আর নেই বলেই ভবিষ্যতে টিকাকরণ করা কোটি কোটি জনতাকে নিরীক্ষণে রাখা আশু কর্তব্য। কিন্তু কোনও মানদণ্ডেই সেটা বড় সহজ কাজ নয়।
অন্তত বেশ কয়েক বছর এই টিকাই বিপুল ভাবে প্রভাবিত করে চলবে মানবসভ্যতার গতি-প্রকৃতি, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি। ৭৮০ কোটি দুনিয়াবাসীর সম্ভাব্য বাৎসরিক বা ষাণ্মাসিক টিকাকরণের বাজারটা একটু হিসেব করার চেষ্টা করি। কেবল ভারতেই প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি এবং টিকাকরণের মোট খরচের বিপুল অর্থে দেশ জুড়ে ক’টা হাসপাতাল তৈরি করা যেত, তার হিসেব কষা যেতে পারে। ফি-বছর টিকা নিতে হলে এই খরচের অনেকটাই কিন্তু হয়ে যাবে বাৎসরিক।
এত শত কচকচানির মধ্যে সূর্যকে দু’মুঠোয় আঁকড়ে ধরতে চেয়ে জোনাস সাল্কের নিঃস্বার্থ সাধনা কিন্তু এক বিচ্ছিন্ন রূপকথা হয়েই থেকে যাবে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy