Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

অতিমারির হাত থেকে কৃষিকে বাঁচাতে সাহসী পদক্ষেপ জরুরি

-কৃষিক্ষেত্রে অতিমারির প্রকোপ যে দেশের তথা রাজ্যের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করবে তা সন্দেহাতীত। তবে দেশের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মেরামতি অথবা গ্রামীণ জীবন, জীবিকা বাঁচানোর যে তাগিদ রয়েছে তার ইঙ্গিত রয়েছে কৃষিতেও। ভয়াবহ অতিমারির মোকাবিলায় সরকারের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো কৃষক স্বার্থের পাশাপাশি, রক্ষা করবে দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পরিকাঠামোও। দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণার পরে কেটে গিয়েছে এক মাসেরও বেশি সময়। এরই মধ্যে অন্য ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেলেও কৃষিজীবী মানুষদের সাহায্যের সে রকম কোনও পরিকল্পনা মেলেনি কেন্দ্রীয় সরকারি দস্তাবেজ।

মুখ ঢেকে কাজ। ছবি: পিটিআই

মুখ ঢেকে কাজ। ছবি: পিটিআই

সৈকত সাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২০ ০৪:৩৪
Share: Save:

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বিপর্যস্ত জনজীবন। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। করোনায় প্রভাবিত ভারতের অধিকাংশ রাজ্য এখনও লকডাউনের আওতায়। যদিও লকডাউন ছাড়া এই রোগ মোকাবিলার অন্য কোন উপায় নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ। কিন্তু এই সুদীর্ঘ লকডাউনের ফলে দেশজুড়ে ক্রমশ অধোগামী হচ্ছে অর্থনীতির লেখচিত্র। অধিকাংশ উৎপাদন ও পরিষেবা এখনও বন্ধ। এ ক্ষেত্রে, অর্থনীতিবিদদের নানা মতামত রয়েছে। সেই আলোচনায় বারবার দেখা যাচ্ছে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে এখনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৃষিক্ষেত্র। এর প্রথম কারণ, ভারতবর্ষের কৃষির উৎকর্ষতা। এ দেশে কৃষি উৎপাদন এতটাই বেড়েছে যে দেশের জনসাধারণের খাদ্য-সুরক্ষার দিকটি নিশ্চিত হয়েছে। তবে খাদ্যদ্রব্যের বণ্টনের দিকে ঘাটতি আজও রয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি, দেশের জিডিপির ২৮ শতাংশই আসে কৃষি থেকে। ভারতের অর্থনীতির শক্তিশালী ভিতটি কিন্তু কৃষির উপরেই গড়ে উঠেছে। আমাদের রাজ্যের হিসেবে এই অবদান আরও কিছুটা বেশি। তাই কৃষিক্ষেত্রে অতিমারির প্রকোপ যে দেশের তথা রাজ্যের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করবে তা সন্দেহাতীত। তবে দেশের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মেরামতি অথবা গ্রামীণ জীবন, জীবিকা বাঁচানোর যে তাগিদ রয়েছে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে, তার ইঙ্গিত রয়েছে কৃষিতেও।

দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণার পরে কেটে গিয়েছে এক মাসেরও বেশি সময়। এরই মধ্যে অন্য ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেলেও কৃষিজীবী মানুষদের সাহায্যের সে রকম কোনও পরিকল্পনা মেলেনি কেন্দ্রীয় সরকারি দস্তাবেজ। তবে এ রাজ্য প্রথম থেকেই কৃষিকে অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর তালিকাভুক্ত করায় সার, বীজ, কৃষিবিষের সরবরাহের সমস্যা মিটেছে অনেকটাই। ব্যাপক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বোরো ধান, তিল, পাট, ভুট্টার ফলন। এ ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসনীয়। পাশাপাশি, ফুল, ফল, দুধের চাষি বা বিড়ি শ্রমিক, চা বাগানের শ্রমিকদের ২৫ শতাংশ করে কাজের ছাড় দিয়ে সরকার যে মানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাও প্রশংসার যোগ্য। তবে, এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পঙ্গুত্ব থেকে ঘুরে দাঁড়াতে কৃষি ও কৃষকের আরও বেশি প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতার। শ্রমিকের অভাবে গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে পড়ে আছে পাকা বোরো ধান। সরকারি সহযোগিতায় চাষিরা সেই ধান অনায়াসে ঘরে তুলতে পারবেন হারভেস্টার যন্ত্রের ব্যবহারে। একই সঙ্গে, এ রাজ্যের কৃষিতে যন্ত্রায়ণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার যুবক-যুবতীদের দীর্ঘমেয়াদি কৃষিঋণ প্রকল্পের আওতায় আনলে কৃষিতে শ্রম নির্ভরতা হ্রাস পাবে অনেকাংশে, মুনাফা বাড়বে কৃষকদেরই।

অন্য দিকে, আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ১০০ দিনের কাজে রবি ফসল কাটা ও ঝাড়ার অন্তর্ভুক্তির যে প্রস্তাব দিয়েছেন, বর্তমান সময়ে তা বেশ উপযোগী সমাধানের পথ বলা যেতেই পারে। এর পাশাপাশি, ধান কেনার দ্রুত এবং ঠিকঠাক পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন রাজ্য সরকারের। চাষিদের নিরাপত্তা এবং ফসলের ঠিক দাম দেওয়ার পরিকল্পনা আশু প্রয়োজন। এর মধ্যেই, খরিফ মরসুমের বিভিন্ন ফসল চাষের পরিকল্পনায় মাঠে নেমেছেন কৃষকেরা। এ কথা মাথায় রেখে রাসায়নিক সারে ভর্তুকি বাড়িয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এই সঙ্কটকালীন সময়ে প্রশাসনের তরফে সার, বীজ, কৃষিবিষ, ডিজেল ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়া যেতেই পারে।

পাশাপাশি, মজুদ এবং বণ্টনের সামঞ্জস্য না থাকায় দাম বেড়েছে চাল-ডালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর। পরিবহণ ব্যবস্থা বন্ধ থাকার জন্য সমস্যায় পড়েছেন এ রাজ্যের আনাজ চাষিরাও। গ্রামবাংলার মাঠের ফসল পুরোপুরি পৌঁছচ্ছে না শহরের বাজারে। নিরুপায় হয়েই চাষিরাও অনেক কম দামে ফড়েদের হাতেই তুলে দিচ্ছে ফসল। কারণ, খতিয়ে দেখা যাচ্ছে পণ্য পরিবহণে ট্রাক বা গাড়ির খরচ বৃদ্ধি। ডিম থেকে মাছ, আনাজ থেকে মাংস— সব কাঁচামালের যোগানেই একই চিত্র উঠে আসছে এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তবে রাজ্যজুড়ে মিষ্টির দোকান খুলে দেওয়ায় দুগ্ধশিল্পে ক্ষতি অনেকটাই আটকানো গিয়েছে। তবুও বেসরকারি স্তরে ও কো-অপারেটিভে দুধের মূল্য কমেছে অনেকটাই, সঙ্গে পরিবহণের সমস্যা তো আছেই। এ সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে স্থানীয় স্তরে প্রশাসনের আধিকারিক, বাজার কমিটি এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলির সমন্বিত প্রয়াস দরকার। জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, ঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি, খাদ্যদ্রব্যের ঠিকমতো মজুত ও যোগানের মতো বিষয়গুলি নিজেদের বিবেচনায় রেখে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে হবে।

লকডাউনের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে ছাড় পায়নি এ রাজ্যের প্রাণিসম্পদ উৎপাদক ব্যবসায়ীরাও। পরিবহণ সমস্যার জন্য ভিন্ রাজ্যের থেকে গোখাদ্য বা প্রয়োজনীয় গবাদি পশুর ওষুধ পৌঁছচ্ছে না এ রাজ্যে। ফলে, অনেক ছোটখাটো ফার্ম বন্ধ হওয়ার মুখে। স্বল্প পরিমাণে বাজারজাত হওয়া মাংস বা ডিম বিকোচ্ছেও বেশ চড়া দামে। আপাতত, এই সঙ্কটের সময়ে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে উৎপাদন-মজুত-বণ্টনের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা দরকার। এতে বাজারে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে। তবে রাজ্য জুড়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রাণিসম্পদ উৎপাদকদের স্বার্থে সরকারের তরফে কৃষিঋণের মেয়াদ বাড়ানোর খুব প্রয়োজন। দরকারে এ বছর কাউকে অনাদায়ী ঋণের আওতায় না আনার মানবিক পদক্ষেপও নেওয়া যেতেই পারে।

লকডাউন পরবর্তী সময়ের কথা মাথায় রেখেই প্রশাসনের তরফে কৃষিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রয়োজন আপৎকালীন দিক নির্দেশের। সে ক্ষেত্রে, ব্লক স্তরে রাজ্যের কৃষি দফতরের সঙ্গে জেলা স্তরে ‘আতমা’ ও কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রগুলিকেও অবশ্যই কাজে লাগানো যেতে পারে। সবার সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে ‘কমিউনিটি এগ্রিকালচার’-কে জনপ্রিয় করা যেতে পারে। ফুল-ফল-মাছ-আনাজের মতো পচনশীল কৃষিদ্রব্য ভর্তুকিতে পৌঁছানো যেতে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদের হাতে। এতে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও চাষে উৎসাহ খুঁজে পাবেন কৃষকেরা। ভয়াবহ অতিমারির মোকাবিলায় সরকারের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো কৃষক স্বার্থের পাশাপাশি, রক্ষা করবে দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পরিকাঠামোও।

বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (কৃষি সম্প্রসারণ), নদিয়া কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy