প্রশ্ন: যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয়, তার মোকাবিলায় রাজ্যে তো বটেই, গোটা দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগের প্রভূত প্রশংসা হয়েছিল। নানা ধরনের মিডিয়া, এমনকি বিরোধীরা অবধি তাতে শামিল হন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই কী এমন হল যে এখন বিরোধী থেকে অনেকেই সুর পাল্টাচ্ছেন?
রণবীর সমাদ্দার: গোড়ায় ‘ভাল’ চলছিল, হঠাৎ ‘সমস্যা’ হল, ব্যাপারটা এমন নয়। আসলে এই রোগের বিস্তার হয় ধীর গতিতে, তার পর হঠাৎ করে জ্যামিতিক হারে বাড়তে শুরু করে। রাজ্যের প্রথম দিকের পদক্ষেপ— খাদ্যবণ্টন, মেডিক্যাল কলেজ বা বাঙ্গুর হাসপাতালকে কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য বিশেষ ভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ, একই সঙ্গে ‘লকডাউন’ ও সাধারণ মানুষের জীবিকা চালানোর চেষ্টা— এ সব নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। কিন্তু সেটাই ‘সম্পূর্ণ যথেষ্ট’ কি না, তা বড় সময় না হলে বোঝা যাবে না— রোগ যত বাড়তে থাকবে, ঘরবন্দি দশা যত বাড়বে, নানা কারণে শহরের জনবহুল অংশে লোকে যত নিয়ম ভাঙবে— তখন আন্দাজ করা যাবে, সরকারি ব্যবস্থা ‘যথেষ্ট’ ছিল কি না।
প্র: এটা কি আসলে পপুলিস্ট বা জনবাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা?
উ: না, এটাকে জনবাদী সরকারের সীমাবদ্ধতা বলছি না, আসলে এই রোগের চিকিৎসা অন্য সঙ্কটাপন্ন রোগের মতো ‘বিশেষ চিকিৎসা’র বিষয় নয়, তার চেয়েও বেশি এটা জনস্বাস্থ্যের সমস্যা, যার একটি অঙ্গ লকডাউন। কিন্তু কেবল সেটা হলেই তো চলবে না, দেখতে হবে যাঁরা সাধারণ মানুষ, বস্তিবাসী— তাঁদের ব্যবহার্য ন্যূনতম সাধারণ পরিষেবা যেন চলতে পারে, আবার জনগণের ওপর নজরও রাখতে হবে। পাশাপাশি ভাবতে হবে কী ভাবে স্বাস্থ্যকর্মী থেকে সাফাইকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। পুরনো হিসেবে এটা হবে না— ‘কেন্দ্র দিচ্ছে না’ বলেও হবে না— কেন্দ্র না-দিলেও রাজ্যকে ব্যবস্থা করতে হবে, দেখতে হবে ক’টা বেড, ক’টা ভেন্টিলেটর আছে, আরও কত লাগতে পারে। দরকার হলে, অন্য চালু খরচ কাটছাঁট করেও অর্থের বন্দোবস্ত করতে হবে।
আর একটা পুরনো সমস্যা— খাদ্যবণ্টনের সমস্যা। তার কথাও শোনা যাচ্ছে। গণবণ্টনে এই সরকার অনেক ভাল কাজ করেছে। কিন্তু ডিলারদের স্তরে ‘দুর্নীতি’র কথাও উঠেছে। এটা নতুন নয়, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বামপন্থীরা কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে খাদ্যসঙ্কট নিয়ে প্রবল আন্দোলন করেছে, ২০০৭ বামফ্রন্টের আমলেও ‘রেশন রায়ট’ হয়েছে। গণবণ্টনে দুর্নীতি অনেকটা ‘খাজনা’ তোলার মতো। এমনিতেই জনগণের ১০ শতাংশ রেশন ব্যবস্থার বাইরে থাকে। পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্কটে এই তথ্য আরও প্রকট হয়েছে। কিন্তু যাঁরা রেশন পান, তাঁদের মধ্যেও যদি ২০ শতাংশের ভাগ্যে না জোটে, তখন সংখ্যাটা আরও বড় দেখাবে। যাঁরা ‘পেলেন’, তাঁদের চেয়েও যাঁরা ‘পেলেন না’, সেটাই বড় হয়ে দাঁড়াবে। এই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ বা জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে নজরদারি কেবলমাত্র সরকারের কাজ নয়। প্রশাসন প্রশাসনের ওপর কত দূর নজর রাখবে! এখানেই জনসমাবেশের প্রশ্ন। অর্থাৎ, এই ধরনের সঙ্কট মোকাবিলায় সরকারি কাজের সঙ্গে সমাজকে মেলাতে হবে।
প্র: জনসমাবেশ বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
উ: জনসমাবেশ মানে ‘জমায়েত’ নয়, জনগণকে নিয়ে বা ‘সমাবিষ্ট’ করে চলা, বা সমাজকে সঙ্গে নিয়ে চলা। উনিশ শতকের শেষে স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় প্লেগ মোকাবিলায় যে পদক্ষেপ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪ সালে বঙ্গপ্রদেশে তীব্র খরায় সরকারের চেয়েও সমাজের ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে যেমন সমাজের ‘আত্মশক্তি’র ওপর জোর দিয়েছিলেন, তার কথা বলছি। সাধারণত আমাদের দেশে এটাই দেখা গিয়েছে যে সমাজ চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনায় এগিয়ে গিয়েছে, সরকার রয়েছে পিছিয়ে। এখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যাচ্ছে— সরকার নানা জনমুখী বিষয়ে এগিয়ে আছে, সমাজ চলেছে তার পিছনে! সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি যদি সমাজের যোগ হয়, তবেই আমাদের মতো জনবহুল রাজ্যে এই ধরনের সঙ্কটের সফল মোকাবিলা সম্ভব।
প্র: কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সামাজিক যোগদান তো রাজনৈতিক দলাদলিতে পর্যবসিত হতে পারে!
উ: কিছুটা হতে পারে এবং তা অবশ্যম্ভাবী। তবে সরকারের দিক থেকে দেখতে হবে যাতে বিষয়টি যত দূর সম্ভব দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকে। সরকার এটা পারে। ধরুন, কন্যাশ্রী-র মেয়েরা তো রয়েছে, দলমতনির্বিশেষে স্কুল-কলেজের মেয়েরা এই প্রকল্পে এক ধরনের আত্মনির্ভরতা পেয়েছে। এই মেয়েদের থেকে বা অন্য ক্ষেত্র থেকেও কিছু বাছাই করে ‘স্বেচ্ছাসেবী সমিতি’ বানিয়ে জনস্বাস্থ্যবিধি আরও ভাল করে তৃণমূল স্তর অবধি প্রয়োগ করা যায়, যেখানে সরকার একার চেষ্টায় পৌঁছতে পারে না। ধরুন, সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু মেয়েকে মৌলিক প্রশিক্ষণ দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় (দূরত্ব বজায় রেখেই) দায়িত্ব দেওয়া হল পাড়ায় স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো পালিত হচ্ছে কি না, বা, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিস পেতে কারও অসুবিধা হচ্ছে কি না, এই সব দেখাশোনা করার। পাড়ার ক্লাব (যারা অনেকেই সরকারের সাহায্য পেয়েছে) বা বাজার সমিতিকে কাজে লাগানো হল এটা দেখতে যে কিছু কিছু দোকান খোলা থাকলেও যাতে জমায়েত না হয়। একই সঙ্গে জনসাধারণের অভাব-অভিযোগ যাতে সরকারের কাছে পৌঁছয়, তার জন্য ‘দিদিকে বলো’-র মতো কিছু ব্যবস্থা এখন অনেক বেশি কাজে লাগবে। কেরলও যে সঙ্কট মোকাবিলায় অনেকখানি সাফল্য পেয়েছে, তা সামাজিক শক্তিকে ব্যবহার করেই— নারী সমবায়গুলি, বা বিজ্ঞান ক্লাব ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়েই। এর মানে এটা নয় যে অমুক রাজ্য ‘ভাল’ বা তমুক রাজ্য ‘খারাপ’। এই সঙ্কটে প্রতিটি রাজ্যকে অন্য রাজ্যের প্রয়োগপ্রণালী দেখে শিখতে হবে, কেননা, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় রাজ্যগুলিই সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে। সব রাজ্যই নিজের মতো করে সামলাচ্ছে। প্রতিযোগিতা নয়, একের সঙ্গে অন্যের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সহযোগিতার মধ্য দিয়েই সঙ্কট পার হতে হবে।
প্র: তবে তো জেলা পরিষদ বা পঞ্চায়েত সমিতি, কিংবা জনপ্রতিনিধিদেরও যুক্ত করতে হয়?
উ: তা তো বটেই।
প্র: সমাজের ‘আত্মশক্তি’র সমাবেশ ঘটানোই তবে সঙ্কটমুক্তির পথ?
উ: শুধু সেটা নয়, সামাজিক শক্তির সমাবেশ ঘটানোর পাশাপাশি সাধারণ ভাবে জনস্বাস্থ্যে, বিশেষ ভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারি খরচ বাড়াতেই হবে— অন্য খরচ কমিয়ে বাজেটের অন্তত ৬ শতাংশ এ বাবদ ব্যয় করতে হবে। এই দুর্যোগে কিউবা কী ভাবে ইটালিকে স্বাস্থ্য পরিষেবা জুগিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, তা তো জানি। কিউবার অর্থনীতির অনেক সমস্যা আছে, কিন্তু কিউবার চেয়ে অনেক উন্নত কানাডায়, জনগণ প্রতি চিকিৎসকের হারের চেয়ে, কিউবায় এই অনুপাত অনেক ভাল। আর একটা কম প্রচারিত উদাহরণ দিই। ১৯১৮ সালে, প্রথম মহাযুদ্ধের বিশ্বজোড়া ‘স্প্যানিশ ফ্লু’-র কথা তো এখন আমরা সবাই জানি— ভারতেও বিস্তর লোক মারা গিয়েছিল, গাঁধীজিও দারুণ ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই সময় রাশিয়ায় সদ্য অক্টোবর বিপ্লব হয়েছে, দেশে গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ সব একসঙ্গে শুরু হয়েছে। সেই সময় স্প্যানিশ ফ্লু-র পাশাপাশি রাশিয়ায় টাইফাস-এর প্রাদুর্ভাবও দারুণ বাড়ছে। অন্য সব কিছু ভুলে লেনিন তখন হাসপাতাল আর স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর সবচেয়ে জোর দেন। ১৯১৯-এ বলেছিলেন, হয় রোগ সমাজতন্ত্রকে জয় করবে, নয় সমাজতন্ত্র রোগকে। কিন্তু রাষ্ট্রের এই সব কোনও কাজই করা সম্ভব হত না, যদি তার পাশে জনশক্তি না থাকত।
প্র: যখন এই সঙ্কট পেরোব, তখন রাজনীতির চেহারা কেমন হবে?
উ: ভোটের রাজনীতির কী হবে বলতে পারব না, তবে বড় অর্থে, করোনা-সঙ্কট রাজনীতি থেকে অর্থনীতি সর্বত্র জলবিভাজিকা হয়ে উঠবে। করোনা-পূর্ব পৃথিবীতে আর আমরা ফিরতে পারব না। করোনা-উত্তর পৃথিবীতে নব্য উদারবাদী বৃহৎ শিল্প, ফাইনানশিয়াল অর্থনীতির সঙ্কট দীর্ঘমেয়াদি হবে, এ দেশে ও গোটা বিশ্বে। ফলে, দেশের মধ্যে যে সব অঞ্চল এই বড় পুঁজি-নির্ভর, তাদের অবস্থা বেশ কঠিন হবে, আন্দাজ করা যায়। তুলনায় ছোট ও মাঝারি শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা— তাদের বাঁচার কৌশল এতই উদ্ভাবনযোগ্য যে সেগুলো একেবারে মরে যাবে না। আর জনবাদী রাজনীতির সমর্থনভিত্তি তো এরাই। তাই জনমুখী জনবাদী রাজনীতির পরিসর শুধু থেকে যাবে না, আরও বাড়বে। যে সব রাজ্য এই পরিসরে জনস্বাস্থ্য ও বণ্টনব্যবস্থা বজায় রাখতে পারবে, জনগণের কাছে তাদের বৈধতা বাড়বে। আর জাতীয় ক্ষেত্রে যদি দেখা যায়, বেশ কিছু লোকক্ষয় হলেও অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভারতে ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম, তা হলে তারও বৈধতা বাড়তে পারে। কিন্তু সেটা অনেক পরের গল্প।
ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর, কলকাতা মহানির্বাণ
রিসার্চ গ্রুপ
সাক্ষাৎকার: শিবাজীপ্রতিম বসু
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy