প্রতীকী ছবি।
লকডাউন পিরিয়ড। ঘন ঘন আপডেট হচ্ছে— মৃত্যু কত, আক্রান্ত কত, কোন রাজ্যের কী অবস্থা, কোন জেলায় আক্রান্ত বেশি, মৃত্যুহার কী বলছে, এ বার কি মুক্তি মিলবে ইত্যাদি-প্রভৃতি!
নাহ, নির্দিষ্ট কোনও উত্তর নেই। আবছা আবছা কিছু তথ্য, কিছু আশার বাণী উঠে আসতে দেখা যায়। কোনও কোনও দেশ প্রতিষেধক আবিস্কারে এগিয়েছে বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। একটা-দু’টো মৃত্যুর খবর আসে, বাড়ির কাছের কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেও। দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়তে শোনা যায়। কেউ কেউ শিউরে ওঠেন, মৃতদের কেউ কি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন? দূর থেকে ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ। তারপর মেপে নেওয়ার চেষ্টা হয়, যিনি মারা গিয়েছেন, তিনি কি বৃদ্ধ ছিলেন? মানে, সেই ইমিউনিটি পাওয়ারের গল্প।
চারপাশ শোকার্ত। ভয়ার্ত। শুধু বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টায় মগ্ন। সেদিনের সকালটাও যেন তেমনই ছিল। শুধু এক সঙ্গে আরও কিছু মৃত্যুর সংবাদ তখন চারদিকে। না, তাঁদের কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। তাঁরা কোনও হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন না। তাঁরা রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন, বাড়ি ফিরবেন বলে। তাঁরা হাঁটছিলেন, ক্ষুধা-তেষ্টা নিয়ে। যখন ক্লান্ত শরীরগুলি শুয়ে পড়েছিল, লাইনের উপরে একটি ট্রেন পিষে দিয়েছে ওঁদের।
বারবার চোখে ভাসছিল রেললাইনের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই মৃতদেহগুলি। এই প্রথম ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু, তা নয়। এই প্রথম এক সঙ্গে এত মৃত্যুর ঘটনা, বিষয়টা তাও নয়। আসলে, কাদের মৃত্যু হল? কেন মৃত্যু হল? সেই প্রশ্নই ঘুরে ঘুরে মাথায় আসছিল। তাঁরা মৃত্যুর ঠিক আগে হয়তো প্রিয়জনদের কথা ভাবছিলেন। হয়তো ক্ষুধা মেটানোর জন্য একটু ভাতের কথা ভাবছিলেন। ভাবছিলেন, আবার খোলা আকাশের নীচে শ্বাস নিয়ে একটু বেঁচে থাকার কথা। ওই অধিকারগুলো তো ওঁদের আছে, আছে নিশ্চয়ই। একজন সেলিব্রিটির মৃত্যু, একজন সেলিব্রিটির দানে আমরা আপ্লুত হয়ে উঠি। আমাদের বিষাদ আর কান্নার রোল পড়ে যায়। এই মৃত্যু নিয়ে কারও কোনও রা নেই। হয়তো ছিল না কোনও কালেই। জন্ম-মৃত্যুকে পাশাপাশি রেখে একটা সরু সুতোর উপর দিয়ে ওঁরা হেঁটে চলেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। আসুন, অন্তত একবার ওঁদের জন্য নীরবতা পালন করি। আসুন, অন্তত একবার চিৎকার করে বলি— আমরা সবাই ভাল ভাবে বেঁচে থাকতে চাই! এমনটা ইচ্ছে হয়।
ঔরঙ্গাবাদ অনেক দূর, এই উত্তরবঙ্গের কোচবিহার থেকে। ওই রেললাইন কস্মিনকালে কখনও দেখিনি। তবে, দেখেছি খেটে খাওয়া মানুষদের। যাঁদের কেউ আমার প্রতিবেশী। কেউ আমার পাশের গ্রামের মানুষ। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় সেই ছোট্টবেলা থেকে। বড় হতে হতে তাঁরা কেমন হারিয়ে যেতে থাকেন। কেমন বুড়িয়ে যেতে থাকে। কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে দূরে কোথাও চলে যান। কেউ ফিরে আসেন, কেউ আসেন না। করোনাভাইরাসের প্রকোপে চার দিকে আতঙ্কের ছবি। মৃত্যুমিছিল চলছে। তা থেকে সবাইকে নিরাপদে রাখতে লকডাউন গোটা দেশে। জীবনও পাল্টাতে শুরু করেছে। গৃহবন্দি দশা কাটছে মানুষের। এই লড়াইটা এক অসুখের বিরুদ্ধে। সেই লড়াইয়ে উঠে আসছে আরেক অসুখ। নিরন্ন মানুষের হাহাকার। খিদের যন্ত্রণায় শিশুর চিৎকার। অসহায় মা-বাবার অপলক দৃষ্টি।
আচ্ছা, এই অসুখের বিরুদ্ধে লড়াই হবে না? এই অসুখের বিরুদ্ধে সবাই চিৎকার করবে না? এই অসুখের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা কি স্বার্থত্যাগ করতে পারব না?
তথ্যের কচকচানি নিরর্থক। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে কিছু মানুষের জন্মের পর থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তে বেঁচে থাকা। তাঁদের ঘর আধভাঙা। উনুনে গোটা দিনে একবার হয়তো আঁচ পড়ে। তাঁদের খাবারে ভাতের সঙ্গে শাক, নুন থাকে। তাঁদের পরনে ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়। সকাল থেকে তাঁরা ছুটে বেড়ান দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করতে। মরতে মরতে বেঁচে থাকেন তাঁরা।
ঠিক, এই সত্য আমরা কখনও অস্বীকার করতে পারব না যে, জীবনে মৃত্যু আসবেই। মৃত্যুর হাত থেকে কোনও ক্ষমতাধরই নিজেকে বাঁচাতে পারেননি, পারবেনও না। তাই অমল, বিমল, সহিদুলদেরও মৃত্যু হবে। কিন্তু এ ভাবে মৃত্যুর কথা তো নয়!
আসলে, এই লড়াইয়ে ওঁরা পিছিয়ে আছেন বহু ক্রোশ দূরে। যেমন ভাবে ওঁরা পিছিয়ে থাকেন সব সময়। ওঁদের পাতে মাছ-মাংস-ডিম-দুধ, ফল পড়বে না। ওঁদের ঘরে স্যানিটাইজার নেই। স্যানিটাইজার কী, সেটাও জানেন না অনেকে। কারও কারও ঘরে সাবানও নেই। এমন ভাবেই তো ওঁরা বেঁচে থাকেন। তাই ওঁদের নিয়ে ভাবনা নিষ্প্রয়োজন। এমনই বদ্ধমূল ধারণা গেঁথে রয়েছে যুগ যুগ ধর। এ বারও করোনা-যুদ্ধে তাই হল। ওঁদের কথা কেউ ভাবেননি। ওঁরা কী খাবেন? ওঁরা কী করে কোথায় থাকবেন? ওঁদের বাড়ি ফেরার কী হবে?
কেউ ভাবেননি। বাড়ি ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে থাকা মানুষগুলি দিনকয়েক ধরে বেঁচে থাকার আর্তি জানিয়েছেন বারবার। খাবার চেয়েছেন, বাসস্থানের নিরাপত্তা চেয়েছেন। কোনও কিছুই পাননি। তাই পায়ে হেঁটেই নিজের নিজের জন্মমাটির দিকে রওনা হয়ে যান তাঁরা।
ঔরঙ্গাবাদ আবারও শিক্ষা দিল। সে শিক্ষা থেকে জন্ম নিক নতুন পৃথিবী।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy