কার্ল মার্ক্স তাঁর ইকনমিক অ্যান্ড ফিলজ়ফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস-এ (১৮৪৪) লিখেছিলেন, ‘‘পলিটিকাল ইকনমির চোখে প্রোলেতারিয়েত, অর্থাৎ সর্বহারা শ্রমজীবী হল... ঘোড়ার মতো— কর্মক্ষমতা বজায় থাকার জন্যে তার যতটা দরকার সে কেবল ততটাই পাবে। যখন সে কাজ করছে না তখন আর তাকে মানুষ বলে বিবেচনা করার দরকার নেই।’’ কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে ধরতে হবে, মার্ক্স এমন দিব্যি দেননি। সর্বহারা শ্রমজীবীরা সচরাচর কিছু না কিছু কাজ করেন, একেবারে বেকার থাকেন না, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, কারণ বেকার থাকলে তাঁদের পেট চলে না। তাই পলিটিকাল ইকনমি, মানে রাজনীতির নিয়মে চালিত যে অর্থনীতির মধ্যে আমরা নিজ নিজ খোপে বিরাজ করি, সেই আর্থিক ব্যবস্থাটি তাঁদের অন্তত এক-আনা, দু-আনা মানুষের মূল্য দেয়। কোভিড-১৯ আচমকা সেই ছকটাকে ভেঙে দিল। রাতারাতি কোটি কোটি গতর-খাটা মানুষ একেবারে বসে গেলেন। ফলে পলিটিকাল ইকনমির কাছে তাঁরা আর এক-আনা মানুষও থাকলেন না। ঘোড়া হয়ে গেলেন। বেকার ঘোড়া।
মানুষের এই অ-মানুষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সবচেয়ে পরিষ্কার দেখা গেল দেশের নানা শহরে ও বিবিধ ন্যাশনাল হাইওয়েতে, পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক যন্ত্রণার অগণন দৃশ্যে। দরিদ্রের যন্ত্রণা আমরা বিস্তর দেখেছি, দেখেই থাকি, কিন্তু সেই অভ্যস্ত চোখেও ওই ক’দিনের ঘটনাবলি অসহনীয় ঠেকেছে, হয়তো কিছুটা অবচেতন ভাবেই আমরা অনুভব করেছি যে, এই মানুষগুলোর সঙ্কটের যেন একটা ভিন্ন মাত্রা আছে। ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র।
সেই অনুভূতি যে মিথ্যে নয় তা বোঝা যায় বর্ডার্স অব অ্যান এপিডেমিক: কোভিড-১৯ অ্যান্ড মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স নামক সদ্য-প্রকাশিত গ্রন্থটির পাতা ওল্টালে। ভুল হল, পাতা ওল্টানোর উপায় নেই, কারণ এটি ডিজিটাল বই। সমাজতাত্ত্বিক, সমাজকর্মী, সাংবাদিক— বিভিন্ন ক্ষেত্রের উনিশ জন লেখকের একক বা যৌথ ভাবে তৈরি-করা চোদ্দোটি লেখার এই সঙ্কলন সম্পাদনা করেছেন সমাজবিজ্ঞানী রণবীর সমাদ্দার। প্রকাশক: সিআরজি (মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ)। পরিযান এবং পরিযায়ী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন এই প্রতিষ্ঠান। কোভিড-১৯’এর ধাক্কায় এ দেশের (এবং কিছুটা বিশ্বেরও) পরিযায়ী শ্রমিকরা যে ভয়াবহ সঙ্কটের গ্রাসে, সেই বিষয়ে লিখিত প্রবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি তাঁরা দু’সপ্তাহের মধ্যে সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে ডিজিটাল পরিসরে পেশ করেছেন।
আরও পড়ুন: গবেষকদের একটু সময় দিন, সব ঠিক হয়ে যাবে
কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রকের অর্থনৈতিক সমীক্ষা (২০১৭) অনুসারে, ২০১১ থেকে ২০১৬’র মধ্যে ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পরিযায়ীর মোট সংখ্যা গড়পড়তা ৯০ লাখ। তাঁদের বেশির ভাগই নির্মাণ শিল্প, পরিবহণ, ছোট বা মাঝারি দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি জায়গায় কাজ করেন, অবশ্যই অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তাঁদের কাজের নিরাপত্তার কোনও প্রশ্নই নেই। থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তও কোনও ক্রমে বেঁচে থাকার বেশি কিছু দিতে পারে না। বস্তুত, নির্মাণ শিল্পের বহু শ্রমিকের আলাদা কোনও বাসস্থানই থাকে না, যে ইমারত তৈরি করছেন সেখানেই তাঁরা রাত কাটান, আর তাই, কিছু কিছু রাজ্যের সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে আপাতত ঘরভাড়া না নেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেই রাষ্ট্রীয় করুণা তাঁদের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক।
কিন্তু এ তো আশি-নব্বই শতাংশ সর্বহারার সাধারণ অবস্থা। পরিযায়ী শ্রমজীবীর একটি বিশেষ সমস্যা আছে, যার কথা সঙ্কলনের শিরোনামেই চিহ্নিত। সেই শিরোনাম— এক মহামারির সীমান্ত— খেয়াল করিয়ে দেয় যে, শ্রমজীবী মানুষ যখন রুজি রোজগারের প্রয়োজনে নিজের ঘর ছেড়ে অন্যত্র যান, তখন তাঁকে অনিবার্য ভাবেই একটি ‘মধ্যবর্তী’ অবস্থান মেনে নিতে হয়। যেখানে তাঁর নিজের জায়গা সেখানে তাঁর কাজ নেই, যেখানে তিনি কাজ করেন সেখানে তাঁর নিজের জায়গা নেই। পরিযায়ীদের এক বিরাট অংশ ক্রমাগত এই দুইয়ের মাঝে চলাচল করেন, অনেকেই বছরে একাধিক বার যাতায়াত করেন কর্মভূমি থেকে স্বভূমিতে, তাঁদের সীমিত আয়ের একটা অংশ নিয়মিত দেশে যায়, পরিযায়ী কর্মীর প্রেরিত অর্থে গ্রামভারতের অগণিত সংসার চলে, অনেক এলাকার অর্থনীতিও। তাঁদের কাজ এবং আয়, কোনওটার গতিই মসৃণ নয়, থেকে থেকেই নানা উপদ্রব আসে, কাজ চলে যায়, আয় কমে যায়। কিন্তু ওই, গরিবের তো হাত গুটিয়ে বাঁচার উপায় নেই। অতএব দিন আসে, দিন যায়।
করোনা সেই ছকটা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। এবং এক লহমায় বুঝিয়ে দিয়েছে, সর্বহারা পরিযায়ীর মধ্যবর্তী অবস্থানটা নিছক ভৌগোলিক নয়, সেটা উৎপাদন কাঠামোয় তাঁর ভূমিকার অন্তর্নিহিত সঙ্কট। সেই সঙ্কটের মূলে আছে ধনতন্ত্র নামক ব্যবস্থাটির স্বধর্ম, যে ধর্ম শ্রমিককে মানুষ হিসেবে দেখে না, দেখতে জানে না, দেখতে পারে না, যার কাছে শ্রমিক শুধু শ্রমিক, আর কিছু নয়। শ্রমিককে মানুষ হিসেবে না-দেখার সেই অমানবিকতাকে— নিতান্ত আক্ষরিক অর্থেই অ-মানবিকতা— সামাল দেয় পরিবার, আর তার সঙ্গে স্বজনবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামের মানুষ। করোনা পর্বেও সেটাই ঘটছে, অনেক দূর অবধি ঘটবেও।
এখানেই কর্মভূমিতে আটকে-পড়া দরিদ্র পরিযায়ীর নিজস্ব সঙ্কট। লকডাউনের অভূতপূর্ব অভিঘাতে তিনি হঠাৎই উপলব্ধি করেছেন, তাঁর রুজিও নেই, গ্রামের আশ্রয়ে ফিরে যাওয়ার পথও বন্ধ। তিনি এই মুহূর্তে এক জন নিখাদ শ্রমিক, যাঁর শ্রমের কোনও বাজার নেই। এখন, হাজার হাজার মরিয়া মানুষের ঘরে-ফেরার অভিযান সামাল দিতে রাজ্যে রাজ্যে ত্রাণ জোগানোর নানান বন্দোবস্ত হয়েছে, আসলে কোনও রকমে লোকগুলোকে জিইয়ে রাখার বন্দোবস্ত। কিন্তু করোনা মোকাবিলার পরিকল্পনায় এই বিপুলসংখ্যক পরিযায়ীর কথা যে আদৌ ভাবাই হয়নি, কেউ ভাবেনি, সেটা একেবারেই পরিষ্কার। এটা কোনও আকস্মিক সমাপতন নয় যে, দেশের প্রধানমন্ত্রী আচমকা একুশ দিনের লকডাউন ঘোষণার পরেই আতঙ্কিত শ্রমিকদের ওই দিশাহারা প্রতিযান শুরু হয়েছিল। এই পরম্পরাই নির্ভুল ভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, রাষ্ট্রের চিন্তায় তাঁরা কোথাও ছিলেন না। থাকেন না।
সমাজের চিন্তাতেও থাকেন কি? এই সঙ্কলনের একাধিক লেখা নানা ভাবে একটি কথা জানায়। সেটা এই যে, পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে কাজ করেন এবং মনের আড়ালে বাস করেন। আমরা তাঁদের দেখেও দেখি না। মাঝের ওই কয়েক দিন দেখতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ তাঁরা নিজেদের অজান্তেই নিজেদের ‘স্পেকট্যাকল’-এ পরিণত করেছিলেন। কিন্তু ওই কয়েক দিনই। তার পর আবার সেই সব কথা আর ছবি অন্তরালে সরে গেছে, ওই দুর্ভাগাদের ভয় দেখিয়ে মেরে ধরে গায়ে কীটনাশক ছড়িয়ে চোখের আড়ালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে মানুষগুলো যেন কোথা থেকে চোখের সামনে চলে আসছেন, যেমন সে দিন ভারতের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’র এক রেল স্টেশনের সামনে আচমকা ভিড় জমালেন তাঁরা, যদি ট্রেন চলে, যে ট্রেন তাঁদের দেশে নিয়ে যাবে— নিজের দেশে। অমনি আবার শোরগোল, আবার মারধর, আবার— ভ্যানিশ।
এই অন্তর্ধানের কথা রণবীর সমাদ্দার লিখেছেন তাঁর ভূমিকায়, ‘‘পরিযায়ীরা যে রকম রহস্যময় ভাবে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন, ক’দিন পরে সেই ভাবেই উধাও হয়ে গেলেন। ব্যাধির মোকাবিলার ছকটিতে পরিযায়ীদের মূর্তিটিকে ঠিক মেলানো যাচ্ছিল না, সেটি জনতার দৃষ্টি থেকে মুছে দেওয়া হল। ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের অন্য নানা বিষয় তাদের অগ্রাধিকার আদায় করে নিল। ভাইরাসের আক্রমণ এবং লকডাউনের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষ (ঘরে ফিরতে চেয়ে) মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছেন— এই দৃশ্য একটা ব্যতিক্রম হয়েই থেকে যাবে।’’
আরও পড়ুন: শিক্ষা হল, আগাম প্রস্তুতি চাই
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy