গত চার সপ্তাহ এই দেশ যে ভাবে ‘তালাবন্দি’ হইয়া ছিল, গতকাল হইতে পশ্চিমবঙ্গ সহ অনেক রাজ্যেই তাহার রূপ কিছুটা পাল্টাইল, অন্তত কাগজে কলমে। কিছু কিছু নির্বাচিত ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করিল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। নিয়ন্ত্রণ কোথায় কী রকম, কোন পর্যন্ত, কখন পরিবর্তনীয়, এই সবই প্রশাসনের সিদ্ধান্ত। সরকারি বিবেচনার উপরই তাহা ছাড়িতে হইবে, গত্যন্তর নাই, থাকিতে পারে না। তবে প্রশাসন যে এই তালাবন্দির বিপুল বিপদ ও ঝুঁকির দিক মাথায় রাখিয়া কিছু জায়গায় ছাড় দিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহা একটি আশ্বাসের বিষয়। লকডাউনের অভিজ্ঞতা হইতে ভারতীয় নাগরিক সমাজ এত দিনে নিশ্চয়ই বুঝিয়াছেন যে ইহা একটি ক্রমান্বিত পদ্ধতি, অল্প অল্প করিয়া, ধাপে ধাপে বাড়াইয়া বা কমাইয়া ইহার নিয়ন্ত্রণ ভিন্ন গত্যন্তর নাই। এত বড় দেশে এমন একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করিতে গেলে প্রশাসনকে নিজের কাঁধে সুবিশাল দায়িত্ব লইতে হয়, বহু রকম সামঞ্জস্য ও সমন্বয় রাখিয়া কাজ করিতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই অনেক ভুল হইবারও সম্ভাবনা থাকে। ভারতে আপাতত এই বিরাট কর্মকাণ্ড যে ভাবে অনুষ্ঠিত হইতেছে, তাহার জন্য যুগপৎ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার প্রশংসার্হ। একই সঙ্গে, দুই প্রশাসনের তরফে যে সকল ভুলভ্রান্তি ঘটিতেছে, তাহার প্রেক্ষিতে সতর্কবার্তা প্রেরণ ও নিরাময় দাবিও অত্যন্ত জরুরি কাজ। এই স্তম্ভে একাধিক বার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের দায়িত্বের দিকে নির্দেশ করা হইয়াছে। তবে কিনা, ইহার পরও আর একটি কথা থাকে— তাহা দেশের সমাজের উদ্দেশে। প্রশাসনের দায়িত্বের মতোই সমাজেরও এই ক্ষেত্রে একটি বড় মাপের দায়িত্ব বহন করিবার কথা, যাহা কিন্তু প্রত্যাশিত মাত্রায় ঘটিতেছে না। অথচ, প্রশাসনের উদ্দেশ্য আদৌ সাধিত হইবে না, যদি সমাজ সর্বান্তঃকরণে প্রশাসনকে অনুসরণ করিয়া না চলে।
বস্তুত, সমাজের দায়িত্ব ঠিক এখনই সর্বাধিক, এই সন্ধিমুহূর্তে। যখন নিয়ন্ত্রণ শিথিল হইতে শুরু করে, তখনই বাড়াবাড়ি ঘটিবার সম্ভাবনা থাকে, আংশিক ছাড়ের সুযোগ লইয়া বেশি ছাড় দাবি করিবার প্রবণতা দেখা যায়। এমনকি গত চার সপ্তাহেও বার বার দেখা গিয়াছে, সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করিয়া বিভিন্ন স্থানে মানুষ ভিড় করিয়া বাজার করিতেছেন, মাস্ক পরিবার নির্দেশ অমান্য করিতেছেন, এক জায়গায় জটলা করিয়া গল্প করিতেছেন। পুলিশ তাঁহাদের তাড়া করিলে, লাঠি চালাইলে যথাবিধি নিন্দিত হইয়াছেন। কিন্তু বিপরীত দিকটিও ভাবিতে হইবে বইকি। এত বার বলা সত্ত্বেও যে নাগরিকরা নির্দেশ শুনিবার প্রয়োজন বোধ করিতেছেন না, তাঁহারা কি সাধ করিয়া সমস্যা ডাকিয়া আনিতেছেন না? যথেষ্ট সহযোগিতা কি বাঞ্ছনীয় ছিল না, দেশের এই অভূতপূর্ব সঙ্কটমুহূর্তে? গত পর্বেই যদি নিয়মভঙ্গের এই দৃষ্টান্ত দেখা গিয়া থাকে, তাহা হইলে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করিবার পর্বে কী ঘটিতে পারে, ভাবিলে উদ্বেগ স্বাভাবিক। নিয়মভঙ্গকারীরা জানেন নিশ্চয়ই, নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দিয়া তাঁহারা কেবল নিজেদেরই বিপন্ন করিতেছেন না— চারি পাশের বহু মানুষকে, বহু অসহায় অশক্ত দুর্বল মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলিয়া দিতেছেন?
লকডাউন পদ্ধতি কেবল দমবন্ধকর নহে, অর্থনীতির পক্ষে মারাত্মক, মানুষের জীবিকা-মানচিত্রের পক্ষে বিধ্বংসী— ইহা আর কোনও নূতন কথা নহে। কিন্তু এই পদ্ধতি যত ভাল ভাবে মানা হইবে, ততই তাহা হইতে বাহির হইয়া আসা সহজ হইবে— এই সার কথাটি মাথায় রাখা দরকার। বিশ এপ্রিল হইতে যে পর্ব শুরু হইল, সেই সময়ে মানুষ যদি দায়িত্ববোধ দেখাইয়া চলাফেরায় রাশ টানেন, একমাত্র তাহা হইলেই হয়তো মে মাসে এই বিষম অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর তবু কিছু ক্ষীণ সম্ভাবনা। মানবিকতার খাতিরে, স্বাভাবিকতার আশায়, সমাজের নিকট এই দাবি নিশ্চয় খুব বেশি চাওয়া নহে।
আরও পড়ুন: হাতে টাকা নেই, একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি, ফেরানোর ব্যবস্থা করুন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy