লকডাউনে স্তব্ধ জনজীবন। -ফাইল ছবি
সংক্রামক করোনাভাইরাস আমাদের এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে— জীবন না জীবিকা, কোনটা আগে? নিঃসন্দেহে তাৎক্ষণিক উত্তরটি হবে আগে জীবন তার পরে জীবিকা। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এই দু’টিই একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে। বেঁচে থাকতে গেলে জীবিকার প্রয়োজন আছে। এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে নিজেদের ও অন্যদের বাঁচিয়ে রাখাটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।
করোনাভাইরাসের দৌলতে ভারতে ঘটে যাওয়া ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া ক্রমপর্যায়গুলির উপরে একটু নজর দেওয়া যাক। গত ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) প্রথম করোনা ভাইরাসের কথা স্বীকার করে নেয় আর প্রতিটি দেশকে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলে। আর সে দিনই কেরল সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, রাজ্যে প্রথম করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব দেখা গিয়েছে একটি ছাত্রের শরীরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা করোনা সংক্রমণকে অতিমারি বলে ঘোষণা করেন। তত দিনে এই সংক্রমণ ব্যাধি ভারতের মানচিত্রে বেশ ভাল ভাবে উপস্থিতি জানিয়ে দিয়েছে। অবশেষে ২৪ মার্চ আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, ২১ দিনের লকডাউন। অবশ্য তার আগে ২২ মার্চ ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল বাড়ানো ও উৎসাহ দানের জন্য বিকেল পাঁচটায় ঘণ্টা ও থালি বাজানোর আহ্বান জানান। ভালও সাড়াও পান সেই আহ্বানে। এত দূর সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু পরের পদক্ষেপগুলি?
১৯ মার্চ অতিমারি ঘোষণার পর থেকে ২৪ মার্চ অব্দি আন্তর্জাতিক উড়ান বহাল তবিয়তে চলাফেরা করল। অবশ্য সরকারের দাবি, এই সময়ে বিদেশ থেকে ফেরা ভারতীয়দের বিমানবন্দরে খুব কড়া নিরাপত্তায় বলয়ের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছিল। সে দিন খুব প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক সীমানাগুলিকে সিল করে দেওয়া আর প্রত্যেকটি বিমানবন্দরকে কোয়রান্টিইন সেন্টার হিসেবে গণ্য করা। বিদেশ ফেরত ভারতীয়দের বাধ্যতামূলক ভাবে বিমানবন্দরগুলিতেই ১৪ দিনের কোয়রান্টিইনের নির্দেশ ও উপযুক্ত চিকিৎসার বন্দোবস্ত। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আশা করা যায়, সংক্রমণকে অনেকটাই প্রতিহিত করা যেত আর হয়তো দেশে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষকে এই লকডাউনের সম্মুখীন হতে হত না। দুর্ভাগ্য , আমাদের সেটা আর হয়ে ওঠেনি। দুর্ভাগ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের, যাঁরা জীবিকার সন্ধানে নিজের বাড়ি ও লোকালয় ছেড়ে অন্য রাজ্যে অস্থায়ী ভাবে বসবাস করছিলেন। ২০০১ সালের জনগণনার ভিত্তিতে আমরা জানি, প্রায় ৩,১৪০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন এই দেশ। তার মধ্যে ২,৬৪০ লক্ষ আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক। শতকরা হিসেবে প্রায় ৮৫ শতাংশ। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ‘রাজা’র কাছে এই তথ্যটি ছিল না বা থাকলেও তা বিচারের মধ্যে আনা হয়নি দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার সময়ে। ‘রাজা’ জানেন না, দিল্লির আশেপাশে যে সব ছোট-বড় কলকারখানা রয়েছে সেখানে অধিকাংশ শ্রমিকই অন্য রাজ্যের। উনি এটাও জানেন না, গুজরাট, রাজস্থানের মার্বেল ও পাথর খাদানের শিল্পগুলিতে অধিকাংশই বাংলা ও বিহারের শ্রমিকেরা কাজ করেন। কোনও সম্যক ধারণা নেই যে, অনেক দশক ধরেই মুম্বই ও আমদাবাদের স্বর্ণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছেন গ্রাম বাংলার শ্রমিকেরা। আসলে ‘রাজা’র যদি চোখ থেকেও অন্ধ সাজতে ভালবাসেন বা কান দিয়ে দেখেন তা হলে প্রজারা কখনই ভাল থাকতে পারেন না। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক মানুষেরা ভাল থাকতে পারেন না। ফলে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও গণমাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার এক করুন চিত্র চোখে পড়ছে।
আরও পড়ুন: সেপ্টেম্বরেই চলে আসছে করোনাভাইরাসের টিকা! দাবি অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীর
‘স্টে হোম, স্টে সেফ’, সোশ্যাল ও ফিজিক্যাল ডিসটেন্স মানার বিজ্ঞাপনের নীচে চাপা পড়ে রইল পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা। দিল্লির আনন্দবিহার বাস টার্মিনাসে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার ভিড়ের ছবি আমাদের অস্থির করে তোলে। কোথায় সোশ্যাল ফিজিক্যাল ডিসটেন্স। শুধু ‘স্টে হোম, স্টে সেফ’ মানা বিলাসিতা ওই শ্রেণির মানুষের কাছে। এই দুর্দশার জন্য ‘রাজা’ শুধু দুঃখপ্রকাশ করে তাঁর দায়িত্ব সেরেছেন। মুশকিল হচ্ছে এই সঙ্কটের সময় এই বিষয়ে চর্চা ও ভাবনাচিন্তাকে ‘রাজনীতি করা’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাজার ‘স্তাবকেরা’ রে-রে করে উঠছেন। যখন আশা করা গিয়েছিল, যে সব ভারতবাসী ও মানবজাতির শত্রু এই করোনাভাইরাস, ঠিক তখনই করোনাভাইরাসের জাত, ধর্ম, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী আবির্ভাব হতে শুরু করল। আলোচনা কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এল এই সংক্রমণের মূল দায় কার— নিজামুদ্দিনের ভিড় নাকি রামনবমীর পালনের ধুম। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এটাও সত্যি যে লকডাউনের মধ্যেও মধ্যপ্রদেশে সরকার গঠন করার প্রক্রিয়ায় লোকের জমায়েত নিন্দুকদের নজর এড়িয়ে যায়। রাষ্ট্র গঠন বলে কথা, সেখানে আবার ভাইরাস আসে কী করে! কি বিচিত্র এই দেশ!
আরও পড়ুন: মহামারি যখন শিয়রে, তখনও এ দেশ ছিল শান্ত, আস্থা রেখেছিল সরকারের উপর
কার দোষ, কার গুণে এই সংক্রমণ দেশে ছড়িয়ে পরল সে বিষয় আলোচনার অবকাশ আর নেই। এখন এই সঙ্কটের সময় কী ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায় তার উপায় ভাবতে হবে। খুব সঙ্গত কারণেই সরকারের তরফে করোনা মোকাবিলার করার জন্য ত্রাণের আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেওয়া ভাল, এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারি রাজকোষেরই অর্থ যথেষ্ট নয়। তবে সরকারি অর্থভাণ্ডার যথেষ্ট হতে পারত, যদি স্বাস্থ্য ও তার পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বাজেটের ব্যয়বরাদ্দ আশানুরূপ হত। আমাদের জাতীয় আয়ের মাত্র ১.২৮ শতাংশ ব্যয় হয় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য যা অন্য গরিব দেশগুলি থেকে অনেকটাই কম। আসলে অপরিকল্পিত ব্যয় ও অপ্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য। তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ না বানিয়ে যদি ৩,০০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল বানানো যেত, তা হলে এই সঙ্কটের পরিস্থিতির কিছুটা হলেও মোকাবিলা করা যেত। দেওয়া যেতে পারত, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক ও যন্ত্র। ভবিষ্যতে এই ধরনের অভাবিত পরিস্থিতির জন্য আমরা কি বলতে পারি না, ‘হসপিটাল ওহি বানায়েঙ্গে’। আগামীর শপথ যদি এটা না হয় তা হলে সেই সঙ্কটকালে ত্রাণ তহবিলের আহ্বান জানিয়ে আবারও ‘একটু সাম্যবাদ’-এর চেষ্টা করা হবে।
এই করোনা মোকাবিলার জন্য নতুন একটি ত্রাণ তহবিল ‘পিএম কেয়ারস’-এর আনুষ্ঠানিক সূচনা মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা জানি, কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ জন্য কেন্দ্রে ‘প্রাইম মিনিস্টার রিলিফ ফান্ড’ আর রাজ্যগুলিতে ‘চিফ মিনিস্টার রিলিফ ফান্ড’ বলে ত্রাণ তহবিল আছে। হঠাৎ কি এমন প্রয়োজন হল, আর একটি ত্রাণ তহবিল খুলে ফেলার। এই নতুন ত্রাণ তহবিলের উদ্দেশ্য কী? তা হলে কি ধরে নিতে হয়, এত দিন ধরে চলে আসা ‘প্রাইম মিনিস্টার রিলিফ ফান্ড’ আর ঠিকমতো দক্ষতার সাথে কাজ করে না। রাজার স্তাবকদের ভাষায় ত্রাণ তহবিল নিয়ে কোনও প্রশ্ন করাকে রাজনীতি করা বলা হচ্ছে। রাজনীতি করার বাসনা নেই , শুধু প্রশ্নগুলি রেখে যাচ্ছি।
পরিশেষে জানিয়ে রাখা ভাল যে, দেশের অর্থনীতিতে ‘দ্য ওয়ার্স্ট ইজ ইয়েট টু কাম’। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে আবার সচল করতে বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। কারণটা খুবই সহজ। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট ব্যবসা ও কলকারখানাগুলি উৎপাদন বিহীন হয়ে পড়ে রয়েছে। কিন্তু এ সব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মচারীদের বেতন দিয়ে যেতে হবে, অন্তত মানবিকতার খাতিরে। দিতে হবে বিদ্যুতের বিল, করের টাকা— আজ না হোক কাল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কত দিন এটা সম্ভব হবে। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নেমে আসতে চলেছে মর্মান্তিক দুর্যোগ, কাজ হারানোর যন্ত্রণা। একই বেকারত্বের হার ঐতিহাসিক ভাবে সবচেয়ে বেশি এই সময়। তার উপরে এই লকডাউনের জন্য লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কর্মহীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে সরকারের নীতি কী হতে পারে? অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দাবি করে খুব কঠিন, কিন্তু মানবিক সরকারি পদক্ষেপ। আগামী দিনে সরকারের উচিত সব রকম করের ছাড় বা ‘ট্যাক্স হলিডে’। লকডাউনের দরুন কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের ন্যূনতম আয়ের অঙ্গীকার ও অত্যাবশ্যক খাদ্যসামগ্রী তাঁদের ঘরের দোরে পৌঁছে দেওয়া। বাজারে সুদের হার আর না কমিয়ে প্রবীণদের স্বস্তির আশ্বাস দেওয়া। আর বিশেষ ভাবে দরকার সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো, যার অর্থ আসতে পারে অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে।
এ তো গেল কেন্দ্রে সরকারের কথা এ বার একটু রাজ্যের দিকে তাকানো যাক। সীমিত ক্ষমতার উপর দাঁড়িয়ে এখনও অব্দি যে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যবীমার পদক্ষেপ। এই সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর অভব্য আচরণ কোনও ভাবেই কাম্য নয় এবং সেটা নিন্দনীয়। কিন্তু সঙ্গে এটাও আক্ষেপ থেকে যায় যে, উপযুক্ত পোশাক ও পরিকাঠামোর অভাব ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর এই বিষয়ে ডাক্তারবাবুরা উষ্মা প্রকাশ করলে তাদের হয়রানির ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে। করোনার পরীক্ষার হার অনেকটাই কম এই রাজ্যে। তাই হয়তো আক্রান্তের সংখ্যাও কম। ইদানীংকালে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা নিয়েও নানা অভিযোগ উঠছে। এই অভিযোগ না ওঠাই কাম্য।
যা শোনা যাচ্ছে, লকডাউন আপাতত উঠবে না। তবে এই ক’দিনে আমরা দেখলাম বেশ কয়েকটি এলাকায় নাগরিকেরা লকডাউন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেননি। সে ক্ষেত্রে পাড়ায় পাড়ায় সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবগুলিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কারণ, এই বঙ্গে এক একটি ক্লাব ‘সিধু জ্যাঠাদের’ আখড়া। যদুবাবুর পরিবারের ছেলেমেয়েরা কোথায় থাকেন, বা মধুবাবুর পরিবারের কাজের পরিচারিকা কোথা থেকে আসেন বা তাঁর স্বামী কী করেন সব তথ্যই প্রায় এই ক্লাবগুলির নখদর্পণে। এই তথ্যগুলিকে কাজে লাগিয়ে লকডাউনের উপরে নজর রাখা প্রশাসনের পক্ষে খুব সহজ হবে। তবে এখানেও এক বিপদের আশঙ্কা আছে। অতি উৎসাহী ক্লাবের দাদা-দিদিরা অনুপ্রাণিত হয়ে চাঁদা তুলে ‘করোনা উৎসবের’ সূচনা করে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। যে সব এলাকায় উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নেই, সেই সব জায়গায় এই অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাব ঘরগুলিতে কোয়রান্টিইন সেন্টার হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্তত সান্ধ্য আড্ডা, তাস, ক্যারম খেলার ভিড় কমবে। একই সঙ্গে এই সময়ে মিষ্টির দোকানগুলি খুলে দেওয়া, অল্প সময়ের জন্য হলেও, কি যুক্তিযুক্ত? ভাবা দরকার।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy