জনশূন্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন। —নিজস্ব চিত্র
পঞ্চাশ বছর আগে কবি মণীশ ঘটক জানতে চেয়েছিলেন, “এখনও বিশ্বাস করো লিখে কিছু হবে, ছবি এঁকে গান গেয়ে, মঞ্চে ও পর্দায় পুজা পালে পরবে উল্লাসে হৈ-চৈ-য়ে?” পঞ্চাশ বছরে দেশ এগিয়েছে অনেকটা না কি পিছিয়ে গিয়েছে কয়েক শতক সে তর্ক করেও কিন্তু জেলার সাহিত্যিকরা ভরসা রাখছেন সৃষ্টিতেই। করোনা ভাইরাসের হাত থেকে রেহাই পেতে রাষ্ট্রের ঘোষণায় পঞ্চাশ দিনের বেশি তালাবন্দি হয়েছে দেশ। বন্ধ হয়ে গিয়েছে কত মানুষের রোজগার। কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও সাইকেলে, কখনও লরি, ছোট গাড়িতে ঝুলতে ঝুলতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জেলার পরিযায়ীরা ফিরে আসছেন প্রতিদিন প্রতিরাতে মরিয়া হয়ে নিজের ঘরে। বাইরে না খেতে মরার চেয়ে নিজের ভিটেতে মরা শান্তির এই বিশ্বাস নিয়ে প্রতিদিন ভোর হচ্ছে কত মজুরের। ইতিমধ্যে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কত শ্রমিকের।
তার প্রভাব কি সাহিত্যিকের মনে পড়ে না? তাঁর কি লিখতে ইচ্ছে করে না, কী ভাবে এই সব খোয়ানো মানুষের দল কত দূরের রাস্তা হেঁটে ফেরেন শুধু ফেলে আসা বাড়িটার কথা ভেবে!
লকডাউনের জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে জেলার সাহিত্যিকদের আড্ডা, আলোচনাও। অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে সাহিত্যিকরা সে সবই লিখে রাখছেন কেউ কবিতায়, কেউ গদ্যে। লিখে কিছু হোক আর না হোক, লিখে রাখতেই হবে সমাজের ছবি। আর না লিখলে তো আরও কিছুই হবে না বলছেন কবি ও সম্পাদক শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু নিজের জেলায় নয়, নিজের রাজ্যে নয়, নিজের দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের যাবতীয় যা কিছু ঘটনা মানুষের বেঁচে থাকায় যখনই সঙ্কট তৈরি করেছে, তখনই আলোড়িত করেছে অনুভূতি প্রবণ এই সব মানুষগুলোকে, সে সবই লিখে রেখেছেন লিখেও রাখছেন সাহিত্যিকরা কেউ কবিতার ছন্দে, কেউ গদ্যের। মুর্শিদাবাদ জেলাও তার ব্যতিক্রম নয়।
সাম্প্রতিক কালের এনআরসি, এনআরপি বিরোধী আন্দোলনে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন অরাজনৈতিক সঙ্ঘ। সাদা কাগজ ভরিয়ে দিয়েছেন প্রতিবাদী অক্ষরে। লিখে ও প্রতিবাদে হয়তো নড়েনি জগদ্দল পাথর, সাময়িক হতাশা সামলে আবার কালিতে কলম ডুবিয়ে লিখেছেন স্বর্ণাক্ষর, অনেকেই। কালের নিয়মে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, মণীশ ঘটক, মহাশ্বেতা দেবী, নারায়ণ ঘোষ, বিমল চক্রবর্তী, শুভ চট্টোপাধ্যায়, পম্পু মজুমদার, দিব্যেশ লাহিড়ী, নিরুপমা দেবী, মৃণাল দেবী, প্রফুল্ল গুপ্ত, সুশীল ভৌমিক, কমল বন্দ্যোপাধ্যায়দের লেখা জেলা ছাড়িয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের কৃষ্টিকথা। সেই ধারা বজায় রেখেছেন আবুল বাশার, উৎপল গুপ্ত, সৈয়দ খালেদ নৌমান, সন্দীপ বিশ্বাস, নাসের হোসেন, অরূপ চন্দ্র, নিহারুল ইসলাম, শ্যামল সরকার, নীলিমা সাহা, গীতা কর্মকারেরা। এঁদের হাত ধরে অথবা অন্য কারও হাতে এক সময় জেলা জুড়ে লিটিল ম্যাগাজ়িনের দাপট দেখেছে বাংলা। ‘বর্তিকা’, ‘জলসিঁড়ি’, ‘সময়’, ‘অনীক’, ‘ঝড়’, ‘গণকণ্ঠ’ ‘রৌরব’, ‘সংবাদ স্বকাল’, ‘অমলকান্তি’, ‘সমিধ’, ‘অঙ্গাঙ্গী’, ‘ছাপাখানার গলি’, ‘আবার এসেছি ফিরে’, ‘সহজাত’, ‘বিক্ষণ’ ‘বাসভূমি’, ‘অর্কেষ্ট্রা’ সহ কতশত কাগজ। যেগুলো আলোড়ন ফেলেছে কালের ইতিহাসে, নাড়িয়ে দিয়েছে বঙ্গসমাজকে। ‘গণকণ্ঠ’ ছাড়া যে দুটি সংবাদপত্র একসময় জেলা তথা রাজ্য জুড়ে আলোড়ন ফেলেছিল তা হল “সংবাদ স্বকাল” “ঝড়”, “বিক্ষণ”। শুভ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সংবাদ স্বকাল’ যে ঝড় তুলেছিল সংবাদ পরিবেশনে, সম্পাদকের অকাল মৃত্যুর পর তা চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পরবর্তী সময়ে রবীন বিশ্বাস ‘ঝড়’ পত্রিকাকে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে না রেখে আমজনতার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ক্ষেত্র সমীক্ষা করে বহু অন্ধকার ইতিহাসের উপর ফেলেছিলেন “আলোকপাত”। আর সে সব করতে গিয়ে কখন যে শরীর ভেঙে গিয়েছে খেয়াল করেন নি তিনি। ‘ঝড়’এর দাপট রেখেই অকালে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। সংবাদ সাহিত্য পত্রিকা ‘ঝড়’ এখনও প্রকাশিত হয় সপ্তাহান্তে চন্দ্রপ্রকাশ সরকার, আবদুর রউফ, অংশুমান রায়ের হাত ধরে। লকডাউনের ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেই পত্রিকা প্রকাশনার কাজও। ঝড়ের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য চন্দ্রপ্রকাশ সরকার বলছেন, “কবে লকডাউন উঠবে জানি না। লকডাউন না উঠলে সেই পত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেই লেখালিখির মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়কে ধরে রাখার অক্ষম চেষ্টা চালাচ্ছি।”
পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গিয়েছে কত কাগজ, খুঁড়িয়ে চলছে কিছু, শর্ত পরিবর্তন করে কেউ কেউ বাৎসরিক কিংবা ষান্মাসিক সংখ্যায় সাজিয়ে রাখছেন ঘাম রক্ত ঝরিয়ে তৈরি করা সেই কাগজখানি। বছর দশেক আগে দাদা অপূর্ব ভট্টাচার্যের মৃত্যূর পর “জলসিঁড়ি” পত্রিকার দায়িত্ব তুলে নেন অনুপম ভট্টাচার্য। তবে বছরে চারটে সংখ্যার বদলে এখন তা বছরে দুটি প্রকাশিত হয়। লকডাউনের ফলে পত্রিকার কাজ শেষ হয়েও শেষ মুহুর্তে প্রকাশিত হয়নি ‘জলসিঁড়ি’র বৈশাখী সংখ্যা। সম্পাদক অনুপম ভট্টাচার্য বলছেন, “এই পরিস্থিতিতে ছাপাখানা বন্ধ। শারদ সংখ্যা প্রকাশের সময়ও চলে আসছে। ভাবছি বৈশাখী সংখ্যাটি অনলাইনেই প্রকাশ করব। তারই প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
তবে কালের নিয়মে বহরমপুর তথা জেলার সাহিত্যচর্চায় ভাটা পড়েছে। কলমের ডগায় নয়, কি-বোর্ডের দাপাদাপিতে সাহিত্য হয়েছে আজ যন্ত্রমুখী। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের প্রভাব পড়েছে লেখকদের সৃষ্টিতেও। আগের মত ঘনঘন সাহিত্যসভা এখন আর হয় না। যা কিছু হয় তা ওই ভার্চুয়াল জগতেই। সেখানেই চলে ছন্দপতন থেকে ছন্দগড়ার বিশ্লেষণ। অথবা গল্প লেখার প্রতিযোগিতা। তবে দেশজোড়া লকডাউনের প্রভাব পড়েছে সেই সব লেখকদের অনেকের মধ্যেই। কবি দেবাশিস সাহা বলেন, “লিখতেই পারছি না। জীবন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এলোমেলো হয়ে গিয়েছে সব। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।”
লোকসংস্কৃতির ওপর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি কৌশিক বড়াল কবিতাও লেখেন। তাঁর মত তবে অন্য। কৌশিক বলেন, “লকডাউনের ফলে হাতে কিছু বাড়তি সময় পেয়েছি। আমার বেশ কিছু লেখা বাকি ছিল সেগুলি শেষ করতে পেরেছি।” করোনা আতঙ্কে নানা ধরনের খবরা খবরে মানুষের মধ্যে একধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে বলে মেনে নিচ্ছেন অমলকান্তি পত্রিকার সম্পাদক শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চাশদিন ধরে সেসব অনুধাবন করে সাদা কাগজে আঁকি বুকি কাটতে কাটতেই লিখতে শুরু করেছেন ধারাবাহিক গদ্য। তরুণ গল্পকার সৌরভ হোসেন বলছেন, “ লকডাউনের অবসরে নতুন উপন্যাস লিখতে শুরু করেছি।” গল্পকার নিহারুল ইসলাম বলছেন “ সব ক্ষেত্রে লিখে হয়ত কিছু হয় না আবার কিছু ক্ষেত্রে তো হয়। দীর্ঘ অবসরে সকাল থেকে বেশ কিছু বই পড়ছি। এই সময় ফিরে পড়লাম কামুর ‘দ্য প্লেগ’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy