ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
যে কোনও পুরনো হয়ে যাওয়া স্বামীই জানে স্ত্রী মিষ্টি করে কোনও কথা বলছে মানে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। সে রকমই মিষ্টি সুরে লকডাউনের তিন-চার দিনের মাথায় স্ত্রী আমায় জানায় যে আমার ভায়রাভাই ওর দিদির রান্না করে দিচ্ছে।
‘‘তুমি দু’বেলা করে অন্তত একটু বাসনকোসন মেজে দাও না গো!’’
আমি আঁতকে উঠি। আমাদের কাজের মাসির বাড়ি আমাদের ফ্ল্যাটের পাশেই। একেবারে হাত বাড়ালেই বন্ধু। তিনি তো রোজই কাজে আসছেন। সুতরাং, আলাদা করে আমার বাসন মাজার কোনও কারণ নেই। তার উপরে চিকিৎসক বলে লকডাউনে আমার তো ঘরে বসে থাকারও উপায় নেই। হাসপাতাল থেকে কড়া নির্দেশ আছে, এই সময়ে কাজে ডুব মারা— নৈব নৈব চ। সুতরাং, অন্য স্বামীদের মতো ওভারটাইম করার প্রশ্ন আসছে কেন?
আমি যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেও অর্ধাঙ্গিনী বুঝতে নারাজ। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে তার বান্ধবীরা প্রতিনিয়ত জানিয়ে যাচ্ছে যে তাঁরা কত গৃহকর্মনিপুণ স্বামী পেয়েছেন! গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আমার ভায়রাভাই তাঁর রান্না করার ভিডিয়ো ফেসবুকে ছেড়ে বসে আছেন। স্বাভাবিক ভাবেই আমার স্ত্রীয়ের হিংসায় নীল হয়ে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়।
এমনিতেই হাসপাতালে ডিউটি করি বলে পাড়ায় এবং ফ্ল্যাটে কিছুটা ব্রাত্য হয়ে আছি এই সময়ে। পাড়া-প্রতিবেশীদের বদ্ধমূল ধারণা, আমি হাসপাতাল থেকে ফেরার সময়ে আমার স্টেথোস্কোপ রাখার ব্যাগে করে এক ব্যাগ করোনাভাইরাস যত্ন করে নিয়ে বাড়ি ফিরি। পড়শিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল। কিন্তু লকডাউনে আমার অবস্থা শোলের গব্বর সিংয়ের মতো হয়ে গিয়েছে। একেবারে ভিলেন!
এখন না ঘুমোলে পাড়ার বাচ্চাদের মায়েরা বলেন— ‘‘শো যা, নেহি তো ডাক্তারবাবু আ জায়েগা।’’
কারও সঙ্গে আচমকা রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংয়ের মাত্রাটা এক মিটার থেকে বাড়িয়ে দুই মিটার করে নেন। মাস্কের উপরে হাত চাপা দিয়ে আমার সঙ্গে দু’একটা কথা বলেই পড়িমরি করে পালিয়ে যান।
বাড়িতে ঢুকেও নিস্তার নেই। স্নান না করে প্রায় ঘরে নিঃশ্বাসটুকুও ফেলা যাবে না। এবং যত বার হাসপাতাল থেকে ফিরব, তত বারই স্নান মাস্ট। সাধারণত দিনে দু’বার করে হাসপাতাল যেতে হয়। দু’বার স্নান তবু মেনে নিচ্ছিলাম। অ্যাডমিশন ডে-র দিন রাত্রি দু’টোর সময়ে বাড়ি ফিরে দেখি গৃহিণী গামছা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর আগে আমার চার বার স্নান সারা হয়ে গিয়েছে সে দিন। আমার প্রায় হাতেপায়ে ধরার অবস্থা, এ বার স্নান করলে করোনায় না মরে নিউমোনিয়ায় মারা যাব। আর আমি তো সার্জারির ডাক্তার, সংক্রামক রোগী থাকা ওয়ার্ডে আমাদের খুব প্রয়োজন ছাড়া যেতে হয় না। সারা গায়ে স্যানিটাইজার মেখে ছাড়া পেয়েছিলাম সে দিন রাতদুপুরে।
লকডাউনের সময়ে একটু বেলা করে রাউন্ড দিই। সব কিছু চলছে বেশ ঢিমেতালে। এমার্জেন্সি অপারেশন ছাড়া অহেতুক অপারেশনের ঝুঁকি কেউ নিচ্ছেন না। কিন্তু অপারেশন থিয়েটারে না ঢুকলে সার্জনদের হজম-টজমের গোলমাল দেখা দেয়। সুতরাং, দূরত্ব বজায় রেখে তিন-চার জন আড্ডাবাজ ডাক্তার ওটিতে ঠিকই উপস্থিত হচ্ছেন। মাস্কের আড়াল থেকে অধুনা ভাইরাল হয়ে যাওয়া সেই বিখ্যাত ডায়ালগটাও দিয়ে বসছেন কেউ— ‘‘আমরা কি চা খাব না?’’ সিস্টার দিদিরা মায়ের জাত, রাগ করলেও ফ্লাস্ক থেকে ঠিক চা ঢেলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আড্ডার বিষয় অধিকাংশ সময়েই করোনাভাইরাস।
আসলে ডাক্তারদের সোশ্যাল মিডিয়ার গ্রুপগুলোয় এখন হট টপিক করোনাভাইরাসের স্বভাবচরিত্র। আর এ রকম ‘চরিত্র’হীন জীবাণুর মুখোমুখি এর আগে এই প্রজন্মের ডাক্তারেরা হননি। মহিষাসুরের মতো মুহুর্মুহু রূপবদল করতে ওস্তাদ কোভিড ১৯। ব্যাটাকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। এ যেন— ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকঃ।/ ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।’’ অস্ত্র দিয়ে একে বিনাশ করা যায় না, আগুন পোড়াতে পারে না, জল ভেজাতে পারে না আর বায়ু শোকাতেও পারে না। গীতার আত্মার ডেফিনেশনের মতো অবিনশ্বর হয়ে বসে আছে করোনাভাইরাস। সেই আড্ডায় সত্য-মিথ্যা পোস্টগুলোর কাটাছেঁড়া হয়।
আর দিনরাত মিটিং তো লেগেই আছে। বিশেষ করে, স্বাস্থ্যভবনের সঙ্গে মিটিংগুলোর পরিবেশ ভূতের গল্পের মতো গা-ছমছমে। অন্ধকার ঘর। এ দিক-ও দিক করে খানদশেক ডাক্তার মুখোশ পরে বসে আছেন। জুমের মাধ্যমে সাদা দেওয়ালে স্বাস্থ্যভবনের বড়কর্তাদের মুখ। অন্ধকারে ঘুমিয়ে নেওয়ারও উপায় নেই। কলকাতার স্ক্রিনেও যে এক কোণে ছোট্ট করে আমাদেরকে দেখা যাচ্ছে। নতুন নতুন নির্দেশ আসছে। নির্দেশের পিছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হচ্ছে। তার পরে আবার জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক অন্য সমস্ত ডাক্তারকে নিয়ে বসছে। জেলা প্রশাসনের তরফে উপস্থিত থাকছেন বিভিন্ন আধিকারিক। আসলে লড়াইটা যে মানুষের সঙ্গে মৃত্যুর। সব মানুষ সত্যিই এককাট্টা হয়ে লড়তে চাইছেন। এর মধ্যে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সেগুলির মোকাবিলা করার কথাও ভাবতে হয়।
বেপরোয়া কিছু মানুষ পথে বেরোচ্ছেন। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। কারণ, সার্জারি ডিপার্টমেন্টের হিসাব অনুযায়ী প্রতি দিন দশ-পনেরোটা করে অ্যাক্সিডেন্টের রোগী আসছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ-ছয় জনের অবস্থা বেশ খারাপ থাকছে। খুব খারাপ রোগীদের, যাঁদের মস্তিষ্কে বা ফুসফুসে আঘাত থাকছে, তাঁদেরকে বড় জায়গায় পাঠানো যাচ্ছে না। কী করে যাবে, সেখানে গিয়ে আদৌ বেড পাবেন কিনা, বেড পেলেও ডাক্তার পাবেন কিনা— এ সব বেয়াড়া প্রশ্নগুলো রয়েই যাচ্ছে। আবার রোগীকে রেখে দিয়ে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা করলেও অন্য রকম দুর্ভাবনা থাকছে। পরে যদি প্রশ্ন ওঠে নিউরোসার্জারি বা কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি করার পরিকাঠামো নেই জেনেও কেন আপনি জেলা হাসপাতালে রোগীকে রেখে দিলেন এবং মৃত্যুর কারণ হলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারব না। ডাক্তারদের এখন বিশাল একটা ভয়ের জায়গা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা। তাই মধ্যপন্থা নিয়ে রোগীর আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে— রোগীর অবস্থা খারাপ। তার সঙ্গে রেফারও লেখা থাকছে। নিজেদের মতো করে চিকিৎসা কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না।
লকডাউনে আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। পারিবারিক মারপিট যেন এই অস্থির সময়ে পছন্দের পাসটাইম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আক্রমণের শিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলা। কর্মহীনতা কি নৃশংসতা বাড়িয়ে দেয়? লকডাউন তখন দিন দশেক গড়িয়েছে। ভোর রাতের দিকে এক জন রোগিণী এলেন। সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন। মাথার উপর থেকে একটি ক্ষত নেমে এসেছে কপাল পর্যন্ত। গভীরতা ছুঁয়েছে খুলির হাড় পর্যন্ত। তাঁর বীরপুঙ্গব স্বামী মারধর করেছে। সেলাই দিতে দিতে নিস্তেজ হয়ে আসা মহিলাকে পরামর্শ দিই, নিজের বাবা-মার কাছে পালিয়ে যাওয়ার। গরিব বাবা-মায়ের বোঝা হতে চান না মহিলা। আর পালিয়ে-ই বা যাবেন কোথায়? চতুর্দিকে সমাজের দেওয়াল আছে না? দেওয়ালে তো পিঠ ঠেকে যাবেই। এক জন অসহায় নারী কত দূর দৌড়ে পালাতে পারেন? আমাদের সমাজে নারীর কাছে পৃথিবীটা বড় ছোট।
বিকেলের দিকে কোনও কাজ থাকে না। ব্যালকনি দিয়ে দেখি আকাশে রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়ে বেরাচ্ছে। এক দিন কেটে যাওয়া একটা ঘুড়ি হাতে এল। ছেলে-মেয়ে ভীষণ উত্তেজিত— ‘‘বাবা, ঘুড়ি ওড়াতে পার?’’
আমাদের ছেলেবেলাটা অন্য রকম ছিল। পড়াশোনা নিয়ে ইঁদুরদৌড় ছিল না। ছুটির দুপুরে ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো ছিল, বিকেলবেলায় খেলার মাঠ ছিল, রাতে ঠাকুমার কোলের ভিতর সেঁধিয়ে ভূতের গল্প শোনা ছিল। আমাদের ‘ছিল’র তালিকাটা বেশ লম্বা। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ফ্ল্যাটের ছাদে চলে গেলাম। প্রথম দিকে না পারলেও কিছু ক্ষণের চেষ্টায় ঘুড়ি আকাশে উড়ল। চতুর্দিকে— ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা / আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক মাটিতে অবজ্ঞা।’
বেশি ক্ষণ আকাশে থাকা হল না, একটা ঢাউস ঘুড়ি আমারটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছেলে-মেয়ে দুই পাশে লাফাচ্ছে। ‘‘বাবা, তুমি বাঁ-দিক থেকে ডান দিকে টান’’— মেয়ে বলে ওঠে। ছেলে বলে, ‘‘না, তুমি উপর থেকে নীচে নামাও।’’ দুই সন্তানের পরামর্শের মাঝে আচমকা ভোকাট্টা করে আমার ঘুড়ি কেটে যায়। ভাসতে থাকে হাওয়ায়।
কেটে যাওয়া ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে মেয়ে জিগ্যেস করে— ‘‘ঘুড়িটা কোথায় যাচ্ছে বাবা?’’
মানসচক্ষে দেখতে পাই কবীর সুমনের গানের সেই ছেলেটা ঘুড়িটা ধরতে ছুটছে। এই লকডাউনের বাজারে তাকে যে আর রিকশা চালাতে হচ্ছে না।
আমি চুপিচুপি মেয়েকে বলি— ‘‘আমার ছেলেবেলার কাছে ঘুড়িটা পালিয়ে যাচ্ছে। ওইইইই দ্যাখ!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy