কাগজে কিছু দিয়েছে? কোন জ়োনে আছি? রেড না অরেঞ্জ? পাশের পাড়ায় এক জনকে নিয়ে গেছে না? পজ়িটিভ এসেছে? বাড়ির লোক কি হোম আইসোলেশনে? তা হলে তো আমাদের এলাকাও সিল করবে? টিভিতে বলছে, সব পাওয়া যাবে। ফোন করলে বাড়িতে খাবার পৌঁছে যাবে। যাবে তো? এ সব জানলে চাল আর একটু বেশি করে কিনে রাখতাম! মাছ রোজ খাওয়া হচ্ছে না। ডিম, সয়াবিন দিয়ে মেক-আপ দিতে হচ্ছে। কত দিন চলবে লকডাউন? কোনও খবর আছে? সপ্তাহে এক দিন বাজারে যাচ্ছেন কেউ। কেউ আবার রোজ। এত কড়াকড়ি কেন? ব্যারিকেড করেছে এখানে ওখানে। আরে ব্রিটেনের রাজপুত্র থেকে প্রধানমন্ত্রী রক্ষা পাননি! আমরা কোন ছার? চিন্তা করে লাভ নেই। চিনেরা ইঁদুর বাদুড় খেয়ে সব্বাইকে ডুবিয়ে দিয়েছে। ওদের শাস্তি হবে না? আমেরিকাও কি কম? আমাদের হুমকি দিচ্ছে!
রিকশাওয়ালার পাঁচ টাকা বেশি চাই। “দিদি, টাকাটা চেয়েই নিচ্ছি। বুঝতেই পারছেন। আয় নেই একেবারে।” এই দুঃসময়ে দিদিরও পাঁচ টাকা অতিরিক্ত দিতে আপত্তি নেই। কাজের মাসি ভয়ে আছেন। দাদা খারাপ লোক নন। তাও বসিয়ে-বসিয়ে কত দিন মাইনে দেবেন? দাদা অবশ্য দিতে রাজি। মাসির ছোট দুটো নাতনি আছে না? এটিএম-এ গেলে কিছু টাকা হাতে আসে। গ্লাভসটা কোথায় গেল? মাস্ক আর গ্লাভস তো পরা হল। মাথাটা কি ঢাকতে হবে? দায়সারা করে হাত ধুলে হবে না। কুড়ি সেকেন্ড বলেছে না? সাবান কোথায়? খুচরো টাকাপয়সা ধুয়ে শুকোতে দেওয়া আছে। উড়ে না যায়।
মেয়েকে বলা আছে। অনলাইনে স্লট খুঁজছে সারা দিন। বাবা মা তো ও-সব পারেন না। স্লট যদি পাওয়া যায়, পাঁচ মিনিটের মধ্যে অর্ডার দিতে হবে। কার্টে আগে থাকতেই চাহিদা জমিয়ে রাখা দরকার। নুডলস দু’প্যাকেটের বেশি দিচ্ছে না। আনাজপাতি, ফল সব ধুয়ে নিয়ে রোদে দিতে হবে। ডালের প্যাকেটও। ক’দিন? তিন দিন তো মিনিমাম। আগে শোনা যাচ্ছিল, টেম্পারেচার সত্তরের উপরে উঠলে ভাইরাস সইতে পারে না। এখন তো সবই বদলে যাচ্ছে। ‘হিট অ্যান্ড হিউমিডিটি’ তত্ত্ব কাজে দিচ্ছে না। ফেসবুকে অনেক ঠাট্টা, অনেক করুণ অধ্যায়। তবু অনন্ত অবকাশে সেখানেই চোখ রাখা।
আরও পড়ুন: বিষাক্ত
মণ্ডলবাড়িতে জেঠু-জেঠিমা দুজনেই সিনিয়র সিটিজ়েন। ছেলেকে বলতে হবে, যদি ডিম-টিম লাগে, এনে দেবে। কার বাড়িতে যেন হাঁড়ি চড়ছে না। যাকগে, যদি পাড়ার ছেলেরা একশোটা টাকা চায়, দিয়েই দেওয়া যাক। কত কাজেই তো কত খরচ হয়? এ বার পয়লাতে বাচ্চাটারও নতুন কিছু হল না। আচ্ছা, পুজোটাও এই ভাবেই যাবে নাকি? স্যালারি কেটে নেবে? ইএমআই গুনতে হয় যে! এখন না দিলে, পরে ইন্টারেস্ট দিতে হবে পাহাড়প্রমাণ।
ভাইরাসের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি লড়ছেন, তাঁদের কথা ভাবলেও ভয় করে। নিজেদের জন্যে শুধু নয়, তাঁদের জন্যে, তাঁদের পরিবারের জন্যেও। তাই বলে পাড়ায় ঢুকতে দেবে না? এখানে তো তাঁদের নিজেদের পরিবারও আছে, না কি? হ্যাঁ, জিনিসপত্র খুব বুঝে খরচ করতে হবে। টাকাপয়সাও। ভবিষ্যতে কপালে কী আছে, কে জানে?
আশ্বাস মিলছে। এটাই আশ্চর্য, এখনও আশ্বাস মিলছে! শুধু সরকারি তরফে নয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে। প্রতিবেশীর তরফে। এই প্রথম বোঝা যাচ্ছে, দূরে থেকেও পাশে লোকজন আছে। এখনও, এই দুর্দিনেও আছে। সেই মজুরদের পাশে আমরাও যেন থাকি, যাঁরা রাস্তায় হাঁটছেন। যাঁরা প্রবাসে বড় একা হয়ে গিয়েছেন। টিভিতে চোখ থাকছে সারা দিন। আলোচনা, সাংবাদিক সম্মেলন। ক’জন অ্যাক্টিভ? ক’জন ছাড়া পেলেন? ক’জনকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারলাম না? গ্রাফটা একটু নামল কি? নাঃ, আবার উঠে যাচ্ছে। বিকেলে জলখাবার কী হবে? চা’টা দেরি করে খাচ্ছি। এক বারে রাতের খাওয়া সেরে ফেললে বিকেলে আর খেতে হবে না।
পড়াশোনা কবে থেকে বন্ধ। বাচ্চাগুলো যে বইখাতাও ভালবাসে, আগে কে জানত? নিজে থেকেই বই নিয়ে বসছে। ঘ্যানঘ্যান করছে। মাস্টারমশাই, দিদিমণিরাও ব্যাপারটা বুঝেছেন। টিভিতে পড়াচ্ছেন। অনেকে তো বাড়ি থেকেই অনলাইন পড়িয়ে দিচ্ছেন। বাড়ি ফিরতে আগে কত তাড়া ছিল। এখন সেই বাড়িতেই দম আটকে আসে। বিকেলে ছাদে এক বার যেতেই হবে। “দিদি, শুনেছেন, বোসবাড়ির চুমকির বিয়ে ছিল। বাতিল হয়েছে। কবে হবে, কে জানে?” এমন কোনও জায়গা আছে, যেখানে ভাইরাস নেই? কাল ঘুম থেকে উঠে হয়তো দেখব সব ঠিকঠাক? লকডাউন উঠলেই বা কী? লোকে তো হু-হু করে বেরিয়ে পড়বে। তখন একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড।
বাড়ির মানুষগুলো কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। কেমন রাগি-রাগি। কেমন স্বার্থপর। এমনই কি ছিল বরাবর? কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে গ্লানি গ্রাস করতে পারে না। করে কি? কিছু কিছু ক্ষেত্রে করেও বোধহয়। কাজ শেষ হলে গান গেয়ে বা ছবি এঁকে ফেসবুকে আপলোড করতেই হবে। গল্পের বই পড়ার, নিজের কথা লেখার অঢেল সময়। হচ্ছে না। মনই বসছে না। বইয়ের তাক থেকে অবশ্য নেমে এসেছেন শরদিন্দু, লীলা মজুমদার, সুবোধ ঘোষ। লাইনগুলো তবু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অবসর অখণ্ড হয়ে মনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে দুশ্চিন্তা।
ভাইরাস চলে যাবে। কাল নতুবা পরশু তো যাবেই। হতে পারে কয়েক মাস। বছরও ঘুরে যেতে পারে। সমুদ্রতীর প্লাবিত করে ঢেউ যখন ফিরে যায়, কেমন লাগে? সব কিছু শূন্য হয়ে যায়? এমন কিছু কি পড়ে থাকে, যাকে স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না? আধখোলা জানলা দিয়ে ফাঁকা রাস্তা দেখার সময়টা খুব অদ্ভুত। আনন্দের; কষ্টেরও। সে সব ভোলা যাবে না। মনে করতেও চাই না। সব মিলিয়ে শিক্ষা হল কি আমাদের? ‘সভ্যতা’র ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে।
আরও পড়ুন: ভোট রাজনীতির রসদ জমাতে এ বার তৎপর হচ্ছে সকলেই
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy