করোনাভাইরাস অতিমারি রুখতে ভারতে তৃতীয় বার লকডাউনের ঘোষণা হল। চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন অগণিত মানুষ। প্রশ্ন উঠছে, এর কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? যদি অসুখকে তার নিজের পথে হাঁটতে দেওয়া হত, কী ক্ষতি হত? গোটা মানবজাতিই কি তাতে মুছে যেত? নিশ্চয়ই না, কারণ যখন বিজ্ঞানের এত অগ্রগতি হয়নি, প্রতিষেধক আবিষ্কারই হয়নি, তখনও তো ভাইরাস ছিল। বস্তুত ভাইরাস পৃথিবীতে এসেছে ৫০ লক্ষ বছর আগে। মানুষ আসতে তখনও অনেক দেরি। মারণরোগের ভাইরাস বনাম মানুষ, এই দাবা খেলা চলছে মানবজাতির আদিযুগ থেকে। বহু মহামারি পেরিয়ে মানুষ বেঁচে আছে কেবল তার প্রকৃতিদত্ত প্রতিরোধশক্তি দিয়ে। আজও বিশ্বে কোটি কোটি প্রজাতির ভাইরাস রয়েছে। তাদের উপস্থিতি সর্বত্র, সর্ব জীবে। তবু আমরা বেঁচে আছি। এমনকি বাইরের কোনও সহায়তা, কোনও টিকা বা ওষুধ, কোনও রকম চিকিৎসা ছাড়াই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করে আজ বেঁচে রয়েছেন অনেক মানুষ। তার কারণ আমাদের শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যা ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি করে মারণ-ভাইরাসকে নির্বিষ, নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। তা হলে এমন সার্বিক লকডাউন কেন? কোন প্রয়োজনে এতগুলো মানুষ এত যন্ত্রণা সইছে?
প্রয়োজন যত বেশি সম্ভব মৃত্যু এড়ানো। সকলের প্রতিরোধ ক্ষমতা একই রকম সবল নয়, তাই এই ভাইরাস দেহে ঢুকলে অনেক মানুষের প্রাণ চলে যেতে পারে। তার ফলে অর্থনীতিরও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এক বার কোনও রোগজীবাণু মানবগোষ্ঠীতে ঢুকলে তা মানুষের শরীরের মাধ্যমেই ছড়াতে পারে। যদি যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়, তা হলে সেই জীবাণু ছড়ানোর পথে বাধা পাবে। রোগ ছড়ানোর গতিপথ আটকে যেতে পারে যদি যথেষ্ট সংখ্যায় মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। একেই বলে “গোষ্ঠী প্রতিরোধ’’ বা ‘‘হার্ড ইমিউনিটি’’। প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষেরা সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে অসংক্রমিত ব্যক্তিতে ভাইরাস ছড়ানোর শৃঙ্খলা ভেঙে দিতে পারেন, যে হেতু তাঁরা সংক্রমিত হবেন না।
মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা আসতে পারে নানা ভাবে— যাঁরা সংক্রমণ থেকে সেরে উঠেছেন, যাঁদের মধ্যে সংক্রমণ রয়েছে কিন্তু বাইরে লক্ষণ নেই, আর যাঁরা প্রতিষেধক টিকা নিয়েছেন। মহামারি ছড়ানোর গাণিতিক মডেল তৈরি করে দেখা গিয়েছে, প্রতিরোধ ক্ষমতাম্পন্ন মানুষদের অংশ একটি নির্দিষ্ট সীমা ছাড়ানোর পর গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরি হয়ে যায়, অর্থাৎ ভাইরাস আর মহামারির আকার নিতে পারে না। এই যুক্তি যদি গ্রহণ করা যায়, তা হলে এমন কোনও কৌশল কি ভাবা যায়, যাতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের প্রতি গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরি করা যায়, আবার বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষ, যাঁরা সংক্রমণে প্রাণ হারাতে পারেন, তাঁদের রক্ষা করা যায়? করোনাভাইরাসের যা সংক্রমণের ক্ষমতা— এক জন মানুষ তাঁর নিকটবর্তী তিন জনকে সংক্রমিত করতে পারেন— গাণিতিক মডেল বলছে যে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরি করতে হলে চল্লিশ শতাংশ থেকে সত্তর শতাংশ মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া প্রয়োজন। আমরা যদি লকডাউন মেনে চলি, এবং লকডাউন ওঠার পর অত্যন্ত সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে, সতর্ক হয়ে, পরস্পর দূরত্ব রাখার নিয়ম থেকে ক্রমশ বার হয়ে আসি, তা হলে আমরা এক থেকে দুই বছরের মধ্যে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরি করতে পারব। তার মধ্যে টিকা বার করার সময়ও পাওয়া যাবে, যা প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে পারবে।
কিন্তু যদি আমরা এখনই সব নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরির লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করি, তাতে যত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে, সেটা মেনে নেওয়ার মতো সংখ্যা নয়। কারণ কোভিড-১৯ থেকে গড় মৃত্যুহার তিন শতাংশ, কোনও কোনও দেশে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত। যদিও পুনরায় সংক্রমণের এখনই সম্ভাবনা কম, তবু প্রতিরোধ ক্ষমতা কত দিন কার্যকর থাকবে সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এই নতুন ভাইরাস সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি। যদি প্রতিরোধ শক্তির মেয়াদ দীর্ঘ (বছরখানেক বা তারও বেশি) না হয়ে মাত্র কয়েক মাস হয়, তা হলে পুনরায় সংক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যিনি সংক্রমিত হয়ে সেরে উঠেছেন, আর যাঁর মধ্যে লক্ষণহীন হয়ে রোগ রয়েছে, তাঁদের প্রতিরোধ ক্ষমতা একই রকম কি না, তা-ও জানা নেই। এই সব বিষয়গুলি একসঙ্গে চিন্তা করলে বোঝা যায়, কেন দ্রুত, অনিয়ন্ত্রিত ভাবে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা ঠিক হবে না।
আমরা জানি, ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমিতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত বিস্ময়কর ভাবে কম। এর নানা কারণ হতে পারে। যেমন, জনসংখ্যার গড় বয়স কম, যথেষ্ট সংখ্যায় পরীক্ষা না হওয়া, কিংবা কঠোর ভাবে লকডাউন বলবৎ করা। কিন্তু গোষ্ঠী প্রতিরোধের নিরিখে আরও একটা সম্ভাবনা রয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্বের কথা মাথায় রাখলে মনে হয়— এমন কি হতে পারে যে ভারত কোনও এক কারণে জনসংখ্যার একটা বড় অংশের মধ্যে তুলনায় অল্প সময়ে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরি করে ফেলেছে? মনে রাখতে হবে, ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমিতের সংখ্যা সুইডেনের সমান, যদিও ভারতের জনসংখ্যা একশো গুণ বেশি। মৃত্যুহার সুইডেনে যেখানে বারো শতাংশ, সেখানে ভারতে তিন শতাংশ। সুইডেনে অবশ্য ভারতের মতো সার্বিক লকডাউন হয়নি, যদিও তাঁরাও পরস্পর দূরত্ব বজায় রাখছেন।
কিন্তু ভারতে গোষ্ঠী প্রতিরোধও কি এই দুই দেশে রোগের প্রকোপের পার্থক্য হওয়ার একটা কারণ হতে পারে? একটা সম্ভাবনা— যার সপক্ষে কোনও পরীক্ষাসিদ্ধ তথ্য এখনও অবধি মেলেনি— এই যে, ভারতের মানুষ এর আগে এমন ধরনের করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছে যার মারণক্ষমতা তুলনায় কম। মডেল তৈরি করলে দেখা যাচ্ছে যে অন্যান্য মরসুমি করোনাভাইরাস, যেগুলো বহু দশক ধরে মানবসমাজে ঘুরছে এবং যার লক্ষণগুলির তীব্রতা তুলনায় কম, সেগুলির প্রতি প্রতিরোধ জন্মে থাকলে তা কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ রোধ করতে বা কমিয়ে দিতে পারে। তাই একটা সম্ভাবনা এই যে, সাম্প্রতিক অতীতে করোনাভাইরাসের অন্যান্য ধরনের প্রতি যে প্রতিরোধ ক্ষমতা ভারতবাসীর জন্মেছে, তা কোভিড-১৯-এর প্রতি গোষ্ঠী প্রতিরোধ বাড়িয়েছে। ফলে কোভিড-১৯ রোগী কম মিলছে।
এই ধারণা ঠিক কি না তা বুঝতে প্রচুর সংখ্যায় দেহরসের পরীক্ষা দরকার। পরীক্ষার ফল হতে হবে যথার্থ ও নির্ভরযোগ্য। যদি এই ধারণা সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হলে যাঁদের শরীরে কোভিড-১৯-এর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাঁদের কাজে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। এর ফলে গোষ্ঠী প্রতিরোধ তৈরি হওয়ার গতি বাড়বে। আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার একটা পথও তৈরি হবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ, ওয়াশিংটন ডিসি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy