অভিবাসী কথাটার একটা অনভ্যস্ত ব্যবহার চালু হয়েছে। সচরাচর তা বোঝায় বিদেশ থেকে আগতদের। আজ আচমকা দেখা যাচ্ছে, দেশের মধ্যেই অভিবাসী হয়ে আছেন কয়েক কোটি নাগরিক।
আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের সঙ্গে এঁদের অনেক মিল, বিশেষত সবচেয়ে হতভাগ্যদের সঙ্গে। ইউরোপে প্রায়ই পণ্যবাহী কনটেনারে লুকিয়ে লোকে কোনও দেশে ঢোকার চেষ্টা করেন। গত মাসে এমন ঘটেছে মহারাষ্ট্র-তেলেঙ্গানা সীমানায়। রাজ্যে রাজ্যে প্রবেশপথে থমকে অজস্র মানুষ ও যান। শহরে পণ্যের অভাব মেটাতে যান ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে; মানুষগুলি কিন্তু আটকে।
আমরা প্রায়ই বলি, ভারত একটা নয়, দুটো দেশ— আধুনিক সচ্ছল ‘ইন্ডিয়া’, আর সনাতন অনগ্রসর ‘ভারত’। দুটোর মধ্যে প্রচলিত ব্যবধান আর্থিক, সামাজিক, মানসিক; ভৌগোলিক বিভাজন দেখার এমন সুযোগ বিরল।
আপত্তি উঠবে: যাতায়াত বন্ধ জরুরি কারণে, মহামারি ঠেকাতে। অবশ্যই। যে যা বলুক, কড়া লকডাউনের জন্যই এখনও ভারতে শনাক্ত করোনা-রোগীর সংখ্যা যথেষ্ট কম, মৃত্যু আরও কম। খটকা লাগে দেখে, রাজস্থানের কোটা থেকে ৭,৫০০ ছাত্রকে বাড়ি ফেরাতে উত্তরপ্রদেশ সরকার বাস পাঠিয়েছে, অন্যন্য রাজ্যও হয়তো পাঠাবে। কিছুটা পারিবারিক সঙ্গতি না থাকলে কোটার কোচিং প্রতিষ্ঠানে পড়া যায় না। এই ছেলেমেয়েরা ঘরে ফিরলে নিশ্চয় স্বস্তির কারণ। আরও কয়েক কোটি মানুষ কিন্তু ভিন রাজ্যে আটকে: কারও সন্তান সঙ্গে আছে, বেশির ভাগ বাপ-দাদার পথ চেয়ে গ্রামে দিন গুনছে। অভিবাসীদের ফেরাতে উত্তরপ্রদেশ এক বার দিল্লীর সীমান্তে কিছু বাস পাঠিয়েছিল, কেন্দ্রের ধমকে দ্বিতীয় বার নয়।
লকডাউনে বিপন্ন অভিবাসীদের ভারত সরকার আজও প্রায় ধর্তব্যে আনেনি। স্বগৃহে না ফিরুন, বর্তমান স্থানেই সুষ্ঠু ভাবে রাখার কোনও দেশব্যাপী প্রকল্পের লক্ষণ নেই। সমস্যার চরিত্রটাই কিন্তু সর্বভারতীয়: বৃহৎ দেশে সঙ্কটকালে রাজ্যগুলির মধ্যে সমন্বয় আনার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। অথচ কার্যত পুরো দায়িত্ব খুচরো ভাবে রাজ্যগুলির উপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, যে যা পারে বা করে— অন্যত্র আটক স্বরাজ্যবাসীর জন্য, বা নিজেদের এলাকায় ভিন রাজ্যের অভিবাসীদের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি এতে আস্থা বাড়ছে না।
আরও পড়ুন: সাম্প্রদায়িক সংঘাতের প্রেক্ষিত ‘ভারতবর্ষ’ গল্প
প্রধানমন্ত্রীর চারটি ভাষণের একটিতেও অভিবাসী শ্রমিকদের উল্লেখ নেই, এক বার সাধারণ ভাবে ‘ক্ষমাপ্রার্থনা’ বাদে। তালি বাজানো বা বাতি জ্বালানোর ডাকে ক’জন অভিবাসী সাড়া দিয়েছেন জানা নেই। যাঁদের উদ্দীপনার ছবি টিভিতে দেখলাম তাঁরা স্পষ্টই স্বগৃহে অধিষ্ঠিত। বলতে নেই, ভাষণগুলির ঝোঁকটাই মধ্যবিত্তমুখী। (ধনীদের কথা আলাদা: তাঁরা নিজের তাগিদে চলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ তাঁদের অস্তিত্বে অবান্তর।) ঘণ্টা বা বাতি প্রদর্শনের জন্য ছাদ, বারান্দা ইত্যাদি মধ্যবিত্তের বাড়িতেই মিলবে। সেখানেই জনে জনে এত মোবাইল যে ‘আরোগ্য সেতু’র ফলপ্রসূ প্রয়োগ সম্ভব। কর্মীদের মাইনে মেটানোর বা গরিবদের দানধ্যান করার আহ্বানও নিশ্চয় সম্পন্ন শ্রেণির প্রতি। সবচেয়ে বড় কথা, একমাত্র সেই শ্রেণিরই বিপদের সময় এত অবকাশ, নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি যে, তাঁরা এই সব অনুজ্ঞা পালনের মেজাজে থাকবেন।
তাই বলছি, ভারত জুড়ে অদৃশ্য সীমারেখাগুলি হঠাৎ প্রবল ভাবে ফুটে উঠেছে: কেবল ভৌগোলিক নয়, সামাজিক ও শ্রেণিগত অর্থে। সম্পন্ন শ্রেণির বড় অংশ প্রধানমন্ত্রীর ডাকে আন্তরিক সাড়া দিয়েছে, কারণ (অবশ্যই কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা না থাকলে) এই সঙ্কটে তাঁদের ভূমিকা পালনে যতটা আত্মতুষ্টি, তুলনায় কৃচ্ছ্রসাধন নেহাত কম। কিছু সৌভাগ্যবান পরিবারের কাছে লকডাউন মানে অপ্রত্যাশিত বিশ্রাম আর ভালমন্দ রান্নার অবকাশ। বেশি বেয়াড়া নিয়মগুলো না মানলেই হল, বিশেষত যেখানে অভিঘাতটা পড়বে সেবক-শ্রেণির উপর।
বহু আবাসনে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ উড়িয়ে কিছু ঘরে সহায়িকাদের হাজিরা বহাল। কড়াকড়ি এড়াতে গৃহস্থ বিচিত্র কৌশল ফাঁদছেন বা স্রেফ জোর খাটাচ্ছেন। বা সহায়িকাকে আসতে মানা করেছেন ভয়ে: বস্তি থেকে যদি ঘরে ছোঁয়াচ ঢোকে! বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সত্যিই অনেক সংক্রমণ জন্মায়; সে জন্য মধ্যবিত্ত ঘরে সেবা-পরিষেবা দিতে বস্তিবাসীদের প্রবেশ কখনও নিষিদ্ধ হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়। কোভিড-১৯ কিন্তু এক অস্বস্তিকর রোগ, যা বস্তির গরিব মারফত বিত্তশালীকে নয়, বিদেশফেরত বিত্তশালী মারফত গরিবকে আক্রমণ করে: অনেক দরিদ্র করোনা রোগী হলেন সম্পন্ন বাড়ির সহায়িকা বা গাড়ির চালক।
এই তবে অভিবাসের সীমানা— দুই মহল্লার মধ্যে, দুই শ্রেণিরও। ভারতের মধ্যবিত্তের সংখ্যা কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার সমান, সেই ‘দেশ’-এর সীমান্ত আমাদের দোরগোড়ায়: সেটা অতিক্রম করে ও-পারের কর্মী এ-পারে আসেন। অতএব গোড়াতেই জানা দরকার, কে কোন দেশের নাগরিক। প্রধানমন্ত্রীর পরিচয় পরের কথা। তিনি বিচক্ষণ লোক, অনুগত প্রজাদের ঠিক চিনেছেন। তাঁদের সন্তান কোটায় পড়তে পারে; গৃহকর্তা কখনই বেরাজ্যে মজুরি খাটবেন না।
মধ্যবিত্তের ঘাড়ে এই চরিত্র একতরফা ভাবে চাপিয়ে দিলে চরম অন্যায় হবে। হুইলচেয়ার ঠেলে ঘর পরিষ্কার করছেন, ভাঙা হাড় নিয়ে গেরস্থালি সামলাচ্ছেন, এমন লোক আমিই চিনি, দেশ জুড়ে কত আছেন কে জানে। আর আছেন অসংখ্য সহৃদয় মানুষ, যাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দুর্গতদের সাহায্যে। অনুমান করি, এঁদের অধিকাংশের অনুপ্রেরণা নিজের মন থেকে আসছে, নেতার আবেদন থেকে নয়। রাষ্ট্রের ঘাটতি এঁরা পুষিয়ে দিচ্ছেন। লকডাউনের প্রায় এক মাস বাদেও দেশের নানা প্রান্তে বুভুক্ষু নিরাশ্রয় মানুষের খবর মিলছে। ত্রাণের বোঝা রাজ্যের ঘাড়ে ঠেলে কেন্দ্র দায়মুক্ত, রাজ্যগুলি সামাল দিতে জেরবার, বিক্ষিপ্ত ভাবে যুক্ত হচ্ছে এনজিও আর স্থানীয় সংস্থা, আর প্রধানমন্ত্রী দরিদ্রসেবার আহ্বান জানাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এ বড় সিনিকাল অপপ্রয়োগ।
এ পর্যন্ত ব্যাপক ও দৃষ্টিকটু ভাবে অনাহারে মৃত্যু ঠেকানো গেছে: তার বেশি দাবি করা অসঙ্গত। ছবির পর ছবিতে উঠে আসছে ত্রাণার্থীর সারি, খাবারের জন্য আবালবৃদ্ধের কাড়াকাড়ি, খাবারের গুজব শুনেই পাড়া জুড়ে দৌড়। ব্যাঙ্কের সামনে মহিলাদের প্রতীক্ষা, ক্ষোভ, ধস্তাধস্তি। এঁরা ভাগ্যবান, মাসে পাঁচশো টাকা খয়রাতির শিকে ছিঁড়েছে। সেই ক’টা টাকা বা কয়েক মুঠো ক্ষমাঘেন্নার অন্নের বিনিময়ে এই মানুষগুলোর নাগরিক সম্মানহানির অধিকার আমাদের আছে কি? লকডাউনের উদ্দেশ্য ধুলিসাৎ হচ্ছে, তা ছেড়েই দিলাম।
ভারত আজ নেহাত গরিব দেশ নয়। বিশ্বসঙ্কটেও আমাদের আর্থিক হাল অন্য দেশের চেয়ে ভাল, আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে। তা সত্ত্বেও কয়েক কোটি মানুষকে এই দুর্দশায় নিক্ষেপ করলে বলতেই হয়, দেশ তাঁদের নাগরিকের স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক। ভারতভূমে অস্ট্রেলিয়াবাসীদের তাতে চিন্তা নেই। সমৃদ্ধ দেশ মাত্রেই সস্তায় অভিবাসীদের খাটিয়ে নিতে চায়। তাঁরাও খাটতে ব্যাকুল, কিন্তু সুযোগ কই? গ্রামে ফসল কাটা চলছে, নারেগার কাজ শুরু হয়েছে; অথচ উদগ্রীব কর্মীবাহিনী পড়ে শহরের মরুভূমিতে।
এ বার যদি তাঁরা ভাবেন, দেশ সত্যিই তাঁদের ত্যাগ করেছে, অতএব তাঁদেরও দেশের প্রতি দায় নেই? সেই ক্ষোভের তোড় আমরা সামলাতে পারব? আশঙ্কাটা হয়তো অমূলক। দরিদ্র ভারতবাসী পরমসহিষ্ণু; বরাবরের মতো এ বারও হয়তো খানিক লোক মরবেন, বিপুল সংখ্যা কিছু দিন দুঃসহ কষ্টে কাটাবেন, তলিয়ে যাবে বহু পরিবার। ইতিহাস জোড়া মানবিক বিপর্যয়ের তালিকায় আর একটা যোগ হবে। সীমান্তের এ-পারে আমরা নিস্তরঙ্গ জীবন কাটাব। সেই স্বস্তির উদ্যাপনে ফের একটা সমারোহ হোক। নেতামন্ত্রীর দরকার নেই, নিজেরাই আয়োজন করি। এ বার ঘরের সামনে শাঁখ বাজালে কেমন হয়?
প্রফেসর এমেরিটাস, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন: ভাইরাসের আর এক শিকার
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy