লকডাউন কবে উঠিবে, পর্যায়ক্রমে উঠিলে কোন পণ্য বা পরিষেবাগুলির সরবরাহ অগ্রাধিকার পাইবে, তাহার আলোচনা চলিতেছে। আশা থাকিল, এই বিবেচনার পুরোভাগে রাখা হইতেছে কৃষকদের। পশ্চিমবঙ্গে বোরো ধান পাকিয়া উঠিয়াছে। রাজ্যের ধান উৎপাদনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বোরো ধান। ধান কাটিবার মজুররা প্রধানত আসেন ঝাড়খণ্ড-সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি হইতে, অথবা রাজ্যেরই অন্যান্য জেলা হইতে। ট্রেন-সহ সকল পরিবহণ বন্ধ হইবার ফলে দূর হইতে খেতমজুর পাইবার ভরসা নাই। একই রকম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাইতেছেন পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লির চাষিরাও। তাঁহাদের মাঠের পাকা গম আর সাত-দশ দিনের মধ্যে কাটিতে না পারিলে মাঠেই নষ্ট হইবে। বোরো মরসুমের গম তাঁহাদের প্রধান ফসল। তাঁহারা অপেক্ষা করিতেছেন উত্তরপ্রদেশ, বিহার হইতে আগত শ্রমিকদের। বিষয়টি এই মুহূর্তে শীর্ষ প্রশাসনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলির একটি বলিয়া গণ্য হইবার দাবিদার, কারণ মাত্র কয়েক দিনের বিলম্বে এক বিপুল আর্থ-সামাজিক সঙ্কট সৃষ্টি হইয়া যাবে। এক দিকে কৃষকের ফসল নষ্ট হইবে, ফলে তাঁহার ক্ষতি। কৃষিশ্রমিকরাও মজুরি হইতে বঞ্চিত হইবেন। গ্রামীণ ভারতে আয় এতখানি কমিলে বাজারে সামগ্রিক চাহিদার উপর তাহার প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়িবে। অন্য দিকে, ফসল নষ্ট হইলে টান পড়িবে খাদ্যপণ্যের জোগানেও। অর্থাৎ, অর্থব্যবস্থা ধাক্কা খাইবে দুই তরফেই।
কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই বিজ্ঞপ্তি জারি করিয়াছে যে কৃষিপণ্য পরিবহণ, বিপণন, অথবা মাঠে কৃষিকাজ করিবার বিষয়ে কোনও বাধা নাই। কিন্তু রাজ্যগুলিকে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধিনিয়ম জারি না করিলে অসুবিধা। অধিকাংশ রাজ্যই সে কাজটি এখনও সুষ্ঠু ভাবে সমাধা করে নাই। এ জন্য আন্তঃরাজ্য সমন্বয়ের প্রয়োজন। রাজ্য হইতে রাজ্যে মজুরদের পরিবহণের ব্যবস্থা করা না গেলে বিকল্প ব্যবস্থা প্রয়োজন। খেতমজুরদের জন্য এবং কৃষিপণ্যবহনকারী যানচালকদের জন্য ধাবা প্রভৃতি খুলিবার ব্যবস্থাও চাই। তাহার পরেও থাকিবে ফসল কিনিবার, মজুত করিবার ব্যবস্থা। বিশেষত এই দুর্দিনে সরকারি ক্রয়ের উপর চাষির ভরসা বাড়িবে, কারণ তাহার বাজার ধরিবার ক্ষমতা কমিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে ধানের সরকারি ক্রয় ক্রমাগত চালকল-মুখী হইয়াছে। এখন গ্রামে গ্রামেই ধান কেনা যায় কি না, দেখা দরকার। তাহা অধিক নিরাপদ। নানা জেলার চাষিদের সহিত পরামর্শ করিয়া তাঁহাদের প্রয়োজন অনুসারে শ্রমিকের গতিবিধির জন্য ছাড়পত্র, অথবা যথেষ্ট হার্ভেস্টার যন্ত্র জোগানের ব্যবস্থাও জরুরি। কঠিন কাজ, সন্দেহ নাই, কিন্তু এখনই এই সবের উদ্যোগ প্রয়োজন। স্থানীয় মজুর কর্মহীন, অতএব চাষির মজুর পাইতে সমস্যা হইবে না, এমন ধারণা বাস্তবোচিত না-ও হইতে পারে। বিশেষত অল্প সময়ে অনেক মজুরের চাহিদা দেখা দেওয়ার ফলে মজুরির হার যদি ক্ষুদ্র চাষির ব্যয়ক্ষমতাকে অতিক্রম করিয়া যায়, তাহাতে এক নূতন সঙ্কট দেখা দিবে।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিবার সঙ্গে সঙ্গে আনাজ, ডিম, মুরগি-সহ বহু পণ্যের চাহিদা কমিয়াছে। বাহিরের রাজ্যে এবং বিদেশে রফতানি কমিবার ফলে বাজারও পড়িয়াছে। চাষি আরও বেশি করিয়া স্থানীয় ব্যবসায়ীর উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িতেছেন, এবং দরদস্তুরের ক্ষমতা হারাইতেছেন। সংবাদে প্রকাশ, চাষিরা বিবিধ আনাজের বাজারদরের মাত্র এক-চতুর্থাংশ পাইতেছেন। অতএব কেবল মাঝের ব্যবসায়ীদের ধরিয়া শাস্তি দিলেই যথেষ্ট হইবে না। সুফল প্রভৃতি প্রকল্পের অধীনে সরকারি ক্রয়-বিপননের মাধ্যমে বাজারে কৃষিপণ্যের দর নিয়ন্ত্রণও জরুরি। ফসল কাটা হইতে ফসল বিক্রয়, প্রতিটি ধাপে সরকারকে থাকিতে হইবে চাষির পাশে। কেবল চাষির স্বার্থে নহে। অর্থনীতির স্বার্থে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy