এই অতিমারি আটকাতে গিয়ে দেশের যে কোটি-কোটি মানুষ এখন রুটি-রুজি হারিয়ে অভুক্ত অবস্থায় বাড়িতে বসে আছেন, অর্থনীতিবিদরা একমত, তাঁদের বাঁচানোর একমাত্র উপায় খাদ্য বা টাকা সরাসরি তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এর জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারকেই জোগাতে হবে, কারণ রাজ্যগুলির ওই সামর্থ্য নেই। কিন্তু গভীরতর আশঙ্কা, করোনাভাইরাসের উৎপাত কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসে গেলেও এবং দেশ থেকে তালাবন্দির আপৎকালীন ব্যবস্থা মোটামুটি উঠে গেলেও, অর্থনৈতিক সঙ্কট চট করে কাটবে না— আরও বেশ কিছু দিন বিপুল কর্মহীনতা ও ক্ষুধার তাড়নায় পর্যুদস্ত থাকবে আমাদের দেশ। ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভারতীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলি করেছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এই আশঙ্কা। ফলে সরকারের দায়িত্ব আপৎকালীন কয়েকটা মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না।
আপৎকালীন তালাবন্দি উঠে গেলেও কেন সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিটা আগের ছন্দে ফিরতে পারবে না, তার একাধিক কারণ আছে। অর্থশাস্ত্রে একে বলে পারসিসটেন্স এফেক্ট। যেহেতু ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প-পরিষেবায় দেশের অধিকাংশ মানুষ হয় চাকরি করেন না হয় স্বনিযুক্ত, তাঁদের ওপর অর্থনৈতিক তালাবন্দির সম্ভাব্য প্রভাবটা সবার আগে বিচার করা দরকার। আমরা দেখেছি, নোট-বাতিলের অভিঘাতে বহু ক্ষুদ্র সংস্থা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। সন্দেহ নেই, তালাবন্দির অভিঘাত নোট-বাতিলের তুলনায় বহু গুণ তীব্রতর হবে।
তালাবন্দিতে উৎপাদন বন্ধ, ফলে আয় নেই। আয় না থাকলে, উৎপাদন না হলে, ব্যবসাসংক্রান্ত চুক্তিগুলোও মানা সম্ভব নয়। টাকা নেই বলে ধার শোধ দেওয়া যাচ্ছে না, উৎপাদন বন্ধ বলে কাঁচামালের জোগান দেওয়া যাচ্ছে না, যানবাহন নেই বলে আগে তৈরি করা জিনিসও খদ্দেরের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। তালাবন্দির আপৎকাল কেটে গেলেও তার কুপ্রভাব থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো সহজে বেরিয়ে আসতে পারবে না। এক বার ছেদ পড়ে গেলে বাণিজ্যিক সম্পর্কগুলো সহজে পুনরুদ্ধার করা যায় না। এর সবচেয়ে বড় কারণ, উৎপাদন-বণ্টন প্রক্রিয়ার কোথাও একটা চুক্তিভঙ্গ হয়ে গেলে এই ছোট-ছোট সংস্থাগুলো সময়মতো ঋণের টাকা শোধ দিতে পারে না, আর এক বার ঋণের টাকা শোধ দিতে না পারলে এমন ভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে যার থেকে বেরোনো প্রায় অসম্ভব। নোট-বাতিলের সময় আমরা এটা দেখেছি। আশঙ্কা, এখন আরও বেশি দেখতে হবে।
আরও পড়ুন: করোনা: ভয়ের পাশাপাশি আমাদের আয়নার সামনে দাঁড়ানোরও সময়
ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলোর এই সঙ্কট সরাসরি উৎপাদন ও কর্মসংস্থান ছাড়াও জিনিসপত্রের চাহিদার ওপর একটা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি সংস্থার তৈরি জিনিসের চাহিদার ওপরে নয়, সংগঠিত ক্ষেত্রের বড়-বড় সংস্থার তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদার ওপরেও। দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনও স্বনিযুক্ত অথবা ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলিতে কর্মরত। তাঁদের আয় যদিও মূলত অবিধিবদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আসে, সেই আয় তাঁরা শুধু অবিধিবদ্ধ ক্ষেত্রে তৈরি জিনিসপত্রের ওপর খরচ করেন না। আজকাল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বড়-বড় সংস্থাগুলো তাদের ব্যবসা ছড়িয়েছে। তেল-সাবান-বিস্কুট-মাজন থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন— সব কিছুর বাজারেই আজকাল বড় উৎপাদকরা অবিধিবদ্ধ ক্ষেত্রের উপভোক্তাদের ওপর নির্ভর করে। স্বনিযুক্ত অথবা ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থাগুলিতে কর্মরত মানুষদের আয় উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেলে, বড়-বড় সংস্থার তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাবে।
উপরন্তু সংগঠিত ক্ষেত্রের কিছু অংশ, যারা বিদেশে তাদের পণ্য বিক্রি করে, আন্তর্জাতিক বাজার সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে সরাসরি চাহিদার সমস্যায় পড়বে। এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার মতো আধুনিক পণ্য যেমন রয়েছে, তেমনই আছে চামড়াজাত দ্রব্য বা দামি পাথর কাটার কাজের মতো সাবেকি রফতানি। ভয় হয়, আন্তর্জাতিক সঙ্কোচনের ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বেন। তারও প্রভাব পড়বে দেশের বাজারের চাহিদায়।
চাহিদার সমস্যার সঙ্গে বড় সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রেও উৎপাদন ও বণ্টন-জনিত সমস্যা বড় আকারে যুক্ত হতে পারে। আবশ্যিক তালাবন্দি উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যবস্থাগুলোকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। বিশেষ করে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন, কাজের অভাবে বা বাঁচার তাগিদে কেউ কেউ ফিরে গিয়েছেন গ্রামে। করোনা-উপদ্রব মিটলেও তাঁদের আবার একত্র করে উৎপাদন শুরু করা সহজ কথা নয়। একই ভাবে সরবরাহ ব্যবস্থায় যাঁরা নিযুক্ত ছিলেন, ট্রাকচালক থেকে শুরু করে বহুতল বিপণির কর্মচারী, তাঁদেরও একত্র করার সমস্যা রয়েছে। এই সব মিলিয়ে বলা যায়, তালাবন্দির নিয়ন্ত্রণ উঠে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ও বণ্টন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে যাবে না।
করোনা-অতিমারি অর্থনীতিতে যে অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে তার ফলে বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। কেউ জানে না, কবে শেষ হবে এই করোনা-অতিমারি। এই রকম অনিশ্চিত পরিবেশে কে বিনিয়োগ করবে? কিন্তু বিনিয়োগ না হলে দু’দিকে ক্ষতি। এক দিকে বিনিয়োগ না হলে কলকব্জার যে স্বাভাবিক ক্ষয় সেটা পূরণ হবে না, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বহু যন্ত্রপাতি একেবারে বসে যাবে, নতুন করে যন্ত্রপাতিও তৈরি হবে না। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে অন্তত কিছু দিন উৎপাদনশীল যন্ত্রপাতির অভাব দেখা দেবে। এই অভাবের কারণে চট করে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানও তাদের স্বাভাবিক মানে পৌঁছতে পারবে না। উল্টো দিকে, বিনিয়োগের ফলে জিনিসপত্র এবং শ্রমের যে চাহিদা তৈরি হয়, সেটাও আটকে যাচ্ছে। যে বেসরকারি প্রকল্পগুলো অর্ধ-সমাপ্ত অবস্থায় পড়েছিল, যেখানে বড় আকারের কর্মসংস্থান হতে পারত, সেগুলোও এখনই শুরু হবে বলে মনে হয় না। এর ওপর, বিনিয়োগকারীরা যদি মনে করেন তাঁদের জিনিসপত্রের তেমন চাহিদা নেই— যে চাহিদাহীনতা সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মহীনতা থেকে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা— তা হলে তাঁদের বিনিয়োগের উৎসাহটাই চলে যাবে। আরও দীর্ঘায়িত হবে করোনা-পরবর্তী পুনরুত্থান।
আরও পড়ুন: স্বপ্নভঙ্গের সওদাগর
এই অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সময়ে একমাত্র সরকারই খানিকটা পরিত্রাতার ভূমিকা নিতে পারে। সরকারি নীতির দুটো লক্ষ্য হওয়া উচিত। এক, কর্মহীন যে সব মানুষ অভুক্ত, অর্ধভুক্ত অবস্থায় রয়েছেন, তাঁদের কাছে খাদ্য বা নগদ অনুদান পৌঁছে দিতে হবে। দুই, বাধ্যতামূলক তালাবন্দির ফলে যে অর্থনীতির কাঠামোটা ভেঙে পড়েছে, সেটা জোড়া লাগানোর জন্য দেশ জুড়ে পরিকাঠামো নির্মাণে বিপুল খরচ করতে হবে। সরাসরি কর্মসংস্থান ছাড়াও সরকারি পরিকাঠামো নির্মাণ বেসরকারি বিনিয়োগকে দু’ভাবে উৎসাহ দেবে। এক, উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করে বেসরকারি বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা বাড়াবে। দুই, পরিকাঠামো তৈরির সময় সরাসরি সাধারণ মানুষ কাজ পাবেন, তাঁদের আয় বাড়বে, ফলে সার্বিক ভাবে বেসরকারি ক্ষেত্রে তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও বাড়বে।
সরকারি খরচ বা ঘাটতি বাড়াতে গেলে হয় বাড়তি টাকা ছাপাতে হবে, না হয় কর বাড়াতে হবে, আর না হয় সরকারকে দেশবাসীর কাছ থেকে আরও ধার করতে হবে। বস্তুত, এক সঙ্গে তিনটে বিকল্পই ব্যবহার করা যেতে পারে। যাঁরা ভাবছেন, টাকা ছাপালে মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া হয়ে যেতে পারে, তাঁদের বলব, কৃষিপণ্যের উৎপাদনে আপাতত কোনও টান নেই, নতুন ফসলের অবস্থাও ভাল। এই অবস্থায় বাড়তি নগদটা যদি কৃষিপণ্যের ওপরেই খরচ হয়, তা হলে মূল্যবৃদ্ধির কারণ নেই। ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর বিকল্পটা, বিশেষ করে কর্পোরেটদের যে করছাড় ঘোষণা করা হয়েছে সেটা বাতিল করাটা, আর্থিক পুনর্বণ্টনের ইঙ্গিতবহ, যা এই দুঃসময়ে আদৌ অনভিপ্রেত নয়। আর, ধার বাড়ানোর বিকল্পটাও এই সময় গ্রহণযোগ্য, যেহেতু সুদের হার এখন অনেক কমে গিয়েছে, ভবিষ্যতে সম্ভবত আরও কমবে। সুদের হার কম হলে সরকারের পক্ষে ধার শোধ দেওয়াটা সহজ এবং কম খরচসাপেক্ষ।
অর্থাৎ জোর দিয়েই বলা যেতে পারে, এই সময় সরকারি খরচ বাড়ানোর ব্যাপারে দ্বিধার কোনও প্রকৃত কারণ নেই।
অর্থনীতি বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy