করোনাভাইরাসের ধাক্কায় থমকে দাঁড়িয়েছে বিশ্বায়নের রথ। ভারতেও শঙ্কা বাড়ছে। এমন জনবহুল দেশে ঘরবন্দির অভিঘাত সহজেই অনুমেয়। এক দিকে এই পথ ছাড়া রোগের বিস্তার আটকানোর উপায় নেই, অন্য দিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ স্তব্ধ। এর মধ্যে আছে নির্মাণ, পরিবহণ, রেস্তরাঁ, পর্যটন ও বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্র, যেখানে বাধাহীন শোষণ-লুণ্ঠনের অমানবিক পরিবেশে আমাদের দেশের ৮১ শতাংশ মানুষ কাজ করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বর্তমান রিসেশন বা মন্দা পরিণত হতে চলেছে ডিপ্রেশন বা অতিমন্দায়, যা ২০০৮ তো বটেই, ১৯৩০-এর ভয়ঙ্কর স্মৃতিও ফিরিয়ে আনতে পারে।
করোনাভাইরাস অতিমারির বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা যাক। এই প্রথম বোধ হয় একটি অতিমারির উদ্ভব হল, যার সঙ্গে দারিদ্রের কোনও সরাসরি যোগ নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্বায়নের যুগে পণ্য ও মানুষের অবাধ চলাচল। তাই চিনের উহানের বন্যপ্রাণীর বাজারে যে ভাইরাসের সৃষ্টি, তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ইটালি, স্পেন, ইরান, আমেরিকা-সহ অন্যান্য দেশে। রোগের প্রাদুর্ভাব প্রথমে দেখা যায় সেই দেশের শহরগুলিতে, যারা বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত এবং আন্তর্দেশীয় যোগাযোগের কেন্দ্র। এখনও পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারত, এবং আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলিতে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। করোনার প্রকোপের সঙ্গে হয়তো আবহাওয়া কিংবা জনসংখ্যায় প্রবীণদের প্রাধান্য ইত্যাদির সম্পর্ক আছে, কিন্তু অর্থনীতির গতিশীলতা ও আন্তর্দেশীয় যোগাযোগেই এর সূত্রপাত।
এর সঙ্গে যুক্ত জনবসতির ঘনত্বের বিষয়টিও। আক্রান্ত শহরগুলির ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলেই রোগের প্রকোপ বেশি। চিনের উহান এবং আমেরিকার নিউ ইয়র্ক, এই দু’টি শহরই ঘনবসতির নিরিখে বিশ্ব তালিকায় একেবারে উপরের দিকে। এই কারণেই ভারতের মহানগরগুলির উদ্বেগ এত বেশি। বিভিন্ন দেশে এই রোগের বিস্তার বা নিয়ন্ত্রণ থেকে আর একটি বিষয়ও খুব পরিষ্কার। চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ, যেখানে জনজীবনে রাষ্ট্রের উপস্থিতি পাশ্চাত্যের তুলনায় বেশি, সেখানে রোগের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা সহজসাধ্য হচ্ছে। চিন প্রাথমিক ভাবে গুরুত্ব না দিলেও পরে প্রায় যান্ত্রিক তৎপরতায় নাগরিকদের ঘরবন্দি করে, আক্রান্ত অঞ্চলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বৃহদংশের মানুষকে টেস্টিং, স্ক্রিনিং-এর আওতায় এনে সঙ্কটে কিছুটা রাশ টানতে সক্ষম হয়েছে। ঘরবন্দির সময়ে জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে বিরাট ভূমিকা নিয়েছে উন্নত অনলাইন সরবরাহ ব্যবস্থা।
আমেরিকা ও ইউরোপের সমস্যা অন্যত্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সরকারি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বরাদ্দ কাটছাঁট করে আমেরিকার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আমূল বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই রোগের প্রাদুর্ভাবে তারই মাসুল দিতে হচ্ছে মার্কিন নাগরিকদের। ইউরোপের সমস্যা সর্বোচ্চ ব্যক্তি-স্বাধীনতা। চিনের উদাহরণ সামনে থাকা সত্ত্বেও ঘরবন্দির প্রক্রিয়া চালু করতে অনেক দেরি করেছে ইটালি ও স্পেন। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশ্বের দু’নম্বরে থাকা ইটালিও তাই সমস্যা সামলাতে পারেনি। এ এমন এক অতিমারি, যার চরিত্র পূর্বজদের তুলনায় আলাদা, এবং কোনও প্রতিষেধক বা প্রতিরোধের পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই। তাই সব দেশই কম-বেশি অপ্রস্তুত।
পৃথিবী এখন জোড়া বিপদের সম্মুখীন। এক দিকে প্রতি দিন নতুন অঞ্চল এবং শহর থেকে গ্রামে অতিমারির বিস্তার ঘটে চলেছে, অন্য দিকে অর্থনীতি থমকে। কী ভাবে মোকাবিলা হবে এই বিপদের? চেনা রাস্তায় কি কোনও সমাধান আছে? বোধ হয় না। কারণ, সমাজ ও পরিবেশ-পরিপন্থী বিশ্বায়নের যাত্রাপথে এর জন্ম। আজকের সঙ্কটের বীজ প্রোথিত রয়েছে বিগত তিন দশকের ভোগবাদী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এবং তজ্জনিত সমাজ-সংস্কৃতির ভিতর।
কর্মসংস্থান এবং উন্নত জীবনমানের বিপুল আশা জাগিয়ে ১৯৯০-এর দশকে যে বিশ্বায়নের শুরু, তা সম্পূর্ণ বিফলে গিয়েছে, এমনটা বলা চলে না। কিন্তু শতাব্দীর প্রথম থেকেই তা পথভ্রষ্ট হয়ে গেল। রাষ্ট্র ক্রমশ পিছু হঠল। বাজার হয়ে উঠল সমাজের চালিকাশক্তি। রাষ্ট্র যেখানে থাকল, সেখানে তার কাজ হয়ে দাঁড়াল আম জনতার বদলে বাজারের ক্ষমতায়ন। অর্থনীতির সাফল্যের মানদণ্ড হল কর্মসংস্থান নয়, পুঁজির কেন্দ্রীভবন।
কিছু দিন আগে শুনতাম ‘জবলেস গ্রোথ’। এখন শুনতে পাই ‘প্রফিট উইদাউট গ্রোথ’। জিডিপি-র হার নিম্নগামী। অক্সফ্যাম-এর তথ্য অনুসারে, বিশ্বে ২০০৬-২০১৫ সালে সাধারণ শ্রমজীবীর আয় বেড়েছে বছরে মাত্র ২ শতাংশ। অথচ কোটিপতিদের সম্পদ বেড়েছে ছ’গুণ। সারা পৃথিবীতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের দখল নিয়েছে আগ্রাসী পুঁজি। জীববৈচিত্র পরিণত হয়েছে পণ্যে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি এন্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস (আইপিবিইএস) ২০১৯-এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাক্-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ১০ লক্ষ অতি ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে চলেছে। কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে অতি মাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ, নগরায়ণ এবং ক্রমশ বেড়ে চলা প্রকৃতি-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডকে। প্রকৃতির জৈব-অজৈব শৃঙ্খল, যা এত দিন মানুষের সুরক্ষা-জালের কাজ করত, তা ভেঙে পড়েছে। এর ফলেই বিপদের মুখে মানুষের অর্থনীতি, জীবিকা, খাদ্যসুরক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়। বিশ্বায়নের ঘোরে উদ্ভ্রান্ত মানুষ অন্য জীবজগতের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে আজ মারণ ভাইরাসে আক্ৰান্ত।
আমূল সংস্কার প্রয়োজন আমাদের চিন্তন, মনন এবং উন্নয়নের গতিপথে। আধিপত্য বা শ্রেষ্ঠত্ব নয়, প্রয়োজন সহযোগিতা ও সহাবস্থান। এই কারণেই সঙ্কট কালে ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’ শব্দটি পরিবর্তন করে বলতে হচ্ছে— বাড়ান শারীরিক দূরত্ব, কমান মনের দূরত্ব। সহযোগিতা প্রয়োজন সবল ও দুর্বল রাষ্ট্রের মধ্যে, সক্ষম ও পিছিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে। বিশ্বে মানুষ সহাবস্থান করুক অন্য সকলের সঙ্গে।
এই ধারণাকে ফলপ্রসূ করতে গেলে কিছু বিষয়ে সহমত হতে হবে। এক, অদূর ভবিষ্যতে গ্লাসগোয় পরিবেশ আলোচনা ‘কপ২৬’-এ গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে একমত হতে হবে, এবং আর্থিক ভাবে অনগ্রসর দেশগুলিকে গ্যাস প্রশমনের জন্য আর্থিক সহায়তার বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। কারণ, এর সঙ্গে সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ যুক্ত। দুই, যে মানুষরা ঘরবন্দির ফলে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াতে বাধ্য হলেন, বিশ্বায়ন তাঁদের ক্ষমতায়নে কার্যকরী হয়নি। এঁদের সক্ষম করার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে। তিন, অবাধ বাণিজ্যিকীকরণ নয়, উন্নয়নের মূল লক্ষ্য আঞ্চলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। সব শেষে বলতে হয়, বিশ্বায়নের দাপটে সব থেকে অবহেলিত হয়েছে জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ তার ফলে ভুগছে অনেক দেশ। রাষ্ট্রনেতারা কি ভেবে দেখবেন যে দেশের সুরক্ষা কিসের উপর নির্ভরশীল? প্রতিরক্ষা না জনস্বাস্থ্য খাতে ব্যয়? সরকার না বেসরকারি উদ্যোগ, কার হাতে জনস্বাস্থ্য বেশি সুরক্ষিত?
এমন ব্যাপক অতিমারি যে কোনও দেশের সরকার এবং মানুষকে বিমূঢ় করে দেয়। আবার তা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন চিন্তার সুযোগও নিয়ে আসে। সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে।
আইআইইএসটি, শিবপুর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy