লকডাউনের জেরে স্তব্ধ কলকারখানা। ফাইল চিত্র।
আমি কফি আসক্ত। কিন্তু চটজলদি হয় এমন অনেক কিছুর মতোই আমার ওই গরম জলে গুলে খাওয়া কফিও অপছন্দের। নিভৃতবাসের প্রথম পক্ষ পেরিয়েও আরও কিছু দিনের ছেঁকে খাওয়ার কফি ছিল। কিন্তু অন্য চারটে নেশাড়ুর মতোই— শেষ হলে কী খাব এই ভয়ে প্রতি দিনই নেট ঘেঁটে চলেছি পছন্দের কফির খোঁজে। যত বারই নেটবাজার খুলি সেই ঘ্যানঘ্যানে বক্তব্য। “সরকারের আদেশে আপনার ওখানে এটি বেচা যাবে না।”
হঠাত্ই কয়েক দিন আগে ‘ইউরেকা’। ফেলুদার মতোই চেঁচিয়ে উঠেছিলাম প্রায় ‘পেয়েছি, পেয়েছি’ বলে। ভরে ফেললাম নেট বাজারের থলে। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ওঠাবসার বয়স তো হল ষাট! তাই ভয়ে ভয়েই খুঁজলাম ‘ফিল্টার পেপার’। আর যা ভেবেছিলাম! থাপ্পড়ের মতো ভেসে উঠল— “সরকারের আদেশে আপনার ওখানে এটি বেচা যাবে না।” কফিটা কিনেছি। ফিল্টার পেপার ফুরোলে, নতুন মোজা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখব। শুনেছি অনেকেই সেটা করে থাকেন।
কফি না-হয় না-খেয়ে থাকলাম। কিন্তু পড়াশোনা? সরকার বলছেন করতে। কিন্তু খাতা? বই? পেন? নেই, নেই, নেই। আর সমস্যাটা এখানেই। নিভৃতবাসের অধ্যাদেশের সঙ্গে বিরোধ নেই। কিন্তু বিরোধের জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে নীতি নির্ধারকদের বাস্তবের জমিতে পা না-রাখা সিদ্ধান্তই। যা এই তথাকথিত ‘লকডাউন ৩.০’ আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
‘লকডাউন ২.০’ ঘোষণার সঙ্গে শিল্পে উৎপাদনের ছাড় ঘোষণা করা হল। বলা হল, শহরাঞ্চলের বাইরে, মিউনিসিপ্যালিটির সীমার বাইরে বিশেষ নিয়ম মেনে শিল্প উৎপাদনের রাস্তায় হাঁটতে পারবে। কিন্তু এই ছাড় কতটা প্রযোজ্য হতে পারে তা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে। সে দিনই একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলে বাজাজ অটোর ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজীব বাজাজ কিন্তু এই ছাড় নিয়ে অনুধাবনযোগ্য একটা মন্তব্য করেন। তাঁর বলার সার কথা হল, নীতি নির্ধারকরা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সেই সিদ্ধান্তে কেন যেন তাঁর মনে হচ্ছে দেশের ভালর থেকেও ব্যক্তিগত ভয় বেশি কাজ করছে।
বন্ধ দোকানপাট। ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: সারা বিশ্বে ভারতেই মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম, দাবি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
আরও পড়ুন: করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা, শ্রমিক-প্রশ্নে কেন্দ্রের সঙ্গে কথা চায় নবান্ন
মনে রাখতে হবে, তখনও করোনা ছোবল মারছিল উচ্চকোটির মানুষকেই বেশি। তাঁর এই মন্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, কারখানা খোলার ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় তিনি কিন্তু পরিষ্কার সবুজ পতাকার খোঁজ পাচ্ছেন না। অথচ, তাঁর হাতে হাজার কোটি টাকার উপর রফতানির বরাত রয়েছে। এবং তিনি নিজের টাকায় সব রকম সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসনের আমতা আমতা করাটা তাঁর কাছে না-বলারই সমতুল্য লেগেছে। ২৭ এপ্রিল থেকে অওরঙ্গাবাদের কাছে ওয়ালুজের কারখানায় ৮৫০ কর্মীকে নিয়ে উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে বাজাজ অটো। কিন্তু তা অংশত।
রাজীব-সহ অন্য সব ব্যবসায়ীই কিন্তু নিভৃতবাসকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে তাঁদের কথা হল, নিভৃতবাসের মূল যুক্তি-শৃঙ্খলের শুরুটা ঠিকই ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা আর যৌক্তিক পথে হাঁটছে না। এতে অপূরণীয় ক্ষতির রাস্তায় হাঁটছে অর্থনীতি। শৃঙ্খলের প্রথমে সবাইকে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়ার যুক্তি ছিল চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঠিক করে নেওয়া। আর একবার সেটা হয়ে গেলে বাজারের চাকাকে নিজের নিয়মে ঘুরতে দেওয়া। এক মাস পরেও সরকারের নীতিতে কিন্তু সেই আমতা আমতা ভাবটা কাটছে না।
বিভিন্ন হিসাব বলছে সরকারের এই ‘নীতি-তোতলামো’র কারণেই প্রতি দিন দেশের ক্ষতি হচ্ছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তার কারণ খুঁজতে ফিরে যাই কফির হিসাবে। আপনি যদি ফিল্টার কফি খেতে চান, আপনার ফিল্টার পেপার লাগবে। একটা খুলে দিলেন আর আর একটাকে আপনি বলে দিলেন আবশ্যক নয়, তা হলে কী করে হবে? বাজারের প্রতিটি পণ্যের উৎপাদনই আর একটি পণ্যের সঠিক জোগানের উপর নির্ভরশীল। আর নির্ভরশীলতার শৃঙখল কিন্তু আজকের অর্থনীতিতে খাতায় কলমে ঠিক করা যাবে না। আপনি সাইকেলের দোকান খুলতে দেবেন না, অথচ পাড়ার দোকানে না গিয়ে ফোন করে পণ্য আনিয়ে নেওয়ার কথা বলবেন। যে বেচারা দিতে আসবেন তাঁকে যদি দোকানি সাইকেল না দিতে পারেন, তা হলে তো তাঁকে পায়ে হেঁটে আমার আপনার বাড়িতে পণ্য সরবরাহ করতে হবে!
থেমে গিয়েছে কারখানার উৎপাদন।
সুখের কথা নানান দোকান খুলছে। কিন্তু ঠিক কী ভাবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গিয়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে হয়ত একটু অতি সরলীকরণ করে ফেললাম। কিন্তু ভাবুন তো এই বাজারে আপনাকে বেরোতে হবে, অথচ আপনার গাড়ির চাকাটা গেল ফেটে! কী করবেন? টায়ারের দোকান যে বন্ধ! শিল্প উৎপাদনও এই না-বাজারে একই যুক্তিতে আরও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। কোনটা অত্যাবশ্যকীয় আর কোনটা অনাবশ্যক তা নীতি নির্ধারকরা ঠিক করে দিচ্ছেন, আর তার ফল দাঁড়াচ্ছে ওই কফি ও ফিল্টার পেপারের গল্পের মতোই।
এই যুক্তি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন উৎপাদকরা। আর অসহায়তা গোপন করতে না পেরেই আনন্দ মহীন্দ্রা টুইট করে বলেছেন, এই লকডাউন শেষ হলে গোটা উৎপাদন ব্যবস্থা যেন খুলে দেওয়া হয়। শিল্পপতি সরোজ পোদ্দার এই প্রতিবেদককে এক সাক্ষাৎকারে লাইসেন্স রাজ নিয়ে বলেছিলেন যে, তখন কারখানা চালাতে গেলে মেশিনের জন্য একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় স্ক্রু আমদানি করতে হলেও আমলাদের তোষামোদ করতে হত। কারণ, তৎকালীন নীতি নির্ধারকরা দেশের ভাল করার অজুহাতে অনু-পরিচালন ব্যবস্থা পছন্দ করতেন। “কিন্তু উৎপাদনের এত কোটি প্রয়োজন কি কেউ হিসাব করতে পারে? তাই লাইসেন্স রাজ তুলে দেওয়ার পরই দেশের এই উন্নতি”— বলেছিলেন সরোজবাবু।
না। এর থেকে যদি কেউ মনে করেন নিভৃতবাসের প্রয়োজনীয়তাকে কেউ ছোট করে দেখছেন তা হলে ভুল করবেন। যে চাহিদাটা বাজারে উঠে আসছে, তা হল পেটের। পাঁচ-শালা পরিকল্পনার যুগের অণু-পরিচালন পদ্ধতি এখন অচল। সহজ পথ হল সবাইকে ঘরে বন্ধ করে রাখ। আর দক্ষ পথ হল নিভৃতবাসকে চালু রেখেই বাজার উন্মুক্ত করা। নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে চাহিদা নীতি-তোতলামোর নয়, এই দক্ষতার পরিচয়ের। শুধু শিল্পের নয়। ছাত্র থেকে অবসরপ্রাপ্ত বা দিন-আনি-দিন খাই মানুষ— প্রত্যেকেরই। ফ্লাইপাস্ট বা ঘণ্টাধ্বনির বাইরে কিন্তু এখনও সেই আশা আলো দেখেনি সেই ভাবে। হয়ত হবে। কিন্তু কে জানে কবে!
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy