লকডাউনে গার্হস্থ্য হিংসা ও বিশেষত নারীর উপরে অত্যাচার ও হেনস্থা বাড়িয়াছে, খবর মিলিয়াছিল আগেই। এই বার জানা গেল, আক্রান্ত শিশুরাও। যে নম্বরটি গোটা দেশেই ‘চাইল্ড হেল্পলাইন’ হিসাবে চালু, সেই ১০৯৮-এ লকডাউনের প্রথম দশ দিনে তিন লক্ষ ফোন আসিয়াছে। কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের হইয়া যে অলাভজনক সংস্থাটি এই হেল্পলাইন নম্বর পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করিয়া থাকে, তাহারা জানাইয়াছে— ফোনে অপর প্রান্তের জিজ্ঞাসাগুলির অনেকাংশই কোভিড-১৯ বিষয়ক, কিন্তু তদধিক এই আপৎকালে শিশুর শারীরিক ও মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্য সংক্রান্ত। এই অস্বাচ্ছন্দ্যের উৎস পরিবারের কোনও সদস্য বা অনেক সময় শিশুর প্রধান অভিভাবক। হেল্পলাইনে শিশু নিজে বা তাহার হইয়া কেহ ফোন করিতে পারে, কিন্তু লকডাউন চলাকালীন শিশুর হেনস্থাকারীও বাড়িতেই থাকায় কাজটি কঠিন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তথাপি সংখ্যাই প্রমাণ, গৃহমধ্যে শিশুরা ভাল নাই।
শিশুরা স্বভাবত প্রাণচঞ্চল। তাহারা সব বুঝিতে পারে, কিন্তু অনেক সময় বলিতে পারে না। উপরন্তু ভারতীয় শ্রেণিকক্ষ ও সমাজ তাহাদের মজ্জামধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেয় এই ভাবনা, আঙুল তুলিতে নাই, প্রশ্ন করিতে নাই। প্রশ্ন করিলেই বা শুনিতেছে কে, শিশুরা শিশু বলিয়াই তাহাদের ধমক-হুমকি-চড়চাপড়ে চুপ করাইয়া দেওয়া সহজ। আর রুদ্ধদ্বার গৃহমধ্যে শিশুর আর্ত চিৎকার যে খেলনা বাঁচাইবার নহে, নিজেকেই বাঁচাইবার দুর্বল প্রতিরোধের প্রয়াস, বুঝিতেছে কে? নারী ও শিশুকে নিগ্রহের প্রশ্নে ভারতে উচ্চ-নীচ, শিক্ষিত-মূর্খ, ধনী-নির্ধনে তারতম্যও নাই। ভারতে শিশু জনসংখ্যা বিশ্বে সর্বাধিক, কিন্তু এই বিপুল সংখ্যার সুষ্ঠু প্রতিনিধিত্ব নিতান্ত অপ্রতুল। লকডাউনে অগণিত বাবা-মা সমাজমাধ্যমে পরিবারের শিশুটির সহিত সময় কাটাইবার ছবি দিতেছেন, তাঁহারা ‘বাড়ি বসিয়া কাজ’ করিবার মধ্যে শিশু কী রূপ লম্ফঝম্প আবদার করিয়া বাড়ি মাথায় করিয়াছে তাহার স্নেহসুন্দর বয়ান লিখিতেছেন। এ হেন চিত্র ও বিবরণই অধিক, কিন্তু আধিক্যই যে সত্য ও শেষ কথা, তাহা কে বলিবে? প্রদীপের তলার অন্ধকারের ন্যায় গাঢ় হইতেছে শিশু-নিপীড়নও, নতুবা হেল্পলাইনের স্বেচ্ছাসেবীগণ প্রমাদ গনিবেন কেন!
মনে রাখিতে হইবে, এই সকলই সেই সব শিশু, যাহারা ঘরের ভিতরে আছে। আর যাহাদের ঘর নাই, তাহারা? করোনা-পূর্ব সময়ে রোজ চায়ের দোকানে যে শিশুদের কাজ করিতে চোখে পড়িত, ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি দাঁড়াইলে অকস্মাৎ কোথা হইতে আসিয়া যাহারা ত্বরিৎগতিতে কাচ মুছিয়া দিয়া যাইত, ফুটপাতে যাহারা খেলিয়া বেড়াইত, এই সঙ্কটকালে তাহাদের খবর জানাইবে কোন হেল্পলাইন? মাথার উপর ছাদ থাকিলে স্নেহের সংস্থান কিছু নিশ্চিত হয়, যাহারা কোনও দিন ঘর চিনিল না, তাহাদের নিগ্রহ লুকাইবার আড়ালও নাই। প্রথাগত বৃত্তের বাহিরে বলিয়া তাহাদের কাছে পৌঁছানোও দুরূহ, তাহাদের দুর্দশা সতত দৃশ্যমান কিন্তু অদৃশ্য। ঘরের অন্তরালে নারীর উপর বহিয়া চলা হিংসাকে রাষ্ট্রপুঞ্জের নারীর সমস্যা বিষয়ক প্রধান ‘শ্যাডো প্যানডেমিক’ আখ্যা দিয়াছেন, এই ক্রান্তিকালে ঘরে-বাহিরে শিশুদের উপর নিপীড়ন সেই অতিমারিরই উপচ্ছায়া বলিলে খুব শিশুসুলভ হইবে কি?
আরও পড়ুন: এখন বাবার ওষুধ কেনা হবে কী করে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy