ছবি: এএফপি।
প্রশ্নগুলো এখন একেবারে পরিষ্কার। লকডাউন উঠবে কবে? এবং লকডাউন ওঠার পরে পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক অবস্থার দিকে এগোবে, নাকি আবার ব্যাপক হারে সংক্রমণ বেড়ে গিয়ে পুরো বিষয়টা গুলিয়ে যাবে?
আমরা সকলেই বুঝি (অনেক সময় রাজনীতির দায়ে মুখে অন্য কথা বলি) বিশ্ব এখন পুরোপুরি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। ফলে জ্যোতিষশাস্ত্র ব্যবহার করে লকডাউন তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। চটজলদি কোনও বিধাতাও স্বপ্নে সমাধান দিয়ে যাবেন না। অর্থাৎ লকডাউন তোলার হিসেবনিকেশ যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনার মাধ্যমেই ঠিক হবে।
তবে মনে রাখতে হবে সেখানে শুধু বিজ্ঞান নয়, সমাজবিজ্ঞানেরও কিছুটা দায় থাকবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিষয়টা একেবারে পরিষ্কার। আপাতত বিভিন্ন ওষুধ, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি দিয়ে চেষ্টা করা হবে গুরুতর অসুস্থদের বাঁচাতে। তার পর অপেক্ষা ভ্যাকসিনের জন্যে।
ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে পুরোদমে। অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে মানুষের ওপর এই সমস্ত প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয় না-মানুষদের অনেকটা সময় ধরে পরীক্ষা করার পর। এ বার সেই সময়টুকুও নেই। ফলে নিয়মের ক্ষেত্রে অনেকটা ছাড় দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভ্যাকসিন বানানোর কাজ চলছে। তার সফলতার উপর নির্ভর করছে মানুষ কত তাড়াতাড়ি একেবারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
তা হলে সামনের দিনগুলোতে কী ভাবে কাজ শুরু হবে? এখানেই আসছে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি যার মধ্যেই পড়ে। অবশ্যই অন্তর্জালের মাধ্যমে বাড়ি থেকে কাজ করার বিষয়টি চালু হয়ে গিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের উচ্চতম আধিকারিকরা মনে করছেন, এমনটাই চলবে সামনের দিনগুলোতে। কারণ করোনার আক্রমণ স্তিমিত হলেও এই ব্যবস্থায় সংস্থার খরচ কমে যাবে অনেকটা।
অন্যান্য অনেক ব্যবসায় কিন্তু সামনের দিনে ভীষণ বিপদ। সে তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই, তবে বাঙালি নিশ্চয় এ বার পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার আগে তেত্রিশবার ভাববেন। অর্থাৎ পরিবহণ, হোটেল, পর্যটন এই সব ক্ষেত্রে আঘাত যে কতটা সাংঘাতিক তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
অর্থাৎ সাময়িক লকডাউন উঠে যাওয়াটা এই মুহূর্তে একেবারেই হাঁটু ঝাঁকানো প্রতিক্রিয়ায় কিছু সিদ্ধান্ত। করোনাকে স্বাভাবিক ধরে নিলে গোটা সমাজব্যবস্থা বদলাতে হবে, আর কোভিড-১৯ বিদায় নিলেও বছরখানেকের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া শক্ত।
আরও পড়ুন: অনিশ্চয়তায় ধুঁকছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা
আরও পড়ুন: দেশ জুড়ে ১৭ মে পর্যন্ত বাড়ল লকডাউনের মেয়াদ
এ বার প্রশ্ন উঠবে এই সমস্ত অনুসিদ্ধান্তে আমরা আসছি কী ভাবে? সবটাই কি তথ্য ঘেঁটে, নাকি গোটা পরিস্থিতি বিচার করে অনুমানের মাধ্যমে? সোজা বাংলায় বলতে গেলে গোটাটাই অনুমান। তা হলে এত যে লেখচিত্র ভেসে বেড়াচ্ছে চারদিকে তার কি কোনও মূল্য নেই? মূল্য আছে শুধু এর মধ্যে জোগাড় হওয়া ডেটার, যদি তা ঠিক থাকে। কিন্তু তার উপর ভিত্তি করে যে সমস্ত রাশিবিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা জটিল উচ্চঘাতবিশিষ্ট সমীকরণের মাধ্যমে লকডাউনের দিন স্থির করার কথা হচ্ছে তার সত্যতা নিয়ে প্রচুর সন্দেহ আছে। তার মানেই কি সেগুলো পুরো মিথ্যে? তাও নয়, বরং বলা ভাল সেগুলো সত্যি বা মিথ্যে কিছুই নয়, অনুমান মাত্র। অর্থাৎ তার কিছু মিলবে, আর কিছু মিলবে না, কিছু হয়ত আংশিক মিলবে। আর এই মেলা না মেলার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব বা অসাফল্য নেই। এই অসম্পূর্ণতা একেবারেই বিজ্ঞানের অংশ।
মুশকিল হল চটজলদি ছাপা হচ্ছে তথ্যভিত্তিক হাজার হাজার গবেষণাপত্র, আর তার থেকে সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাখ্যা শোভা পাচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। আমজনতা ধন্দে পড়ছেন। যে বিষয়টা এখানে বলা প্রয়োজন তা হল— কয়েকজন শিক্ষিত মানুষ চায়ের দোকানে বিভিন্ন তথ্য মুখে মুখে আলোচনা করলে যেটুকু বুঝবেন তার থেকে খুব বেশি কিছু খবর এই গবেষণাপত্রগুলিতে নেই।
কোনও বিশেষ গবেষণাপত্রের আলোচনায় না গেলেই ভাল হতো। তবে এই মুহূর্তে অন্তর্জালে বহুল প্রচারিত হচ্ছে সিঙ্গাপুরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আকাশপাতায় আঁকা কিছু লেখচিত্র। ইন্টারনেট চালু করে https://ddi.sutd.edu.sg/-এ পৌঁছে গেলেই হল। গাদা গাদা লেখচিত্র আপনার হাতের মুঠোয়। তার মধ্যে ভারতেরটা এখানে এঁকে দেওয়া হল।
সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের ওয়েবসাইটে
ভারতের কোভিড-মুক্তির সম্ভাব্য সময় তুলে ধরা হয়েছে এই লেখচিত্রে।
এখানে বলা হচ্ছে ভারতের ৯৭ শতাংশ সমস্যা মিটে যাবে মে মাস শেষ হওয়ার আগেই, ৯৯ শতাংশ সমস্যা মিটবে জুনের প্রথম সপ্তাহে। আর ছবিতে নেই, কিন্তু একটা সারণিতে বলা আছে পুরোপুরি ঝামেলা মিটতে অগস্টের প্রথম দিন দশেক। অর্থাৎ আগস্টের শুরুতে আমাদের দেশ একেবারে সংক্রমণমুক্ত।
এমনটা কল্পনা করতে ভালই লাগে। তবে কোনও ভ্যাকসিন ছাড়া এই অসুখ মাস তিনেকের মধ্যে একেবারে বিদায় নেবে এটা কি খুব সরল অনুসিদ্ধান্ত বলে মনে হয় না? মনে রাখবেন এই রোগ শুরু হওয়ার পর থেকে চার মাসের বেশি পেরিয়ে গিয়েছে, এবং এখনও বিশ্ব জুড়ে অবস্থা তথৈবচ। উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় গাদা গাদা পরীক্ষা আর সামাজিক দূরত্ব। সেটা যত ভাল ভাবে করা যাবে ততই এই রোগ থেকে বাঁচা যাবে তাড়াতাড়ি।
আর ভারতের মত দেশে মে মাসের শেষে যদি সংক্রমণের পরিমাণ মোট আনুমানিক সংক্রমণের ৩ শতাংশ থাকে, সে ক্ষেত্রে মোট সংক্রমণ এক লক্ষ ধরলে তখনও সংক্রমিত থাকবেন তিন হাজার মানুষ। আর এর সঙ্গে ভেবে নিন অন্যান্য কিছু সম্ভাবনার কথা যেখানে বলা হচ্ছে যে বিশ্ব জুড়ে উপসর্গবিহীন কোভিড আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা পরীক্ষিত তথ্যের দশগুণ পর্যন্ত হতে পারে। সাবধানে না থাকলে তাই লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আবার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াটাই বিজ্ঞান। ঘণ্টার মত কিছু লেখচিত্র, এস কার্ভ, সার মডেল, লজিস্টিক রিগ্রেসন, এই সব দিয়ে চোখ ধাঁধানো গবেষণাপত্র লেখা খুব শক্ত নয়, কিন্তু জনগণ তাতে ঘেঁটে না গেলেই মঙ্গল। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের গবেষক জিয়ানশি লুয়োর গবেষণাপত্রটি যদি কেউ মন দিয়ে দেখেন, তা হলে বুঝবেন যে তাতে নতুন কোনও খবর একেবারেই নেই। পুরোটাই আপনার আমার চায়ের দোকানের অনুমানের মতোই। তার সঙ্গে বিধিসম্মত সতর্কীকরণও দেওয়া আছে যে বাস্তব অবস্থান এবং বিভিন্ন সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত অনুমান বদলাবে ক্ষণে ক্ষণে। অর্থাৎ প্রতিদিনকার ডেটা দেখে গ্রাফ বদলাবে ধীরে ধীরে এবং শেষে সেটা মিলিয়ে দেওয়া হবে বাস্তবের সঙ্গে।
সিঙ্গাপুরে বসে কাজ করছেন জিয়ানশি লুয়ো। সেখানে আইনকানুন অত্যন্ত কঠিন। লকডাউনের নিয়ম ভাঙলে শাস্তি যথেষ্ট। কিন্তু গত দু’সপ্তাহ ধরে সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে কাজ করতে যাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে বিপুল ভাবে। দেখে নেওয়া যাক সিঙ্গাপুরের প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা এবং সঙ্গে জিয়ানশির লেখচিত্র।
সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের ওয়েবসাইটে সিঙ্গাপুরে এ যাবত্
দৈনিক কোভিড সংক্রমণের সঙ্গে ভবিষ্যতে সংক্রমণ কেমন হবে তার সম্ভাব্য লেখচিত্র
এখানে বলা হচ্ছে মে মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহেই নাকি সিঙ্গাপুরে সংক্রমণের মাত্রা কমে যাবে অনেকটা আর জুনের দশ তারিখের মধ্যে সে দেশ সংক্রমণমুক্ত। অন্য দিকে সিঙ্গাপুরে থাকা সহকর্মীদের কাছ থেকে খবর পাচ্ছি যে— সে দেশের প্রশাসকেরা অত্যন্ত সতর্ক এবং এই ধরণের ভবিষ্যৎবাণীর ওপর নির্ভর করে সে দেশে লকডাউন উঠে সব কিছু স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। এই সমস্ত ভুলে আমাদের বরং নজর রাখা ভাল দক্ষিণ কোরিয়া এবং নিজেদের দেশের মধ্যে কেরালা আর গোয়ার দিকে। সংক্রমণ মুক্তির উপায় শিখতে গেলে এই জায়গাগুলোই আপাতত সঠিক পথ দেখাবে।
আমাদের দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা পরিষ্কার থাকাই মঙ্গল। আংশিক লকডাউন প্রত্যাহার করাটা অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে জরুরি। সেটা ঠিক করবেন কেন্দ্র-রাজ্যের শাসক এবং প্রশাসকরা। পরিসংখ্যান তাঁরা দেখবেন, এবং নিজেদের মত করে বুঝবেন। দরকার হলে তাঁদের আরও ভাল ভাবে বোঝার জন্যে লেখচিত্র এঁকে দেওয়ার মত পরিসংখ্যানবিদ আমাদের দেশে অনেক আছেন। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের রাশিবিজ্ঞানের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ অনুমানও একেবারে প্রাথমিক কাজ। দেশে ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স কমিশন আছে, যাঁরা সরকারকে যথোপযুক্ত পরামর্শ দিতেই পারেন। অবশ্যই কোনও রাজ্যের সংক্রমিত এবং মৃত মানুষের পরিসংখ্যান নিয়ে খেলা করাটা এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিষয়টা নিশ্চয় সরকারের লোকজন বুঝছেন।
সাধারণ মানুষ ছাড়াও এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের তথ্য বিশ্লেষণ বিশেষভাবে জরুরি। সৈন্যবাহিনী শক্ত না থাকলে এ লড়াইতে আরও বেশি পিছিয়ে পড়তে হবে। অন্য দিকে এই বিপদের মধ্যে নিম্নবিত্ত মানুষদের অতিরিক্ত সুবিধে দিতে হবে। না হলে ঘিঞ্জি বস্তিতে থাকা এবং দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলির পক্ষে লকডাউন মানা অবাস্তব এবং অসম্ভব।
সবশেষে বলতেই হয়— লকডাউন আমাদের দেশে বিপুল ভাবে সংক্রমণ না ছড়ানোর একটা বড় কারণ। যতই লকডাউন ভাঙার খবর আসুক না কেন, তা এক-একটি এলাকার মধ্যেই। সংক্রমণের ব্যাপ্তি তাই লকডাউনে নিয়ন্ত্রিত। বনগাঁ, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান এই সব জায়গা থেকে যদি নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে যায় এখনই এবং কলকাতা শহরের মধ্যে আবার যাতায়াত করে ভিড় বাস, তা হলে সংক্রমণ যে হইহই করে বাড়বে সেটা বোঝার জন্যে বিদেশের আকাশপাতা থেকে লেখচিত্র ধার নেওয়ার প্রয়োজন নেই। শত সমালোচনা সত্ত্বেও ভারতবাসী হিসেবে আমাদের নজর থাকুক সরকারের সিদ্ধান্ত এবং ঘোষণার দিকে। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইতে সারা বিশ্বের নিরিখে আমরা যথেষ্ট এগিয়ে আছি। সরকারের নেওয়া লকডাউনের সিদ্ধান্ত দেশকে কোনও জাদুবলে চটজলদি কোভিড মুক্ত করতে পারবে না, আবার লকডাউন তুলে দিলেই যে অর্থনীতি হঠাৎ করে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে উদয় হবে এমনটাও নয়। তবু এর মধ্যে একটুকরো রোদের ফালি— আমাদের দেশে সংক্রমণের সংখ্যা এখনও নিয়ন্ত্রণে থাকা। সেই তালিকায় ধারাভির বস্তিও আছে। পিছিয়ে থাকা দেশে নিম্নবিত্ত মানুষদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই আমাদের অজানা স্ট্যাটিস্টিক্স, লেখচিত্র যার নাগাল পায় না।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy