‘কোয়রান্টিন’ কেন্দ্র। উনবিংশ শতকের শেষ দিকে মধ্যপ্রাচ্যের গাজায়। ছবি: আইস্টক
মানব ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখব, সংক্রামক অসুখ সম্পর্কে বা অসুখের সংক্রমণের কার্যকারণ সম্পর্কে ধারণাটি ছিল একেবারেই ধোঁয়াশায় ঢাকা, অস্বচ্ছ। এই ধারণার সঙ্গে মিশে ছিল কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ‘মিথ’। অসুখকে মেনে নেওয়া হত ঈশ্বরের অভিশাপ হিসাবে। উপায়হীন বশ্যতা ছিল ধর্ম, পুরোহিত, ওঝাদের কাছে। হিপোক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব তিন-চার শতকে প্রথম অসুখের থেকে কুসংস্কারকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি পরিবেশের ‘বিষবাষ্প’ বা ‘মিয়াসমা’-কে এবং শরীরের চার তরল বা ‘হিউমর’-কে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
এক একটি অণুজীব বা কীটাণু যে এক এক রকম অসুখের জন্য এবং তা সংক্রমণের জন্য দায়ী, সেই ‘জীবাণু তত্ত্ব’ বা ‘জার্ম থিয়োরি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বৈজ্ঞানিক লুই পাস্তুর ও রবার্ট কক, শুরু হয়েছিল অণুজীববিদ্যার স্বর্ণযুগ। তার আগে জীবাণুতত্ত্বের আভাস দেন ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ইটালির চিকিৎসক ও কবি গিরোলামো ফ্রাঙ্কাস্তারো। সে সময়ের দুর্দমনীয় ‘সিফিলিস’ অসুখের প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, অসুখের ‘বীজ’ই-এর কারণ। দিয়েছিলেন সংক্রমণযোগ্যতার তত্ত্ব। এ সবের মাঝে পথ দেখিয়েছিল ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে এডওয়ার্ড জেনারের গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার আর ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে লিউয়েনহুক-এর মাইক্রোস্কোপে জীবাণুর চেহারা আবিষ্কার।
তবে আদিযুগে পরিষ্কার ধারণা না থাকলেও, সংক্রামক অসুখ যে এক জন থেকে আর একজনে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার জন্য যে সংক্রমিত জনের থেকে দূরত্ব রাখা দরকার, তা মানুষ বুঝতে পেরেছিল। বিভিন্ন অসুখ বিশেষ করে প্লেগ মহামারির প্রাদুর্ভাব প্রতিষ্ঠিত করেছিল সেই ধারণাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০-এর প্লেগ মহামারি ভয়ঙ্কর চেহারায় হাজির হয়েছিল এথেন্সে। তবে নথিভুক্ত প্রথম প্লেগ অতিমারি ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে, যা ‘প্লেগ অব জাস্টিনিয়ন’ নামে পরিচিত। এর পর পৃথিবীর ইতিহাসে কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক ডেথ’। ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া এই প্লেগ অতিমারিতে মৃত্যু ঘটে প্রায় ৭৫ কোটি মানুষের।
আরও পড়ুন- আইসোলেশন, লকডাউন সবই ছিল তিন হাজার বছর আগের ভারতে
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম দশকে রচিত হিব্রু বাইবেলের ‘বুক অব লেভিটিকাস’-এ মোজেস আইন অনুযায়ী, অসুস্থ মানুষকে আলাদা রাখার নির্দেশ পাওয়া যায়। ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে কুষ্ঠরোগীকে সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন রাখা ছিল একটি প্রাচীন ব্যবস্থা। প্লেগের ব্যাপারে হিপোক্রেটিস এবং তাঁর ভাবশিষ্য গ্যালেন-এর আপ্তবাক্য ছিল, ‘সাইটো, লঙ্গে, টারডে’ অর্থাৎ, স্থান পরিত্যাগ কর, সরে যাও বহুদূরে আর ফের ধীরে ধীরে। ‘প্লেগ অব জাস্টিনিয়ন’-এর সময় সম্রাট জাস্টিনিয়ন বাইরের প্লেগ অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে আগতদের আলাদা বা ‘আইসোলেশন’-এ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই সময়ে চিনের শাসকেরা নাবিক এবং বিদেশিদের জন্য একই পথ অবলম্বন করেছিলেন। তবে সংক্রমক রোগী বা সম্ভাব্য রোগীদের আলাদা বা ‘আইসোলেশন’-এ রাখার, যা পরে পরিচিতি পায় ‘কোয়রান্টিন’ নামে, তার সূচনা হয় তেরোশ’র শতকে।
আরও পড়ুন: করোনা রুখতে আয়ুর্বেদে আস্থা আয়ুষ মন্ত্রকের, কী কী নিয়ম মেনে চললে দূরে থাকবে রোগ?
তবে প্রথমে ‘কোয়রান্টিন’ নয়, প্রথমে তার নাম ছিল ‘ট্রেনটিনা’। তখন প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল জলপথে। সংক্রমণের ঝুঁকি ছিল সমুদ্র তীরবর্তী নগরগুলিতে। তাই জাহাজগুলিকে বন্দরের আগেই নোঙর করে আটকে রাখা হল বাধ্যতামূলক। এটি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রথম প্রচলিত হয় ভেনিস প্রজাতন্ত্রের অধীনে থাকা অ্যাড্রিয়াক সমুদ্র তীরবর্তী বন্দরশহর রোগুসা-য়। এটি বর্তমানে ডুব্রভনিক নামে ক্রোয়েশিয়ার একটি শহর। রোগুসা-র সমুদ্রবন্দরের রেক্টর জারি করলেন ‘ট্রেনটিনা’। এটি একটি ইটালিয়ান শব্দ, যার অর্থ ‘ট্রেনটা’ বা ৩০ দিন। জলযানের বন্দরে আসা নিষিদ্ধ করা হল বা ‘সঙ্গরোধ’ করা হল ৩০ দিনের জন্য। আর স্থলপথে বহিরাগতদের জন্য জারি করা হল ৪৮ দিনের ‘সঙ্গরোধ’। ‘ট্রেনটিনা’ আইনের চারটি অনুশাসন ছিল, ক) বহিরাগত জলযানের জন্য ৩০ দিনের ‘সঙ্গরোধ’, খ) সেখানে রেগুসা-র কোনও অধিবাসীর যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, গ) দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া সেখানে কারও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, ঘ) আইন অমান্যকারীদের জন্য ধার্য ছিল জরিমানা এবং ৩০ দিনের ‘সঙ্গরোধ’। পরে সব কিছুর জন্য এই ‘সঙ্গরোধ’ হয় ৪০ দিনের। নামটি ‘ট্রেনটিনা’ থেকে পরিবর্তিত হয় ‘কোয়রান্টিন’-এ। কোয়রান্টিন শব্দটি এসেছে ইটালিয়ান শব্দ ‘কোয়রানটা’ থেকে, যার অর্থ ৪০ দিন।
‘সঙ্গরোধ’ ৪০ দিন করার কারণ হিসেবে বিভিন্ন রকম মত দিয়েছেন ইতিহাসবিদেরা। কেউ বলেন, এটি করা হয়েছিল হিপোক্রেটিসের ‘সঙ্কটপূর্ণ কাল’ মতবাদ অনুযায়ী। প্রাচীন এই গ্রিক মতবাদ অনুযায়ী সংক্রামক অসুখের প্রকাশ বা ফলাফল ৪০ দিনের মধ্যেই পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ এর মধ্যে পেয়েছেন ধর্মগত অনুষঙ্গ। যেমন, প্রথমত, বাইবেল বর্ণিত ‘মহাপ্লাবন’-এর সময় মোজেস সিনাই পর্বতে ছিলেন ৪০ দিন। দ্বিতীয়ত, প্রভু জিশু মরুভূমিতে উপবাস করেছিলেন চল্লিশ দিন। সেই অনুযায়ী খ্রিস্টানরা ‘ইস্টার’-এর আগে ৪০ দিনের অধ্যাত্মগত শুদ্ধিকরণ পর্ব পালন করেন (লেন্ট)। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এই ব্যবস্থার পেছনে শুধু স্বাস্থ্যগত কারণই ছিল না, অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তা হল,
বাণিজ্য ব্যবস্থাকে ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর থেকে রক্ষা করা।
১৪০৩ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৪২৩) ভেনিসের সান্টা মারিয়া ডি নাজারেথ দ্বীপে হল প্রথম কোয়রান্টিন কেন্দ্র ‘লাজারেট্টো’ বা চিকিৎসা-সহ আলাদা থাকার ব্যবস্থা। ‘লাজারেট্টো’ নামটি বাইবেলে বর্ণিত কুষ্ঠ রোগাক্রান্তদের সেবক সেন্ট লাজারাস-এর নাম থেকে এসেছে। পনেরোশ শতকে বলা হল, জাহাজের সঙ্গে ‘বিল অফ হেল্থ’ শংসাপত্র থাকতে হবে। তাতে প্রত্যয়িত থাকবে যে আগের বন্দরে কোন সংক্রমণযোগ্য অসুখ ছিল না। পরের ১০০ বছরের মধ্যে কোয়রান্টিন সম্পর্কিত এ সব আইন বলবৎ হল ইটালির ভেনিস-সহ পিসা, জেনোয়া, ফ্রান্সের মার্সেলস ইত্যাদি শহরে।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ইউরোপে জানান দিচ্ছিল কলেরা মহামারিও। কোয়রান্টিন সম্পর্কে সারা বিশ্ব জুড়ে একটি অভিন্ন নীতি বা আইন প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল সেই সময়ের দাবি। ফ্রান্স ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে এর জন্য প্রথম প্রস্তাব দিলেও প্রথম ‘আন্তর্জাতিক স্যানিটারি সম্মেলন’ হল ১৮৫১ সালে, প্যারিসে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থের মধ্যে লেগে যাচ্ছিল সংঘাত। ১৮৮৫ সালে রোম অধিবেশনে ভারত থেকে সুয়েজ খাল হয়ে যাওয়া পোতযানের পরীক্ষা নিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে হল তুমুল বিতণ্ডা। স্বাস্থ্যগত বিষয়ে নয়, তা হল সুয়েজ খালের
উপরে কার কতটা আধিপত্য থাকবে তা নিয়ে।
অবশেষে বিংশ শতাব্দীতে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হল ‘আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য সংস্থা’। প্রথমে এটিতে যুক্ত ছিল ২০টি দেশ। বিজ্ঞপ্তিযোগ্য অসুখ হিসেবে প্লেগ, কলেরা, ইয়েলো ফিভারের সঙ্গে যুক্ত হল গুটিবসন্ত ও টাইফাস। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই সংস্থার উদ্যোগে ভূমি, জল ও বিমান—সব ধরনের যাত্রীদের জন্যই চালু হল কোয়রান্টিন আইন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এই সংস্থাই পরিণত হল বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা-য়। ‘কোয়ারান্টিন অসুখ’ এই শব্দবন্ধের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট অসুখের নাম সরাসরি উল্লেখ করার নির্দেশ জারি হল।
উনবিংশ শতাব্দী থেকে সভ্যতার স্বাস্থ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল আর একটি সংক্রামক অসুখ। তা হল টিউবারকিউলোসিস বা যক্ষ্মা। সংগত ভাবেই তাকে ‘সাদা প্লেগ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এর চিকিৎসার এক প্রধান অঙ্গ ছিল আলাদা রেখে কোয়রান্টিন-প্রতিম ‘স্যানেটোরিয়াম’-এর ব্যবস্থা। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্ট্রেপটোমাইসিন ও পরে অন্য ওষুধ আবিষ্কারের পরে বাসগৃহে চিকিৎসা অনুমোদিত হওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থা চালু ছিল। কৌশল হিসেবে এই ব্যবস্থা বেশ সুফল দিয়েছিল । কোভিড-১৯ এর আগ্রাসী আক্রমণে সভ্যতার স্বাস্থ্য আজ চরম সঙ্কটে। বিজ্ঞানের হাতে নেই ভাইরাস-নাশক ওষুধ, নেই রোগ-প্রতিরোধক ভ্যাকসিনও। ভরসা কোয়ারান্টিন এবং সহধর্মী লকডাউন, আইসোলেশন-এর মতো ‘সঙ্গরোধ’ ব্যবস্থা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে এই একবিংশ শতাব্দীতে।
লেখক পরিচিতি : আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy