Advertisement
২০ জানুয়ারি ২০২৫
Coronavirus

লকডাউনে স্বস্তির সঙ্গে বন্যপ্রাণের বিপাকও

আকাশ পরিষ্কার। পরিবেশে শব্দ নেই। আচমকা সামনে চলে আসছে বিভিন্ন প্রাণী। সবই ইতিবাচক দিক। এত সুন্দর ছবিতে আশঙ্কার কিছু নেই। সত্যিই কি নেই? জল-জঙ্গলে খোঁজে আনন্দবাজার ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলে বহু বন্যপ্রাণ রয়েছে। ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে শেয়াল, বুনো শুয়োর, ভারতীয় নেকড়ে বা হুড়াল আছে। আছে বুনো খরখোশ।

ভারতীয় নেকড়ে। ডানদিকে বনবিড়াল। ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড়ে।  ছবি বিশ্বরূপ মণ্ডলের সৌজন্যে

ভারতীয় নেকড়ে। ডানদিকে বনবিড়াল। ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড়ে। ছবি বিশ্বরূপ মণ্ডলের সৌজন্যে

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২০ ০১:৫৮
Share: Save:

আশার কথা শুনিয়েছেন জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করা বিশ্বের তাবড় গবেষকেরা। তাঁরা জানিয়েছেন, লকডাউনের সময়েও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এবং রক্ষার কাজ চলছে। জাতীয় উদ্যান এবং অভয়ারণ্যগুলোতে কর্মী-আধিকারিকেরা নজরদারি চালাচ্ছেন। আশার আরেকটি দিক, এই সব সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে মানুষের যাতায়াত কমেছে। তাতে সংবেদনশীল বিভিন্ন প্রাণীগুলো একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে। এটা ওই প্রাণীগুলোর ভবিষ্যতের পক্ষেও ভাল।

এমন আশার কথা প্রকাশিত হয়েছে জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করা বিশ্বের নামী জার্নাল ‘বায়োলজিক্যাল কনজারভেশন’এ। এই জার্নালের প্রতিবেদকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চালু করা লকডাউনের ফল জীবজগতের উপরে কতটা পড়েছে তা এখনই বলা ঠিক নয়। তা চটজলদি সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ভাল ফল একটা তো মিলছেই। উপগ্রহের সাহায্যে পাওয়া ছবিতে দেখা গিয়েছে বাতাসে দূষণের পরিমাণ অনেক কম। কারণ যান চলাচল বন্ধ। বিশ্বজুড়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের উপরের চাপ কমেছে। কিন্তু এই সুফলগুলো সবই সাময়িক। গবেষকেরা কেউ নিশ্চিত নন অতিমারি শেষের পরেও ফল কতটা আশাজনক থাকবে। শব্দ, বায়ুদূষণ, জলদূষণ, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন, সবই ফিরে আসবে দুনিয়ায়। তখন কী হবে?

এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলে বহু বন্যপ্রাণ রয়েছে। ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে শেয়াল, বুনো শুয়োর, ভারতীয় নেকড়ে বা হুড়াল আছে। আছে বুনো খরখোশ। রয়েছে পিপীলিকাভুক। একবার হায়না দেখা গিয়েছিল। বন দফতর হায়নাটাকে ফাঁদ পেতে ধরে। ঝাড়গ্রাম চিড়িয়াখানায় দু’টো হায়না রয়েছে। একটা হায়না ওই বন দফতরের ধরা পড়া হায়না। আরেকটি হায়না ধরা পড়েছিল পুরুলিয়ার কোটশিলা থেকে।

লকডাউনের ফলে এখন মানুষজনের জঙ্গলে যাওয়া কমেছে। এই সময়ে বন্যপ্রাণেরা স্বস্তিতেই রয়েছে। লকডাউন কি জঙ্গলের জীববৈচিত্রের ক্ষেত্রে ভাল ফল দেবে? এ বিষয়ে বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বন আধিকারিক সমীর মজুমদার। তাঁর কথায়, ‘‘একটা ভাল হল হতে পারে। লকডাউনের কারণে এখন মানুষ ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না। ফলে অন্য বছরের তুলনায় জঙ্গলের ঝরা পাতায় আগুন লাগানোর খবর কম। জঙ্গলের আগুনে গাছের ক্ষতি তো হয়ই। বহু পোকামাকড় মারা যায়। মাটির উপরিভাগ শক্ত হয়ে যায়। এর পরেই আসবে বর্ষাকাল। তখন ওই মাটির শক্ত স্তর বৃষ্টির জলে ধুয়ে যায়। আগুন কম লাগানো হচ্ছে মানে গাছপালা এবং ছোট প্রাণীর রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা।’’ তিনি জানিয়েছেন, বৃষ্টি হলে গভীর জঙ্গলে ঝোপঝাড় লতাপাতা বাড়বে। তাতেও বহু পোকা, পাখির বাস হবে। আর আগুন লাগানো পরপর কয়েক বছর আটকাতে পারলে ছোট গাছগুলো নির্দিষ্ট উচ্চতা পেয়ে যাবে। গাছ নির্দিষ্ট উচ্চতা পেয়ে গেলে জঙ্গলের আগুনে তেমন ক্ষতি হবে না। বর্ষায় জঙ্গলের বিভিন্ন জলাশয়গুলোর জলস্তর বাড়বে।

এখন প্রশ্ন হল, লকডাউনের মেয়াদ যদি বাড়ে? অক্টোবর নাগাদ বেশ কিছু প্রাণী বাচ্চা প্রসব করে। যদি জঙ্গলে মানুষের পা না পড়ে বা আগুন না লাগে ছোট ছোট বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। তবে অবসরপ্রাপ্ত বন আধিকারিক মনে করছেন, লকডাউনের একটা খারাপ ফলের সম্ভাবনা রয়েই যাচ্ছে। সেটা হল মানুষের অসহায়তা। লকডাউনের কারণে বহু মানুষ কর্মহীন। পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামের বহু মানুষ দিনমজুরির উপরে নির্ভর করেন। যদি তাঁদের কাছে ঠিক মতো খাবার না পৌঁছয় বা খাবারের অভাব থাকে তাহলে ওই এলাকার বন্যপ্রাণের বিপদ হতে পারে। বিশেষ করে ছোট প্রাণীর। জঙ্গলের গাছ কাটাও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সমীরের। এই বিষয়টিকে একই সঙ্গে মানবিক এবং কঠোর ভাবে মোকাবিলা করা দরকার বলে তিনি জানাচ্ছেন।

সব কিছুরই ভাল-মন্দ রয়েছে। বলছেন ওড়িশায় ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় মৎস্য শিক্ষণ সংস্থার প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট কালীকৃষ্ণ মহাপাত্র। তিনি বললেন, ‘‘লকডাউনের ফলে জলজ পরিবেশের প্রভূত উন্নতি ঘটবে তার ইঙ্গিত আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীর বৃহত্তম খাঁড়িমুখের প্রায় সাড়ে ১৯ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পরিবর্তন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমাদের হিসেব মতো সাগরদ্বীপ থেকে দিঘার মুখ (বঙ্গোপসাগর) পর্যন্ত এই খাঁড়ি মুখ জলজ প্রাণীর যাতায়াতের পথ। আমাদের হিসেবে রয়েছে এই পথে সাড়ে চোদ্দ হাজার মাছ ধরার জাল বিছানো থাকে। একেকটি জালের দৈর্ঘ্য প্রায় চার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ ছাড়াও অসংখ্য ছোট নৌকো মাছ ধরে। বিপুল পরিমাণ কর্মকাণ্ড চলে এই জলপথে। এখন এসব বন্ধ।’’ কালীকৃষ্ণের মতে, এর ফলে বিভিন্ন জলজ প্রাণী, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, ইলিশ, ডলফিন, নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে পাবে। বিশেষ করে ভাল পরিবেশ, দূষণমুক্ত জল ইলিশ মাছের পরিযানের জন্য খুব দরকারি। তিনি জানিয়েছেন, লকডাউন কেটে গেলে এ বিষয়ে সংস্থা একটা তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে। তবে প্রাথমিক ভাবে তিনি একটা বিষয় নিশ্চিত করে দিয়েছেন, কম সময়ের জন্য হলেও এই যে পরিবর্তন হল এর দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাবে জলজ প্রাণীরা।

তবে কালীকৃষ্ণ ডাঙার প্রাণীদের বিপদের মতো একটা আশঙ্কা করছেন। সেই আশঙ্কা লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে। সেই বিপদ কী? কালীকৃষ্ণ জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে সেই জলপথে কোনও ধরনের জলযান যাতায়াত করছে না। অনেক জলজ প্রাণী যাতায়াতের পথ বদলে ফেলেছে। বিভিন্ন জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার চলাচলের যে চ্যানেলগুলি রয়েছে সেই চ্যানেলেও চলে আসছে জলজ প্রাণীরা। দু’মাসের বেশি সময় ধরে তারা এভাবেই অবাধ চলা ফেরা করবে। তাতে একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে যেতে পারে। লকডাউন উঠে গেলে এই জলজ প্রাণীগুলোর পরিবর্তনটা বুঝে উঠতেই সময় লেগে যেতে পারে বলে মত বিজ্ঞানীর। সেক্ষেত্রে একাধিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকতে পারে। মারা যেতে পারে কিছু জলজ প্রাণী। কালীকৃষ্ণ বলছেন, ‘‘তবে সবটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাবে তার দিকে আমরা গভীর ভাবে নজর রাখছি।’’

‘বায়োলজিক্যাল কনজারভেশন’ আরেকটি আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। অর্থনীতির উপরে লকডাউনের নিশ্চিত প্রভাব পড়েছে। লকডাউন উঠলে বিপাকে পড়তে পারে জঙ্গল নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো। অর্থের জোগান কমবে। জীববৈচিত্র রক্ষায় তার পরোক্ষ প্রভাব পড়তে পারে।

তথ্য সহায়তা: আরিফ ইকবাল খান

আরও পড়ুন: রাস্তাঘাট সুনসান, কিন্তু ব্রিটেনের সুপারমার্কেটগুলিতে দেদার রি-স্টক হচ্ছে!

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy