আরও কত দিন? সব কিছু সত্যিই আবার আগের মতো হয়ে উঠবে তো? সমাজ-সংসার জুড়ে এখন এটাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং আলোড়নকারী প্রশ্ন। যদিও করোনার প্রকোপ এখনও অব্যাহত এবং বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই অভিমত, লকডাউন থেকে ছাড় পাওয়া মানেই লাগামছাড়া মুক্তি নয়। বরং বন্ধনডোর থেকে যাবে নানা রকম। এবং সেগুলি গুরুত্ব দিয়ে মেনে চলা উচিত। সব মিলিয়ে দেশ জুড়ে সামগ্রিক অনিশ্চয়তার মেঘ এখনও যথেষ্ট ঘন।
কিন্তু লকডাউনে দেশ থমকে থাকলেও রাজনীতি থেমে থাকে না। নিজের মাথা গলানোর ছিদ্র সে নিজেই অন্বেষণ করে নেয়। এই রাজ্যেও তাই ঘনিয়ে উঠছে করোনা-রাজনীতি। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার মতো দ্রুততায় তা নিছক শাসক-বিরোধী বিবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে সরকার বনাম রাজ্যপাল থেকে কেন্দ্র বনাম রাজ্যের বৃহত্তর পরিসরে ঢুকেও পড়েছে। বাংলার করোনা-পরিস্থিতি সহ খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে তড়িঘড়ি দুটি কেন্দ্রীয় দল পাঠানো এর এক বড় উপাদান। বলতেই হবে,বর্তমান পরিস্থিতিতে দিল্লির এই পদক্ষেপ অবশ্যই ঘোরতর রাজনৈতিক এবং অর্থবহ।
বিষয়গুলি ক্রমশ যে ভাবে পাকিয়ে উঠতে শুরু করেছে, তাতে এর জের গড়াবে বলেই মনে হয়। একুশের বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রাখলে তার পিছনের কারণ বোঝাও হয়তো খুব কঠিন নয়। তালিও, তাই, এক হাতে বাজছে না।
আরও পড়ুন: উহান তো আমাদেরই কীর্তি
বড় বিপর্যয় হলে তাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি চির কাল হয়ে থাকে। সব আমলেই সরকার এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীরা এ সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, দলবাজি, দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। কোন ক্ষেত্রে তার কতটা সঠিক, কতটা ভুল সে সব সর্বদাই বিতর্কের বিষয়। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে জনমত আদায়ের লক্ষ্যে এটি চেনা পন্থা।করোনা-মোকাবিলার এই পর্বে তারই প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে।
সবাই জানেন, বাংলায় এই যুদ্ধের সূচনা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সর্বস্তরে প্রশংসা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সহায়তার অপেক্ষা না রেখেই রাজ্যের নিজস্ব সঙ্গতিতে আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষার বিবিধ কর্মসূচি নিয়ে মমতা প্রথম থেকে যে সব পদক্ষেপ করেছেন, তাতে সমালোচনার তেমন কোনও ফাঁক বিরোধীরাও খুঁজে পায়নি। বরং এর ফলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জমি শক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তারা আঁচ করেছিল।
আরও পড়ুন: মরিয়া পরিযায়ীদের যন্ত্রণা দেখিয়ে দিল, ধনতন্ত্র কী বস্তু
গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে ত্রাণ বিলি শুরু হতেই ছবির বদলটা চোখে পড়ে। শাসকের বিরুদ্ধে দলবাজির অভিযোগ তুলে বিরোধীরা তাদের রাজনীতিটা ফের কিছুটা গরম করে নেওয়ার মওকা পায়। প্রায় ফস্কে যেতে বসা লাগামটা একটু হাতে পাওয়ার কৌশলও তো বটে!
এ কথা ঠিক, রেশনের চাল-গম দোকান থেকে তুলে নিয়ে শাসক তৃণমূলের কতিপয় সিকি-আধুলি মার্কা নেতা ত্রাণ বিলির রাজনীতি শুরু করছিলেন।খবর আসছিল, অনেক জায়গায় প্রকৃত অভাবীদের দরজায় ত্রাণ আদৌ পৌঁছাচ্ছে না। অভিযোগের তির ছিল এক শ্রেণির রেশন ডিলারের দিকেও। একাধিক জেলা থেকে কিছু নির্দিষ্ট অভিযোগ গিয়েছিল প্রশাসনের উপরতলাতেও। তার পরেই দল এবং সরকার দু’দিক থেকে কড়া নির্দেশ জারি হয়। মুখ্যমন্ত্রী বলে দেন, রেশন বিলির দায়িত্ব পুরোপুরি প্রশাসন ও পুলিশের। কোনও দলের এতে কোনও ভূমিকা থাকবে না।
এর পরেও অভিযোগ আসা বন্ধ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। কারণ যে কথা আগেই বলেছি, এখানে কোন অভিযোগ কতটা ঠিক, তার চেয়েও বড় সত্যি হল, ত্রাণ বিলির মতো ক্ষেত্রে কখনও কোনওদিন শাসক ও বিরোধী পক্ষ সহমত হতে পারে না। এবং খাদ্যের বিষয়টি সরাসরি জনজীবনের মূল চাহিদার সঙ্গে জড়িত বলেই তা থেকে রাজনীতি তার নিজস্ব ভিটামিন খুঁজে পায়। শাসক তৃণমূলকে ত্রাণ-দুর্নীতিতে জড়াতে বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস সকলেই সে জন্য এত তৎপর। এমনকি, খেতে না-পাওয়ার নকল ‘নাটুকে’ ভিডিয়ো পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে!
কোন দল বা কোন নেতার মগজাস্ত্র এর পিছনে কাজ করেছে, সেটা এখানে মূল প্রশ্ন নয়। বিষয়টি চাউর করে দিয়ে কী ভাবে কার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো যাবে, সেই ভাবনাটাই আসল।
করোনা-হানার পরে সব কিছুই এখন একমুখী। বিধানসভার ভোটও হবে মূলত করোনাকে ভিত্তি করে। সেখানে করোনা মোকাবিলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে ত্রাণ-দুর্নীতির অভিযোগ বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, সে কথা সময় বলবে।
তবে তাঁকে এই ফাঁসে জড়িয়ে দিতে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এবং তাদের ঘনিষ্ঠ তথা সঙ্ঘ পরিবারের ভাবশিষ্য বলে পরিচিত বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় অনেকটাই আগুয়ান ভূমিকা নিয়ে ফেলেছেন। যদিও কেন্দ্র থেকে কত চাল বাংলায় পৌঁছেছে, তার হিসাব এখনও বেশ ধোঁয়াটে। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী দিন তিনেক আগে বলেছেন, রাজ্যের প্রয়োজন ন’লক্ষ মেট্রিক টন। এসেছে মাত্র ৪৫ হাজার। অন্য দিকে বিজেপি নেতারা কোনও নির্দিষ্ট হিসাব না দিয়েই শুধু ‘প্রচুর’ এসেছে বলে দাবি করে যাচ্ছেন। আর তাঁদের উৎসাহবৃদ্ধি করে ধনখড় জানিয়েছেন, চাল বিলি নিয়ে রাজ্যে যে ‘কেলেঙ্কারি’ চলছে, তা অতীতের সব কেলেঙ্কারিকে ম্লান করে দেবে। এর তদন্ত দরকার। পত্রপাঠ সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে যোগ্য সঙ্গত করেছে বিজেপি!
সিপিএম, কংগ্রেসের কথাও একটু আলাদা করে বলার মতো। তাদের ভোটের ভাঁড়ার যতই হাল্কা হতে থাক না কেন, করোনা-পরিস্থিতিতে সাধ্যমতো কাজ তারা করছে। প্রায় নিয়মিত নবান্নের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে তারা। তবে ভোট-রাজনীতির নিজস্ব অঙ্ক থাকে সবারই। তাই রেশন-অনিয়মের অভিযোগে লকডাউন ভেঙে পথে নেমে প্রতিবাদ সিপিএমের ভোটারদের অবশ্যই একটু বাড়তি অক্সিজেন জোগাতে পারে।
অন্য দিকে মমতা যে করোনা-ত্রাণের খাতে গরিবদের একটানা ছ’মাস বিনামূল্যে চাল দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছেন, সেটি তাঁরও নির্বাচনী কৌশলের একটি অঙ্গ বলা খুব ভুল হবে না। বস্তুত, যাঁরা এখনও খাদ্য সুরক্ষা যোজনার বাইরে, এই কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদেরও অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছেন। এঁদের সংখ্যা দু-আড়াই কোটি। সব মিলিয়ে কমবেশি ন’কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে ছ’মাস খাদ্যের জোগান দিয়ে যাওয়া একদিকে যেমন বিপুল চাপ, অন্য দিকে ‘জনমোহিনী’ পদক্ষেপও বটে। যদি ধরেও নেওয়া হয়, এক্ষেত্রে না-পাওয়ার অভিযোগ থাকবে দশ শতাংশের, পাওয়ার অঙ্ক তা হলে বাকি নব্বই!
এমন এক আবহে রাজভবন এবং রাজ্যের বিজেপি-র কাছ থেকে এক সুরে রেশন বিলিতে দুর্নীতি ও দলবাজির অভিযোগ গিয়েছে দিল্লির দরবারে। রাজ্যপাল তো সরকারকে হুমকি দিয়ে রেখেছেন, তিনি এটি হাল্কা ভাবে নেবেন না। ঘটনা হল, রাজ্যে আসা কেন্দ্রীয় দলকেও এই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
এই অসময়ে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের ক্ষেত্র এ ভাবে প্রসারিত হওয়ার পিছনে কোনও সুচিন্তিত কৌশল আছে কিনা, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিশেষত, বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতের মতো রাজ্যগুলিতে করোনা-পরিস্থিতি শোচনীয় হওয়া সত্ত্বেও সর্বাগ্রে বাছাই করা কয়েকটি বিরোধী রাজ্যে এমন দল পাঠানো হল কেন, তা-ও সন্দেহের উদ্রেক করে। রাজনীতির চাল কি সেখানেও?
তবে মানুষ চায় শুভবুদ্ধির জাগরণ। এমন নিদারুণ কঠিন পরিস্থিতিতেও যদি মেঠো রাজনীতিকে লকডাউনে না পাঠানো যায়, কিছু বলার নেই। নেতারা সবাই কিছু দিনের জন্য হাত ধরাধরি করে চলতে পারেন। তাতে আখেরে লাভ দশকোটি বঙ্গবাসীর।
আগে রাজ্য বাঁচুক, তারপর তো গদির লড়াই!
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy