কাটার অপেক্ষায়। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল
বেশ কয়েক মাস আগে যখন চিনের উহান প্রদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণের খবর এসেছিল, তখন থেকে আমরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে খবর রাখা শুরু করলেও সেই সময়ে কেউই ভাবতেও পারিনি মাত্র তিন-চার মাসের মধ্যে এই রোগ অতিমারির রূপ নেবে এবং ভারতেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করবে। কয়েক মাসের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস দু’লক্ষেরও কাছাকাছি প্রাণ নিয়েছে। তাকে ঘিরে আশঙ্কা ঘনীভূত হতে শুরু করেছে। নানা দেশ এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে লকডাউনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
এখনও পর্যন্ত এই রোগের কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, নেই কোনও নির্দিষ্ট ওষুধও। তাই এই সময়ে নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে রোগ সংক্রমণের বিপদ রোখাকেই পাখির চোখ করেছে দেশগুলি। গবেষকেরা জানাচ্ছিলেন, স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে এই রোগের হাত থেকে বাঁচতে শিল্প, কৃষি এবং পরিবহণ এই তিন ক্ষেত্রে পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করা হোক। পরিসংখ্যান বলছে, এই তিন ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম প্রভাব পড়তে চলেছে কৃষিক্ষেত্রের উপরে। কারণ, শিল্পক্ষেত্রের মতো এখানে উৎপাদন বন্ধ করে কাঁচামাল বাঁচিয়ে রেখে পরে উৎপাদন চালানো যেতে পারে না। কৃষিক্ষেত্রে সময় মতো ফসল তুলতে না পারলে এক দিকে, যেমন কৃষকেরা ঠিকমতো দাম পাবেন না, অন্য দিকে, তেমনই পুরো খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খলটাই ভেঙে পড়বে। এর জেরে বাজারে দেখা দেবে খাদ্যসঙ্কট। এই পরিস্থিতিতে কৃষিকাজকে অত্যাবশ্যকীয় কাজ হিসেবে চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে। তারই সঙ্গে নেওয়া হয়েছে উৎপন্ন ফসল বাজারজাত করার ব্যবস্থাও। পরিসংখ্যান বলছে, অক্টোবর ২০১৯ থেকে শুরু হওয়া রবি মরসুমে লাগানো বিভিন্ন ফসল যেমন গম, বার্লি, সর্ষে, জলদি হওয়া ঢ্যাঁড়শের মতো আনাজ এবং তৃণশস্য তোলার সময় এখন। এই সময়ে জমি থেকে ফসল তোলার জন্য শ্রমিক এবং ফসল বাজারজাত করার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার দরকার। আবার নতুন ফসল বোনার জন্য বীজ, সার, কীটনাশকের মতো জিনিস সংগ্রহেরও সময় এটি। এই অবস্থা চলতে থাকলে ফসল তুলে বাজারজাত করার পাশাপাশি, আগামী দিনে ভুট্টা, তিল, মুগ, কলাই এবং অন্য গ্রীষ্মকালীন ফসল রোপণেও সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিস্থিতিতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার সহজলভ্য নাও থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সমালোচকদের একাংশ। তাঁদের মতে এর জেরে ভারতীয় কৃষিকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হবে।
পরিসংখ্যান বলছে শুধুমাত্র কৃষি নয়, লকডাউনের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে পশুপালনের মতো জীবিকাও। কারণ, এই সময়ে উৎপাদিত শীতকালীন তৃণশস্যের একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় পশুদের খাদ্য হিসেবে। সেই ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে গবাদি পশুপালনে। আর পশুপালন ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিশ্ববাজারে দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের জোগানের ক্ষেত্রেও সঙ্কটের আশঙ্কা থেকে যায়।
আরও পড়ুন: উহান তো আমাদেরই কীর্তি
কৃষি এবং কৃষিজাত শিল্পের উপরে দেশের অর্থনীতির ১৭-১৮ শতাংশ নির্ভরশীল। এবং এই দুই স্তম্ভ দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের উপার্জনের ক্ষেত্র। ফলে এখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে গোটা দেশ জুড়ে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারের তরফে কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, সরকারের কাছে গচ্ছিত খাদ্যশস্য দিয়ে এই আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা গেলেও পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করতে গেলে খাদ্যশস্যের ঠিকমতো সরবরাহের দিকে নজর রাখা প্রয়োজন। এই জন্য চলতি মরসুমের উৎপাদন বাজারজাত করা ও পরবর্তী মরসুমের জন্য প্রস্তুতির কাজও চলা দরকার।
বর্তমানে দুই বর্ধমান জেলার নানা প্রান্তে পরিবহণ বন্ধ থাকার কারণে কৃষিশ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে। তাই বোরো ধান তোলায় কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তারই সঙ্গে ক্রমাগত ঝড় বৃষ্টিতে বোরো ধানের কিছু ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে। তবে সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে শীঘ্রই জেলার নানা প্রান্তে বোরো ধান তুলে তা বাজারজাত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সময়ে কৃষি শ্রমিকেদের কাজের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চলতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা। এর মূল কেন্দ্রে অবশ্যই রয়েছে সেই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার চিন্তা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, কাজের ক্ষেত্রে এক সঙ্গে বহু মানুষ নামলে কী ভাবে এই দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে।
এই সমস্যা মেটানোর জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তরফে বেশ কিছু নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, মাঠে যদি তৈলবীজ ও জালশস্য জাতীয় ফসল পড়ে থাকে তা হলে দ্রুত সেগুলি কেটে ঝাড়াই মারাই করে গোলাজাত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বোরো ধান, ভুট্টা, মুগ, কলাই ইত্যাদি ফসল কেটে নেওয়ার মতোই তা যন্ত্রের সাহায্যে কেটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা হলে কালবৈশাখী-সহ অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষা পাবে। পাট, ভুট্টা, আউশধান-সহ বর্ষাকালীন আনাজের জন্য জমি তৈরি ও বীজ বোনার কাজ শেষ করতে হবে। পাটের ক্ষেত্রে বীজ বোনার জন্য জিরোটিলেজ মেশিনের সাহায্য নিতে বলা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের জন্যও কয়েকটি সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই রোগের সংক্রমণ যাতে না হয় সে জন্য কৃষকদের ফসল তোলা, জমি তৈরি-সহ যে কোনও কাজের আগে ও পরে হাত ধোওয়া ও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। মাঠে কর্মরত প্রতিটি মানুষের মধ্যে কম পক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব থাকা দরকার।
মাঠে কর্মরত প্রতিটি মানুষকে জীবাণু প্রতিরোধের জন্য মুখোশ বা গামছা, চাদর বা ওড়না অন্তত তিন ভাঁজ করে মুখ ও নাক ঢাকার কথা বলা হয়েছে। মাঠে যাওয়ার সময়ে সঙ্গে সাবান রাখতে বলা হচ্ছে। এবং খাবার আগে অন্তত ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। মাঝেমধ্যেই সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার পরে জল খেতে হবে। কাজের মধ্যে বিশ্রাম নেওয়া বা খাবার খাওয়ার সময়ে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। হাত না-ধুয়ে মুখ বা নাক স্পর্শ করা যাবে না। এতে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। একান্ত প্রয়োজন হলে কনুই দিয়ে নাক বা মুখ মোছা যেতে পারে। মাঠে কাজ করার সময় যতটা সম্ভব ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। এক দিনে বেশি সংখ্যক লোক কাজে নিযুক্ত না-হওয়াই ভাল।
এই সময়ে যথাসম্ভব পরিচিত মানুষকে মাঠের কাজে নিযুক্ত করতে হবে। এতে সম্ভাব্য করানোভাইরাস বহনকারী কোনও মানুষের থেকে মাঠে নিযুক্ত অন্যদের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কমবে। ভাড়া নেওয়া কৃষি যন্ত্রপাতিতে ধরার বা কাজে লাগানোর আগে সাবান জল দিয়ে ভাল ভাবে পরিষ্কার করতে হবে। মাঠের কাজ শেষ করে বাড়িতে ঢোকার আগে সাবান-জল দিয়ে ভাল ভাবে পরিষ্কার হতে হবে।
মাঠের কাজ সম্পন্ন করে বাড়িতে ঢোকার আগে মাঠের পোশাক খুলে নিতে হবে এবং সাবান দিয়ে স্নান করে ঘরে ঢুকতে হবে। সামান্য গরম জলে নুন মিশিয়ে গার্গেল করার পরে খাবার খাওয়া উচিত। এই সব সাবধানতা বজায় রাখতে পারলে এই অসুখ থেকে অনেকটাই নিরাপদে থাকা যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশা।
লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক
আরও পড়ুন: অবাঞ্ছিত রাজনীতি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy