Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

করোনা-বিদ্রোহ

এক মিটার দূরত্বের তত্ত্ব ভুলে এ ভাবেই চলছে আড্ডা। প্রতীকী চিত্র।

এক মিটার দূরত্বের তত্ত্ব ভুলে এ ভাবেই চলছে আড্ডা। প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২০ ০৩:১৭
Share: Save:

হলিউডের ‘হর্স ফেদার্স’ (১৯৩২) ছবিতে গ্রাউচো মার্ক্স একটি গান গাহিয়াছিলেন, যাহার প্রথম স্তবকের মর্ম হইল, ‘‘উহাদের কী বলার আছে আমি জানি না, জানিলেও তাহাতে কিছু পার্থক্য হইবে না। উহা যাহাই হউক, আমি তাহার বিরুদ্ধে।’’ এই ‘Whatever it is, I'm against it’ শুনিতে বেশ ভাল, আর ইহার স্বাক্ষর যত দিন যাইতেছে ততই স্থূল হস্তাবলেপনে এই বসুন্ধরার গাত্রে চাপিয়া বসিতেছে। যুবসমাজের একটি সহজাত ঔদ্ধত্য থাকে, যৌবনে মনে হয়, থাকিয়া থাকিয়া রাগিয়া উঠা ও কর্তৃপক্ষের সকল আদেশ ও অনুরোধকে অস্বীকারের মধ্যেই জীবনের কাঙ্ক্ষিত তীব্রতা রহিয়াছে। তাহা কিছু মাত্রায় অবশ্যই সঙ্গত, কিন্তু বিপ্লবের অর্থ কেবল রগচটা সমষ্টির দুর্বিনয়ের প্রদর্শনী নহে। তাহার নেপথ্যে সুচিন্তিত দর্শন, সুচারু পরিকল্পনা, সুশীল নীতিবিন্যাস থাকিলে, তবেই তাহা ইতিহাসে স্থান পায়, প্রেরণার উৎস হইয়া উঠে। কিন্তু এই কালে, বিশেষত সমাজমাধ্যম আসিয়া, বদমেজাজের উদ্যাপন, অশিক্ষার আস্ফালনকে কালাপাহাড়ি কাণ্ড বলিয়া বাতলাইয়া আত্মশ্লাঘার তাপ উপভোগ করা এক নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বড় সহজে অহরহ বিপ্লব সংঘটিত হইতেছে, পটেটো চিপস সহযোগে, প্রধানত কটুকাটব্যের কাব্যে। গায়ে রৌদ্রটি লাগিল না, বৃষ্টিটি পড়িল না, সোফায় বসিয়া মহাবিদ্রোহী হইয়া যাইলাম, ইহার মধ্যে প্রকাণ্ড আমোদ রহিয়াছে, যে আনন্দের উৎস দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। দায় না লইবার হালকামি।

‘করোনা-রেবেল’ বা করোনা-বিদ্রোহী বলিয়া দেশে দেশে এক প্রকার গোষ্ঠীর উদ্ভব হইয়াছে, যাহারা করোনাভাইরাস সংক্রান্ত সকল সতর্কতাকে ফুৎকারে উড়াইয়া, ফুর্তি করিতে ব্যস্ত। যে হেতু এমন ধারণা প্রচারিত যে অসুখটি কমবয়স্কদের আক্রমণ করিতেছে না, সে হেতু তাহারা মহানন্দে পার্টি করিতেছে, জমায়েত হইতেছে। তাহার মাধ্যমে কেবল যে তাহারা বিপন্ন হইতেছে তাহাই নহে, অন্যদের বিপন্ন করিতেছে। তাহাতে এই উদ্দাম যুবাদের থোড়াই কেয়ার। জার্মানিতে, তাহারা বৃদ্ধদের উদ্দেশে মুখ না-ঢাকিয়াই কাশিয়া দিতেছে। স্পেনে, জনবিচ্ছিন্ন থাকিবার আদেশ অমান্য করিবার জন্য কেহ ছাগল লইয়া বেড়াইতে যাইতেছে। ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায়, কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বারংবার বারণ সত্ত্বেও সমুদ্রসৈকতে ভিড় করিতেছে ও নাচিতেছে গাহিতেছে। পুলিশ তাহাদের ধরিতে যাইলে তাহারা কখনও লড়াইও করিতেছে। ‘লকডাউন’ না মানিয়া স্বাস্থ্যব্যবস্থার নকশাটির সর্বনাশ ঘটাইতেছে। অবিরাম আহ্লাদসন্ধানী প্রজন্মের মধ্যে এক বিস্রস্ত ও অসমঝদারির নিশান পতপত উড়িতেছে।

যুবাদের যাঁহারা পূজ্য, সেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র-তারকা, গায়ক-গায়িকাদের দিয়া তাহাদের নিষেধ করানো হইতেছে। সেলেব্রিটিরা কখনো বাবা-বাছা করিয়া, কখনও প্রবল গালমন্দ করিয়া বলিতেছেন, অন্যের কথা না ভাবিবার মধ্যে কোনও গৌরব নাই, অমানবিকতা রহিয়াছে। বুঝাইতেছেন, ইহার ফলে ব্যাধিটি যে বয়স্কদের আক্রমণ করিবে (তাঁহারা এই যুবক-যুবতীদের দ্বারাই সংক্রমিত হইবেন) তাঁহাদের প্রতি কী প্রখর অন্যায় তাহারা করিতেছে। কেহ বলিতেছেন, এই অসুখে কমবয়সিরা রেহাই পাইবেন তাহাই বা কে বলিয়াছে, বহু তথ্য দেওয়া হইতেছে ইটালি আমেরিকা ফ্রান্সের রোগীদের বয়স সম্পর্কে। এক কমবয়স্ক রোগী টুইটারে নিজের অসুস্থতার বিবরণ লিখিয়া, সতর্ক করিয়াছেন। আমেরিকার সার্জন জেনারেল, সমাজমাধ্যমে প্রভাবশালী কাইলি জেনারকে বলিয়াছেন, সতর্কীকরণ ছড়াইয়া দিতে। কিন্তু অসহায় হইয়া সকলে শুনিতেছে, যখন মায়ামিতে উৎসবরত তরুণ ভাইরাল ভিডিয়োতে বলিতেছে, ‘‘আমার করোনা হইলে, হইবে। তাহার ভয়ে পার্টি করা থামাইব না। মজা করিয়া সময় কাটাইব।’’ ইহাতে যে পরবর্তী মজা করিবার সময় সে আর না পাইতে পারে, তাহা লইয়া হেলদোল নাই। স্পেনে পুলিশকে দেখিলে আবার ‘উই’ভ অল গট দ্য ফ্লু না না না’ গাহিয়া দুয়ো দেওয়া হইতেছে। যেমন সচেতন প্রতিবেশী স্তম্ভিত হইয়া দেখেন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা পালন করিবার দিনে বিকাল পাঁচটায় ভাসানের শোভাযাত্রার ন্যায় পরস্পরের কাছ ঘেঁষিয়া উল্লসিত জনতা থালা বাজাইতে বাজাইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছে, যেমন শ্রীলঙ্কায় ৩৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হয় করোনা-কারফিউ অস্বীকার করিয়া পথে ঘোরা বা মদ খাইবার জন্য, তেমনই এক আত্মঘাতী অনুভূতিহীনতা উদ্যাপিত হইতেছে পৃথিবী জুড়িয়া। এই উচ্ছল ইতরতরঙ্গের মহামারি রুধিবে কে?

যৎকিঞ্চিৎ

তিন মিনিট কেউ যদি করোনা নিয়ে কথা না বলে থাকতে পারে, প্রাইজ় দেওয়া হবে। আশ্চর্য, লোকে দিনমান ওয়েব-সিরিজ় দেখছে, বই পড়ছে, গান শুনছে, কিন্তু ফোন এলে বা লোকের মুখোমুখি হলেই তক্ষুনি অসুখের আশঙ্কার থমথমে থিম মিউজ়িক। দু’বেলা মরার আগে মরবেন না। দিনে দু’ঘণ্টা উত্তমকুমার, আধ ঘণ্টা দার্জিলিং আর পনেরো মিনিট রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে কথা বলুন। ঐতিহ্যের চর্চা হল, ফুসফুসের ব্যায়ামও। তালে তালে থালা বাজালে সরকারও খুশি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy