Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নেয় যারা

এমন আশ্চর্য ব্যাখ্যা নতুন নয়। প্রাক্-লকডাউন পর্বে অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা দিল্লিতে আয়োজন করেছিল গোমূত্র পার্টির।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২০ ০০:০৪
Share: Save:

ঘোর অন্ধকার নেমে এল দেশে। ৫ এপ্রিল, রাত ন’টায়, ন’মিনিটের জন্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংক্রমণ ঠেকানোর লড়াইয়ে দেশজোড়া সঙ্কল্পের কথা। ‘ভক্ত’রা ব্যাখ্যা দিল: মোম, প্রদীপের সম্মিলিত উত্তাপে যে তাপমাত্রা বাড়বে, তাতেই এই মহা ভাইরাস বধ হবে। তবে কিনা, ওইটুকু উত্তাপ বৃদ্ধিতে ভরসা নেই! তাই বোধ হয় পুড়ল বাজি, জ্বলল মশাল, হল নেড়াপোড়াও।

এমন আশ্চর্য ব্যাখ্যা নতুন নয়। প্রাক্-লকডাউন পর্বে অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা দিল্লিতে আয়োজন করেছিল গোমূত্র পার্টির। দাবি, করোনাভাইরাস ঠেকানোর মোক্ষম দাওয়াই হল গোমূত্র। বিলিতি গরুর নয়, খাঁটি দিশি-র। সঙ্গে অধ্যক্ষ চক্রপাণি মহারাজের সংযোজন, করোনাভাইরাসকে শায়েস্তা করতে যে বিশেষ গুণ লাগে, তা আছে গোমূত্রেই। সুতরাং, চক্রপাণি উবাচ, মারণরোগের অব্যর্থ ওষুধটি ভারতের হাতেই থাকতে চলেছে। বৃথাই তার খোঁজে আকুল হচ্ছেন বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীরা।

তর্ক উঠতে পারে, এ তো সদ্যগজানো কুসংস্কার নয়। সত্যিই এক সময় শুদ্ধিকরণে গোবর ব্যবহার করা হত। পঞ্চগব্যে নাকি গো-চোনা এবং গোবরের মিশেল থাকে। আর মিশে থাকে অখণ্ড বিশ্বাস। এটা অ-বিজ্ঞান, নিঃসন্দেহে। উত্তরে বলা যায় যে দেশের নানা কোণে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্বাসগুলোতে সরাসরি বহু মানুষের ক্ষতির সম্ভাবনা কম। অন্য দিকে, রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে যদি নানাবিধ অপবিজ্ঞানের প্রচার অনবরত চলতে থাকে, তবে সেই বহু-র ক্ষতি কোনও ভাবেই এড়ানো যায় না। এ কেবল অন্ধবিশ্বাস নয়, অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অবিজ্ঞানের রাজনীতি।

শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বেই সঙ্কটকালে অবৈজ্ঞানিক প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু ভারতের বাড়তি সমস্যা— অশিক্ষা ব্যাপক। স্বাভাবিক সময়েই এখানে মানুষ তাবিজ, কবচ, তান্ত্রিক, ওঝার মাহাত্ম্যে আস্থা রাখে। সেই দেশে অতিমারির মুখে দাঁড়িয়ে সংক্রমণ কমানোর মিথ্যে প্রচারের অভিঘাত মারাত্মক হতে পারে। ২২ মার্চ আপৎকালীন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের হাততালি জানিয়ে উৎসাহ দেওয়ার প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে যে দেশের নাগরিকরা করোনাসুর তাড়ানোর উৎসবে পরিণত করতে পারে, গোমূত্রের শিশি বা আগুন জ্বালানোর ছাড়পত্র তাদের হাতে পড়লে পরিণাম অনুমেয়। প্রমাণ ইতিমধ্যেই মিলতে শুরু করেছে।

করোনাভাইরাস থামাতে রাতারাতি নানা তত্ত্ব ঘুরছে লোকের মুখে, সমাজমাধ্যমে। কেউ বলছেন, রোদে দাঁড়িয়ে থাকলেই করোনা সংক্রমণ কমে যায়, কেউ দাওয়াই দিয়েছেন কিছু ক্ষণ অন্তর ঈষদুষ্ণ গরম জল খেলেই নাশ হবে রোগজীবাণু। গোড়ার দিকে এমনও শোনা গিয়েছিল, ভারতীয়দের চা খাওয়ার অভ্যেস নাকি সংক্রমণ ঠেকাতে কাজে আসবে। এও শোনা গিয়েছিল, গঙ্গাজলে কয়লাগুঁড়ো মিশিয়ে মাখলেই ছুঁতে পা৩রবে না করোনা। স্বাভাবিক সময়ে এই অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে নিয়ে শিক্ষিত সমাজ ব্যঙ্গ-রসিকতায় মাততে পারে। কিন্তু শমন যখন শিয়রে দাঁড়িয়ে, তখনও যত্নসহকারে সেই নির্লজ্জ অপপ্রচারকে জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা ক্ষমা করা যায় না। তাই এই ধরনের গুজব থামাতে অনেক আগেই কড়া দাওয়াইয়ের প্রয়োজন ছিল।

টুইট-প্রিয় প্রধানমন্ত্রী গোড়ার দিকে চুপই ছিলেন। পরে অবশ্য দেশজোড়া লকডাউনের ঘোষণার সঙ্গে তিনি অনুরোধ করলেন গুজব এবং অন্ধবিশ্বাস থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। তত ক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে বিস্তর। গোমূত্র খেয়ে হাসপাতালে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। অথচ, গোমূত্রপানে যে নেতারা এত দিন উৎসাহ দিচ্ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কি কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? সে খবর মেলেনি। যদিও বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিষয়টি থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছিল এবং উদ্যোক্তাদের অনেকেই জানিয়েছিলেন যে এই কাজের সঙ্গে দলের কোনও যোগ নেই। কিন্তু অপবিজ্ঞানে আশকারা-দানকারীদের মধ্যে অনেকেই একটি বিশেষ দলের অনুরাগী হলে সেই দায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপরেও বর্তায় বইকি।

গো-চোনা মাহাত্ম্যের রাজনীতি স্পষ্ট। আসলে কৌশলে তুলে ধরা হচ্ছে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্বকেই। বিশ্ব যে রোগের ভয়ে কাঁপছে, তাকে আটকাতে শরণ নিতে হবে হিন্দুত্বের। এই ধর্মই দেখাতে পারে রোগমুক্তির পথ। এই প্রচার ভয়ঙ্কর। এটা নিছক অন্ধবিশ্বাসে প্রশ্রয় দেওয়া নয়। অন্ধবিশ্বাস অন্ধবিশ্বাসই। সমাজের এক শ্রেণি তাতে বিশ্বাস করে, অন্যরা করে না। সমস্ত অন্ধবিশ্বাসই ক্ষতিকর। এর সঙ্গে রাজনীতি মিশলে সেই ক্ষতি আর সীমিত পরিসরে আটকে থাকে না। তার ক্ষতি ব্যাপক।

ভয় এইখানেই। স্বৈরতন্ত্র চির কাল যুক্তিহীনতার কদর করে। অতিমারিকে ঘিরে অপবিজ্ঞানের বাড়বাড়ন্ত বলে দেয়, ভারত সেই দিকেই হাঁটছে।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy