Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
Bankim Chandra Chatterjee Sarat Chandra Chattopadhyay coronavirus

শরৎবাবুর কোয়রান্টিন, বঙ্কিমের মড়ক, বাংলা সাহিত্যে মহামারি

‘মহামারি’-র সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অবশ্যই নতুন কিছু নয়। তবে বাঙালির গেরস্থালিতে তার নাম ‘মহামারি’ ছিল না।  বাঙালির আবহমান তাকে চিনত ‘মড়ক’ হিসেবে।

১৮৯৪-র কলকাতায় চলছে কলেরার টিকাকরণ। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স।

১৮৯৪-র কলকাতায় চলছে কলেরার টিকাকরণ। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৪৭
Share: Save:

“পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুন পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine: তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।”

উপরের উদ্ধৃতিটির সঙ্গে বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীর নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেই। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব। লেখক সেই আদি ও অকৃত্রিম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই মুহূর্তে এই অনুচ্ছেদটি যে দারুণ ভাবে প্রাসঙ্গিক, তা-ও বলার অপেক্ষা রাখে না। কোয়রান্টিনের সঙ্গে সেটাই বোধ হয় বাঙালি পাঠকের প্রথম পরিচয়। এই বর্ণনা শ্রীকান্তর বর্মা পৌঁছনোর মুহূর্তের। সেখানে প্লেগ দেখা দিয়েছে। বর্মাও তখন ইংরেজ কলোনি। ‘আধুনিক’ রাষ্ট্র ব্যবস্থার লক্ষণগুলো সেখানে ‘ক্রমে আসিতেছে’। এই লক্ষণগুলোরই অন্যতম হল জনস্বাস্থ্য। মহামারি দেখা দিলে জনস্বাস্থ্য বিধি মেনেই সদ্য বহিরাগতদের কোয়রান্টিন করে রাখার ব্যবস্থা সেখানকার ঔপনিবেশিক সরকার করেছিল। পরে শরৎবাবু কোয়রান্টিনের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। এবং এটা বলেছিলেন যে, কোয়রান্টিনের যন্ত্রণা পোহাতে হয় মূলত ‘ছোটলোকদের’। ‘আধুনিক’ রাষ্ট্র যে ‘জন’-কে তার টার্গেট করে, তারা তথাকথিত ভদ্রেতর। তা সে ইংরেজ জমানাই হোক, আর সাম্প্রতিক কালের জীবন্ত মানুষের উপরে কীটনাশক স্প্রে করা যোগীরাজ্যই হোক, খেলা একই।

‘মহামারি’র সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অবশ্যই নতুন কিছু নয়। তবে বাঙালির গেরস্থালিতে তার নাম ‘মহামারি’ ছিল না। বাঙালির আবহমান তাকে চিনত ‘মড়ক’ হিসেবে। মহামারি এ দেশের ইতিহাসে নতুন কিছুই নয়। আবহমানে বার বার এ দেশে আর পাঁচটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো মড়কও এসেছে। কিন্তু তার হিসেব প্রাগাধুনিক বাংলা তথা ভারত রাখত না। আসলে রাখার দরকারও ছিল না সে কালের রাষ্ট্রের। মুঘল শাসন ‘প্রজাহিতৈষী’ হতে পারে, কিন্তু আধুনিক অর্থে ‘কল্যাণকর’ ছিল না। সেখানে জনগণনার প্রয়োজন ছিল না। ‘জনস্বাস্থ্য’ ব্যাপারটাই ছিল ধারণার বাইরে। মড়ক তাই মড়কের মতো এসেছে, তার পরে প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে গিয়েছে। অজন্মা, শস্যহানি, বর্গীর হেঙ্গামের মতো মড়কও একটা ‘হেঙ্গাম’ হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছে।

চৈত্রশেষের ঘূর্ণি বাতাসে পাক খায় ১১৭৬ বঙ্গাব্দের এক গ্রাম। নাম ‘পদচিহ্ন’। এক দীর্ঘ মন্বন্তরের পরে গ্রামখানি জনশূন্য। শুধু পদচিহ্ন নয়, বাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জনশূন্য। অন্নের অভাবে মানুষ এক সময়ে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেছিল। পরে ভিক্ষারও অভাব দেখা দেওয়ায় মানুষ যা খুশি খেতে আরম্ভ করল। তার পরে আরম্ভ হল মড়ক। “রোগ সময় পাইল। জ্বর, ওলাউঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া পলায়।” আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আদিপুরুষ এই ভাবেই বর্ণনা করেছিলেন ছিয়াত্তরের মন্বন্তর-কালীন মহামারির।

না, একেও ‘মহামারি’ বলা যাবে না, ‘মড়ক’ বলাই শ্রেয়। কারণ, ‘মহামারি’ টার্মটির সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রের যোগ। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে (অর্থাত্ ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে) বাংলার পরিমণ্ডলকে আর যাই হোক ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ বলা যায় না। ‘মহামারি’ অভিধাটির সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের যোগ নিবিড়, যা একান্ত ভাবেই আধুনিক রাষ্ট্রের উপজাত সে কথা আগেও বলেছি। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ তাই এক ‘মড়ক’-এর কথাই বলে, ‘মহামারি’-র নয়। ‘মহামারি’ বলতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যায় কোনও রোগের সংক্রমণকে বোঝায়। এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। ‘নির্দিষ্ট জনসংখ্যা’। যেটা জনগণনা ছাড়া সম্ভব নয়। আর জনগণনা একান্ত ভাবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থারই দস্তুর। সে হিসেবে দেখলে, ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তৃত হওয়ার আগে ‘মড়ক’ ছিল, কিন্তু ‘মহামারি’ ছিল না। ‘আনন্দমঠ’ লিখনের কালে আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু এই উপন্যাসের পটভূমিকা যে সময়ের কথা বলে, সেই সময়ে তা ছিল না। ফলে বঙ্কিম যা লিখেছিলেন, তা মড়কের বর্ণনা। যেখানে রাষ্ট্রিক অনুপ্রবেশ নেই, ‘সামাজিক কাজ’ হিসেবে ‘ত্রাণ’ বা ‘সেবা’-র বন্দোবস্ত নেই। মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে মরে পড়ে থাকলেও তার কোনও গতি হয় না। কিন্তু, এখানে মনে রাখা দরকার— ১১৭৬-এর এই মড়কটি একটি মন্বন্তরের অনুষঙ্গে সৃষ্ট। মন্বন্তর যে মানবিকতার চরম বিলয় ঘটায়, তা ‘আনন্দমঠ’-এই দৃশ্যমান। সেই বিলয়ের পরে মড়কে কে কার সেবা করবে? এই প্রশ্ন বঙ্কিম রেখেছিলেন।

কিন্তু, সম্প্রদায়গত ভাবে মড়ক প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত প্রাক-ঔপনিবেশিক বাংলায় ছিল না, এমন নয়। শীতলা বা ওলাইচণ্ডী বা ওলাবিবির উপাসনা সেই সম্প্রদায়গত মড়ক-প্রতিরোধ কামনারই কথা বলে। বাংলা সাহিত্যের সেই কালে এই সব লৌকিক দেবীর কাল্টের উদ্ভবের সুবাদে তৈরি হয় দেবী-মহিমা কীর্তনকারী কাহিনি, পাঁচালি, ব্রতোপাখ্যান। সেই সব সাহিত্যও ‘আধুনিক’ নয়। তা হলে কি ধরে নেব যে বাংলা আধুনিক সাহিত্যের প্রথম পুরুষের হাতেই রচিত হয় মড়কের প্রথম বর্ণনা?

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কালেই নাকি সাধক কবি রামপ্রসাদ তাঁর বিখ্যাত ‘অন্ন দে গো মা অন্নদা’ রচনা করেছিলেন। হতে পারে। কিন্তু এই গানে বর্ণিত ‘অন্ন’ আক্ষরিক অর্থে ‘ভাত’ নয়, তার অন্য আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে। তবু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বাস্তবের অন্নাভাব থেকেই কবির কলমে রূপক হিসবে উঠে এসেছিল ‘অন্ন’।

কলকাতা শহরের প্রাথমিক পর্বে মড়ক ছিল এক অতি কমন ব্যাপার। সদ্য এ দেশে পা দিয়ে এখানকার জলবায়ু সহ্য করতে না পেরে যে দলে দলে সাহেব মারা গিয়েছেন, তা এই শহরের পুরনো গোরস্থান ভিজিট করলেই মালুম হয়। এ ছাড়াও প্রচুর ডায়েরি, জার্নাল, স্মৃতিকথায় ঔপনিবেশিকতার সূত্রে আগত শ্বেতাঙ্গরা সেই সব মারির ভয়াবহতা লিখে রেখেছেন। তবে এ নিয়ে দিশি মানুষের কোনও অ্যাকাউন্ট নেই। আর থাকবেই বা কেন? মড়ককে খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখতেন শীতলা বা ওলাবিবি উপাসনাকারী বঙ্গজন। সাহেবরা যে সব রোগে মারা পড়ত, বাঙালির সেগুলো হলেও মারা যাওয়ার মতো কিছু ঘটত বলে মনে হয় না। কারণ, এখানকার জলবায়ুতে এখানকার বাসিন্দাদের ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

মহামারির প্রথম ধাক্কা যদি বলতে হয়, সেটা ছিল ইংরেজি ১৮৯৮ সালের প্লেগ। এই প্লেগ মহামারির কালেই স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর সহ-সন্ন্যাসীরা সেবা করেছিলেন। ভগিনী নিবেদিতা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। প্লেগ বোম্বাই প্রদেশে প্রথম দেখা দিলেও তা অচিরেই কলকাতা পৌঁছয়। এবং মহামারির আকার নেয়। এই মহামারির বর্ণনা বিশদ লিপিবদ্ধ করেছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তাঁর ‘মহাস্থবির জাতক’-এ। লেখক এই সময়ে বালক মাত্র। কিন্তু স্মৃতি থেকে তিনি যে বর্ণনা লিখেছিলেন, তা ভয়াবহ। ‘মহাস্থবির’-এর ভাষ্য অনুযায়ী কর্পোরেশন থেকে প্লেগের টিকা দিতে চাইলে সহজে লোকে তা নিতে চায়নি। গুজব ছড়ায়, এই টিকা নিলে অচিরেই মৃত্যু ঘটবে। এর ফলে যা ঘটার তা-ই ঘটে, অচিরেই রোগ ছড়ায়। শহরের মানুষদের মধ্যে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরাই প্রথম টিকা নিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু ‘চতুরঙ্গ’-এ প্লেগে তো জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর কথাও লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। শহর কলকাতার বোধহয় সেই প্রথম মহামারির ঝাঁকিদর্শন। ‘নাস্তিক’ জ্যাঠামশাই বাড়িতেই প্রাইভেট হাসপাতাল খুলে গরিব মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও আক্রান্ত হলেন এই রোগে। প্রসঙ্গত, এই প্লেগেই মারা যান শরৎচন্দ্রের স্ত্রী ও শিশুপুত্র। এই মহামারি প্রবেশ করে ঠাকুরবাড়িতেও। অবনীন্দ্রনাথের শিশুকন্যা মারা যায় প্লেগে। শান্তিনিকেতনে ফ্লু বা অন্য মহামারি প্রবেশ করেনি, এর কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন তা 'পঞ্চতিক্ত পাচন'-এর গুণ। নিম, গুলঞ্চ, বাসক, পলতা, কন্টিকারি দিয়ে এই পাচন তৈরি হত। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসের গোড়ায় কবি তাঁর একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘‘বৌমার খুব কঠিন রকম নুমোনিয়া হয়েছিল। অনেক দিন লড়াই ক’রে কাল থেকে ভাল বোধ হচ্চে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বোধ হয় অনেক দিন লাগবে। হেমলতা এবং সুকেশী এখনো ভুগচেন। তার মধ্যে হেমলতা প্রায় সেরে উঠেচেন— কিন্তু সুকেশীর জন্যে ভাবনার কারণ আছে। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাচন খাইয়ে আসচি।" ('চিঠিপত্র', ষষ্ঠ খণ্ড)

দেখার বিষয় এটাই যে, মড়ক যতটা দরিদ্র ও তথাকথিত নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে ছড়াতে দেখা গিয়েছে, উচ্চবর্গীয় সমাজে ততটা নয়। এর থেকেই কি পাবলিক হাইজিনের ধারণার জন্ম? দারিদ্র আর অপরিচ্ছন্নতা হাত ধরাধরি করে চলে, আধুনিক রাষ্ট্রের এই বয়ান ঔপনিবেশিক ভারতেও লাগু হয়েছিল। বাংলা সাহিত্য ছানভিন করতে বসলে দেখা যায়, নিম্নবর্গের সমাজে মহামারির প্রকোপ সাংঘাতিক। এর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’-এ। শুয়োরমারি বস্তিতে কলেরা মহামারির যে মর্মান্তিক বিবরণ বিভূতিভূষণ রেখেছেন, তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের দারিদ্র। সেই ভয়ঙ্কর দারিদ্রের সঙ্গে কলেরা মহামারির ভয়াবহতা মিশে যা তৈরি করেছে, তা বাংলা সাহিত্যেই নজিরবিহীন। কয়েক মুঠো ভাতের প্রতি এক কিশোরী বধূর যে আর্তিকে বিভূতিভূষণ তুলে এনেছিলেন, তা ‘আরণ্যক’-এর পাঠক মাত্রেই জানেন। মৃত্যু সেখানে নৈমিত্তিক। চিকিৎসকহীন, শুশ্রুষাহীন মানব সমাজের চিরঅন্ধকারকে বিভূতিভূষণ লিখতে পেরেছিলেন। এ এক অসাধ্য সাধন।

১৯১৮-য় ভারতে দেখা দেয় ভয়াবহ ফ্লু মহামারি। দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তাতে উজাড় হয়ে যায়। শিমলা থেকে বিহার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যু-মিছিল। হিন্দি কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী, যিনি ‘নিরালা’ ছদ্মনামেই সমাধিক পরিচিত, লিখে গিয়েছেন এই মহামারির মর্মস্পর্শী বিবরণ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে উঁকি দেয়নি ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে পরিচিত এই অতিমারি। কারণ? সম্ভবত বাংলায় এর তেমন প্রাদুর্ভাব ছিল না বলেই কি এই অনুপস্থিতি? বাংলা সাহিত্য কি নিজের ঘর পোড়েনি বলে বিপর্যয়কে লিখতে চায়নি সে দিন? কে জানে! আজ এত দিন পর প্রশ্নগুলো জাগেই।

বাংলা সাহিত্যের আর এক বন্দ্যোপাধ্যায় তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাসের নায়ক শিবনাথকে দেখা যায় কলেরা মহামারির কালে সেবাব্রত গ্রহণ করতে। তারাশঙ্করের অন্যান্য রচনাতেও মহামারি, বিশেষ করে ম্যালেরিয়া-ক্লিষ্ট পল্লিসমাজের কথা এসেছে। এসেছে সংবেদী নায়কের সেবাব্রত গ্রহণের কাহিনি। কিন্ত লক্ষণীয় এই যে, সব লেখাতেই মহামারি একটা ‘প্রেক্ষিত’। তার ভয়াবহতা লেখায় উপস্থিত, কিন্তু সে নিজে লেখার মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় এখানে চরিত্রগুলির ব্রত গ্রহণ। মনে রাখতে হবে, সেই কাল গাঁধী-ব্রতের কাল। আর্তের সেবা যেখানে ‘দেশের কাজ’। ফলে মহামারির উপক্রম লেখায় ঘটে ‘দেশের কাজ’-কে জাস্টিফাই করতে। মহামারি নিজে ‘বিষয়’ হয়ে উঠে আসে না। বিভূতিভূষণের রচনায় মন্বন্তর যে ‘অশনি সংকেত’ দেখায়, মহামারি ততটা দেখায় না। শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’-তে সুরেশ মহামারিতেই সংক্রমিত হয়ে মারা যায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার বেশি কিছু লভ্য নয়।

পরে যখন ভারতের অন্যত্র মহামারি দেখা দিয়েছে, বাংলা সাহিত্য কি তাকে জায়গা দিয়েছে তার আঙিনায়? এমনকি, ২০০৯-এর ফ্লু মহামারি পূর্ব-ভারতের ঘটনা হলেও তার ছায়া পড়েনি বাংলা সাহিত্যে। এর কারণ কী? মধ্যবিত্ত অধ্যূষিত বাংলা সাহিত্যে নিজের ঘর না পোড়া পর্যন্ত কি অপেক্ষা করতে হয় ‘বিষয়’-কে? তারাশঙ্করের লেখায় মহামারি ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালি স্বদেশিভাবাপন্নতা প্রকাশের একটা সুযোগ। বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এর সত্যচরণ মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ থেকে দূরে অবস্থানরত এক সত্তা। তার কাছে সেবাব্রত গ্রহণের কোনও মানে হয় না। সে শুয়োরমারী বস্তিতে ছুটে গিয়েছিল এমন এক টানে, যে টানটাই ‘আরণ্যক’-এর প্রাণশক্তি। বিভূতিভূষণের অন্য কোনও রচনায় এটা দেখা যায় না। ‘আরণ্যক’ তাই ব্যতিক্রম। জ্বলন্ত ব্যতিক্রম।

নাকি বাংলা সাহিত্যে মহামারি-বর্ণনার এই অপ্রতুলতার কারণ অন্যত্র নিহিত? বিভূতিভূষণের রচনার দিকেই আর এক বার ফিরে তাকানো যাক। কী পরিমাণ অকালমৃত্যু ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে, ভাবলে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁর একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, এই মৃত্যুমিছিলের অন্যতম কারণ অনাহার, অপুষ্টি। ফলে যে কোনও মুহূর্তে ম্যালেরিয়া বা ফ্লু এই ভূমিতে মড়কের আকার নিতে পারে। তাকে আলাদা করে ‘মহামারি’ চিহ্নিত করার কাজটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র করেনি। ফলে আলাদা মহিমা নিয়ে তার আর সাহিত্যের ‘বিষয়’ হয়ে ওঠাও হয়নি। তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণের সাহিত্যে অকালপ্রয়াণের সেই দীর্ঘ মিছিল এক নিরবচ্ছিন্ন মহামারির কথাই বলে। অঘোষিত, অ-স্বীকৃত মহামারি।

ম্যালেরিয়া বা কলেরায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার এক অন্য উদাহরণ রয়েছে। একে ঠিক ‘সাহিত্য’ বলে মানতে না চাইলে কিছু করার নেই। বরং একে ‘ওরাল লোর’ বলে মেনে নেওয়াই ভাল। বহু দিন পরে জামাই শ্বশুরবাড়ি পৌঁছেছে বেশ রাত করে। শুনশান গ্রামে নিশুতি শ্বশুরবাড়িতে জামাইকে খেতে দিয়েছেন শ্বাশুড়ি। জামাই একটু লেবু চাইতে শ্বাশুড়ি ঠাকরুন ঘর থেকেই হাত বাড়িয়ে দূরের বাগানের লেবুগাছ থেকে লেবু পেড়ে আনলেন। জামাই ভয়ে অজ্ঞান। পর দিন জ্ঞান ফিরতে দেখতে পেল এক খণ্ডহরের মধ্যে সে পড়ে রয়েছে। কোনও রকমে পালিয়ে এক জনপদে পৌঁছে সে জানতে পারল, তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামটি কলেরা বা ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে গিয়েছে। আর সেখানে আজ ‘তেনাদের’ রাজত্ব। শিশুতোষ এই ভূতের গল্প কিন্তু খুবই কমন বাংলায়। এই ‘উজাড় হয়ে যাওয়া গাঁ’-কে বাঙালির গণস্মৃতি ধরে রেখেছে। মহামারির ভয়াবহতা কথনের জন্য কেউ বেঁচে নেই আর। যা আছে, তা ‘হরর’। ‘পোস্ট এপিডেমিক হরর’। তার থেকেই জন্মায় এই ‘ভৌতিকতা’।

জানা নেই করোনাভাইরাসের দাপট কমলে বাংলার সাহিত্যিকরা একে উপজীব্য করে উপন্যাস বা গল্প লিখবেন কি না। কবিতা তো এখনই লেখা শুরু হয়ে গিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মালুম। কিন্তু একখানি ‘প্লেগ’ বা ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার অফ সলিটিউড’ কি রচিত হবে? মারি কেটে যাক। মানুষ স্থিত হোক। সাহিত্য তার পরে। কিন্তু মহামারির স্মৃতিকে তো হারিয়ে যেতে দিলে চলবে না। তাকে আবার দরকার পড়বে আবার কোনও এপিডেমিকের সময়ে। মিলিয়ে নিতে হবে অভিজ্ঞতা। কাল বদলাবে। কিন্তু ‘কালান্তর’-কে মনে করিয়ে দেবে সাহিত্য। দেখা যাক, ভবিষ্যৎ কী বলে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy