অ-প্রস্তুত: কংগ্রেস কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সনিয়া গাঁধী ও রাহুল গাঁধী, দিল্লি, ৬ অগস্ট। পিটিআই
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, এবং কংগ্রেসের নেতানির্ধারণ নিয়ে গোলযোগ— এ মাসে পর পর ঘটে গেল। এক দিক দিয়ে দেখলে এই দুই ঘটনা একত্র আলোচনা করার অর্থই হয় না। আবার অন্য দিক দিয়ে দেখলে কিন্তু দু’টি ঘটনার পারম্পর্যের মধ্যে দেখতে পাওয়া সম্ভব এক গভীর ও সুদূরপ্রসারী দুর্ভাগ্যযোগ। বিজেপি সরকার যখন এমন বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যাকে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের রাজনীতিতে ‘গেম চেঞ্জার’ বলা চলে, তেমন এক সময়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল ঠিক বুঝেই উঠতে পারল না, যে তার ‘প্রধান’ কে, এবং এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তার প্রধান কাজটা কী। দুর্ভাগ্য ছাড়া একে আর কী বলা যায়!
সংসদে কাশ্মীর নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যুগান্তকারী ঘোষণার সময়েও রাহুল গাঁধীই ছিলেন কংগ্রেসের মুখ ও মুখপাত্র। অথচ লক্ষণীয়, প্রায় ২৪ ঘণ্টা তাঁর কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। পরের দিন প্রতিক্রিয়া মিলল যখন, তত ক্ষণে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই পদক্ষেপের নানা সমালোচনা। সুতরাং রাহুল গাঁধীর টুইট-বার্তা যে, জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা না থাকার সুযোগ নিয়ে এই পদক্ষেপ করে কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত অন্যায় করেছে, সেটা আর তত নতুন কিছু বলে মনে হল না। যেখানে গর্জে ওঠার কথা ছিল, সেখানে যা শোনা গেল, তাকে নেহাত টুইটের কুঁইকুঁই বলা চলে। প্রধান বিরোধী দলই সমাজকে বিরোধিতার পথ দেখাবে, এমনটাই সাধারণত হওয়ার কথা। আমাদের দেশের কপাল খারাপ, প্রায় তার উল্টোটা হল।
কংগ্রেসের প্রবীণ ও শীর্ষ নেতারা অনেকে বুঝলেন, দলগত ভাবে ঠিক যেমন চলা উচিত ছিল তাঁদের, তেমনটা যেন ঘটল না। সনিয়া গাঁধীর ওয়াকআউট কিংবা রাহুল গাঁধীর টুইট, কোনওটাতে কোনও সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের ছবি তৈরি হল না। লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী তো কাশ্মীর সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে গোল পাকালেন! এমনকি দলের অন্দর থেকেই দ্রুত ভেসে এল বিজেপির সমর্থন। জনার্দন দ্বিবেদীর মতো বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা প্রকাশ্যে জানালেন যে মোদী সরকারের এই পদক্ষেপ স্বাগত, এর ফলে দেশে একটা আনন্দময় ভাব (ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফিল-গুড ফ্যাক্টর’) ছড়িয়ে পড়বে! বললেন, দেশের ইতিহাসে ৩৭০ ধারা ছিল এক বিরাট ‘ভুল’, এত দিনে তা সংশোধিত হল। রামমনোহর লোহিয়ার কাছে তিনি রাজনীতির পাঠ পেয়েছেন, যে লোহিয়া এই ধারার প্রবল বিপক্ষে ছিলেন। কিছু দিন আগে অবধি কিন্তু জানা ছিল, দ্বিবেদী মশাই সনিয়া গাঁধীর কাছের লোকদের এক জন! দলের মধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠ দীপেন্দ্র হুডার মন্তব্যও ভেসে এল: দেশের ঐক্যের জন্যই এই ধারা তুলে নেওয়া জরুরি ছিল। রায়বরেলীর কংগ্রেস নেত্রী অদিতি সিংহ টুইট করলেন, ‘‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড! জয় হিন্দ্ #৩৭০ ধারা।’’
মুম্বই কংগ্রেসের প্রধান মিলিন্দ দেওরা সদ্য-সমাপ্ত নির্বাচনের সময়েও দলের কাছে এক জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তাঁকে ‘মার্জিন’-এর মানুষ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অথচ তিনিই কংগ্রেস হাইকমান্ডের নেওয়া অবস্থানের সবচেয়ে কঠোর সমালোচনা করলেন। বললেন, ৩৭০-কে ‘লিবারাল বনাম রক্ষণশীলদের বিতর্কে’ পরিণত করে দেশের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। এই মুহূর্তে সব দলের উচিত, অনৈক্য ও বিরোধিতা সরিয়ে রেখে জাতীয় ঐক্যের খাতিরে এককাট্টা হওয়া। ‘‘ভারতের সার্বভৌমতা, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, জম্মু ও কাশ্মীরের শান্তি, কাশ্মীর তরুণদের কাজের সুযোগ, এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিকার’’— এই সবের জন্যই দরকার ছিল ৩৭০ ধারা বাতিল করা। এই গুরুত্ব মাথায় রেখেই ‘মোদী সরকার ২.০’-এর ‘ডিমনিটাইজ়েশন মোমেন্ট’ বা নোট বাতিলের মুহূর্ত বলেছেন মিলিন্দ।
গত দুই সপ্তাহে চেষ্টা করেও এই ছন্নছাড়া দলের একটা সংহত চেহারা ফুটিয়ে তুলতে পারেননি কংগ্রেসের সদ্য-প্রাক্তন ও সদ্য-ঘোষিত দুই সভাপতি, গাঁধী পরিবারের দুই সদস্য। তাঁদের দলের এই যে ছন্নছাড়া পরিস্থিতি, নির্বাচনের পর থেকেই তা দেখে দেখে দেশের জনসমাজের মনেও নিশ্চয় একটা হাঁপ-ছাড়ার ভাব খেলছে, ‘ভাগ্যিস এঁদের জেতাইনি।’ নিজেদের মধ্যে কে নেতা হবেন, সেটা ঠিক করতেও যাঁদের এত দীর্ঘ সময় লাগে, কিছুতেই তা নিয়ে সর্বসম্মত বা সর্বমান্য সিদ্ধান্তে যাঁরা পৌঁছতে পারেন না, তাঁদের হাতে দেশ চালানোর দায়িত্ব দিলে কী কাণ্ডটাই না হত। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও যে বিরোধী দলের মধ্যে কোনও সংহত অবস্থান নেই, সমর্থন করা উচিত না বিরোধিতা করা উচিত তারই কোনও দিশা নেই, তাঁদের হাতে দেশের ভার অর্পিত হলে নিশ্চয় আমাদের কপাল পুড়ত। রাহুল গাঁধী বা তাঁর বাহাত্তর বছর বয়সি অসুস্থ মা এত বড় একটা ঘটনার পরও আন্দোলনের সূচনাবিন্দু তৈরি করতে পারলেন না, নিজেদের দলের বিরুদ্ধতাকে অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে মিলিয়ে বড় প্রতিরোধ তৈরি করলেন না— এই সব দেখে তাঁরা বিরোধী হিসেবেও কতখানি যোগ্য, সে প্রশ্নও উঠছে অনেকের মনে।
অর্থাৎ এক দিকে বিজেপি নেতৃত্বের অসীম আত্মপ্রত্যয়, যাকে স্পর্ধা ও গণতন্ত্র-বিরোধী কর্তৃত্ববাদও বলা চলে, আর অন্য দিকে প্রধান বিরোধী দলের তোতলানো অবস্থান, প্রায় পা-হড়কাতে বসা বিরোধিতা। কেবল রাষ্ট্রীয় অনাচারেই কি ভারতীয় গণতন্ত্রের সর্বনাশ ঘটছে? না কি তা ঘটছে অক্ষম ও দুর্বল বিরোধিতার জন্যও?
এই সব ভবিষ্যৎ-বিষয়ক দুশ্চিন্তার বাইরেও থেকে যায় একটা অতীত-বিষয়ক কথা। আজকের এই যে কংগ্রেসের দ্বিধাবিভক্ত সঙ্গিন পরিস্থিতি, এর পিছনে কি কোনও পুরনো পাপ নেই? কাশ্মীর নিয়ে কংগ্রেসের অনেক দিনের নীতিদৈন্যই কি আজ দলের এমন দ্বিধাবিভাজনের কারণ নয়? আমরা অনেকেই জানি, বিজেপি ইস্তাহারের মূল যে বক্তব্যগুলি, কংগ্রেসের মধ্যে তার প্রতিটি নিয়েই বিস্তর টানাপড়েন আছে। এবং ‘কাশ্মীর’ সেই সব টানাপড়েনের প্রধান বললে খুব ভুল হবে না। আমরা জানি, কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গীভূত করার পথটা খুব নৈতিক ছিল না। যে নেতৃত্ব তা করেছিল, তার দায় কংগ্রেসকেই নিতে হবে। কাশ্মীরে যে ভাবে ৩৭০ ধারা অর্থাৎ বিশেষ অধিকার ক্রমে দুর্বল করে ফেলে তার স্বাতন্ত্র্য ঘুচিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল— তাও কংগ্রেসেরই কৃতকর্ম। আফস্পা দিয়ে কয়েক দশকব্যাপী কাশ্মীরিদের যে অসহনীয় দমনপীড়নের মধ্যে রাখা হয়েছে— তার জন্যও কংগ্রেস ছাড়া অন্য দলকে দায়ী করা যাচ্ছে না। এবং সবশেষে বলতেই হবে, ২০১৩ সালে যে ভাবে কোনও ভূমিকা বা প্রস্তুতি ছাড়াই আফজ়ল গুরু নামে সেই কাশ্মীরি বিদ্রোহী তরুণটির রাতারাতি ফাঁসি হয়েছিল, সেও কিন্তু কংগ্রেসের জমানাতেই। আইনকানুন অগ্রাহ্য করে আফজ়ল গুরুর পরিবারকেও জানানো হয়নি যে তার জীবন শেষ করে দিতে চলেছে ভারতীয় রাষ্ট্র। সাধারণত কাশ্মীরের সাম্প্রতিক কালের বিক্ষোভকে ২০১৬ সালে বুরহান ওয়ানির নিধনের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়। কিন্তু তারও আগে আফজ়ল গুরুর ফাঁসির পর পরই যে কাশ্মীর উপত্যকা আবার নতুন করে ফুঁসে উঠতে শুরু করে, লিখে গিয়েছেন নিহত কাশ্মীরি সাংবাদিক শুজাত বুখারি। এই ফাঁসিরই তীব্র সমালোচনা করে দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত হয় সেই সভা, যার ফলে কানহাইয়া কুমারদের দেশদ্রোহিতার ধারায় গ্রেফতার করা হয় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
না, কাশ্মীর নিয়ে কংগ্রেসের রেকর্ড মোটেই এমন নয় যাতে আজ বিজেপির এই বিস্ফোরক পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে কোমর বেঁধে বিরোধিতায় নামা যায়। কিন্তু নেতৃত্বের কাজটাই তো যা কঠিন তাকে সহজ করা। গোলমেলে ইতিহাসের জমিতে পা দিয়েও বর্তমান রাজনীতির দৃঢ় পথ তৈরি করা। ঠিক যেমন করছেন নরেন্দ্র মোদী কিংবা অমিত শাহরা। প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাবে কাজটা সারলেন, তার পিছনেও কি দলীয় ভিন্নমতের নড়বড়ে জমি ছিল না? পূর্বতন বিজেপি শাসনে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী বহু আইনবিদ ও সংবিধানবিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, ৩৭০ ধারা বাতিল করা যাবে না। কিংবা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন যে তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে সব পক্ষ (‘স্টেকহোল্ডার’) একসঙ্গে আলোচনা করেই স্থির করা হবে ৩৭০ ধারার ভবিষ্যৎ কী। কিন্তু আজ যে ভাবে কড়া হাতে পরিস্থিতির টুঁটি টিপে ধরেছেন এই দুই নেতা, তাতে এ সব প্রশ্ন জনমানস থেকেই হাওয়া হয়ে যাওয়ার জোগাড়।
নেতৃত্ব যখনই স্বাভাবিক ও যোগ্য হয় না, রাজনৈতিক দলের রাজনীতিটা গুলিয়ে যায়। কংগ্রেসকে আজ নেতা ও নীতি, দুইয়েরই খোঁজ লাগাতে হবে নতুন করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy