Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
জনমহল্লাই নতুন পরিসর
CAA

রাজনৈতিক, সামাজিক ও গণ অধিকার মিলিয়েই নাগরিকত্ব

বেড়াজাল— দেশে দেশে রাজনৈতিক সীমান্ত— উপমহাদেশের যে অভিশাপকে রসদ করে নাগরিকত্বের নয়া রাজনীতি আমদানি করা হয়েছে, তার প্রতিবাদ আর প্রতিরোধেই এল পাকিস্তানের প্রতিবাদী কবি ফৈয়জ় আহমেদ ফৈয়জ়-এর প্রতিবাদী কবিতা।

স্পর্ধা: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দিল্লিতে তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভ। ২০ জানুয়ারি, ২০২০। পিটিআই

স্পর্ধা: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দিল্লিতে তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভ। ২০ জানুয়ারি, ২০২০। পিটিআই

অভিজিৎ কুণ্ডু
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০০
Share: Save:

২০২০ সালে পা রাখল ভারত, স্বতঃস্ফূর্ত গলায় মুক্তির গান গেয়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন জনমঞ্চে। ‘জনগণমন’ থেকে ‘হাম দেখেঙ্গে’, অথবা সংবিধানের শপথবাক্যগুলো এক সুরে উচ্চারণ করে। দেশের একশোরও বেশি শহরে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বছরের রেজ়োলিউশন নেওয়া হল খোলা আকাশের তলায়— ডিফেন্ড কনস্টিটিউশন। রাজধানীর হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় শুধুমাত্র সংখ্যালঘু অধ্যুষিত শাহিনবাগ চত্বরেই নয়, ইন্ডিয়া গেটে, ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মুখরিত হয়েছে কবিতা, গান।

বেড়াজাল— দেশে দেশে রাজনৈতিক সীমান্ত— উপমহাদেশের যে অভিশাপকে রসদ করে নাগরিকত্বের নয়া রাজনীতি আমদানি করা হয়েছে, তার প্রতিবাদ আর প্রতিরোধেই এল পাকিস্তানের প্রতিবাদী কবি ফৈয়জ় আহমেদ ফৈয়জ়-এর প্রতিবাদী কবিতা। ফৈয়জ়ের ‘বোল কি লব আজাদ হ্যায় তেরে’— স্বাধীন তোমার মুখের ভাষা। ও পারের এক কালের স্বৈরতান্ত্রিক মিলিটারি রাজের বিরুদ্ধে লেখা কবিতা গান হয়ে ছুঁয়ে ফেলেছে এ পারের নয়া প্রজন্মের স্বাধীন রোম্যান্টিকতা। ‘হাম দেখেঙ্গে...’, যে দিনটার আশায় আমরা বেঁচে আছি, যে দিনটা প্রতিশ্রুত, সেই দিনটা দেখে যেতে চাই।

সিনেমা শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীতে বাধ্যতামূলক দাঁড়িয়ে ওঠা নয়, এত মানুষ এক সঙ্গে মনের আনন্দে তেরঙা নিয়ে এ ভাবে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেনি সাম্প্রতিক সময়ে। মহল্লায় মহল্লায় কোনও বিরুদ্ধতার সমাবেশ নয়; অনেক বেশি আত্মরক্ষা, সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে ২০২০-তে পা রাখল এই দেশ। মরচে পড়ে যাওয়া সংবিধান বা অবহেলার জাতীয় পতাকা যেন এই ভাবেই নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। হয়তো এই সঙ্কটের সত্যিই দরকার ছিল।

একুশ শতকের তিন নম্বর দশকে পা রাখার মুহূর্তে অস্ফুট প্রতিধ্বনি উঠে আসছে একশো বছর আগের, ১৯২০-র দশকের, পাতা থেকে। উত্তাল সময়ের সঙ্গে একটা প্রচ্ছন্ন যোগসূত্র ভেসে উঠছে। চন্দ্রশেখর আজ়াদের অগ্রণী ভূমিকায়, যৌথ নেতৃত্বে ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন’ বদলে হয়েছে ‘হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন।’ মিটিং-মিছিলেই হোক বা ব্রিটিশরাজের আদালতের বিচারঘরে, বিপ্লবীদের সমর্থনে, প্রতিবাদের স্লোগান উঠেছে— ‘ইনকিলাব’। অবদমন আর হাস্যকর ট্রায়ালের চোখে চোখ রেখে সমবেত কণ্ঠে বোল উঠেছে ‘সরফরোশি কি তমান্না অব হামারে দিল মে হ্যায়’। রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা খান সহ আরও বিপ্লবীর সমবেত রচনা ‘মেরা রং দে বসন্তী চোলা’, দিন বদলের স্বপ্নে রোমান্সের গান গাওয়া হয়েছে।

ঘটনাবহুল ১৯২০-র দশকে অঙ্কুরিত হয়েছে পরবর্তী একশো বছরের উপমহাদেশীয় সমাজনীতির নানা প্রশ্ন। যে ঘূর্ণাবর্তে এগিয়েছে দেশীয় রাজনীতি, তার ঐতিহাসিক ভাঁড়ার হল সেই সময়। অসহযোগী আন্দোলনে গাঁধীজি ‘স্বরাজ’-এর সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলেন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার আলি ভাইদের খিলাফত আন্দোলনকে। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অহিংস অসহযোগিতা মোড় নিয়েছিল হিংসাত্মক ব্রিটিশ বিরোধিতায়। পরাধীন দেশের বিভিন্ন স্তরকে বহুমাত্রিক একটা মন্থনের ইঙ্গিত দিয়ে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’, ১৯২৫ সালে। জাতীয় কংগ্রেসের সমান্তরাল এক জাতীয়তাবাদী স্রোতে সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ প্যামফ্লেটকে অবলম্বন করে তৈরি হল হেগড়েওয়ারের আরএসএস। জাতীয় কংগ্রেসের নয়া প্রজন্মের ‘সেকুলার’ অনুসন্ধানকে চ্যালেঞ্জ করতেই প্রান্তিক হয়ে পড়া ‘প্রাচীন’ কংগ্রেসিরা কট্টর হিন্দুবাদকে আঁকড়ে ধরেন।

পাশাপাশি, ১৯২৭-এর অল ইন্ডিয়া উইমেনস কনফারেন্স গঠনের মাধ্যমে পুরুষ নেতৃত্বের হাত ছেড়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন নারী আন্দোলন পা রাখে। ১৯২৫-এ শ্রমিক-কৃষক স্বার্থে আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন শুধু নয়, অসাম্যের গভীরতম প্রশ্নও জনসমক্ষে উঠে আসে এই দশকেই। জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যবিন্দুর বাইরেও এই দেশে ‘স্বাধীনতা’ ও সমতার সমান্তরাল একটা আকাঙ্ক্ষা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মাহাড় সত্যাগ্রহের মাধ্যমে। ১৯২৭-এ মহারাষ্ট্রের মাহাড় অঞ্চলে চাভদার সর্বজনীন জলের ট্যাঙ্ক থেকে জলপান করে সনাতন হিন্দু ধর্মের অস্পৃশ্যতাকে অমান্য করেন অম্বেডকর।

এর পরের দুই দশকে দ্রুত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে ভারতের যে ইতিহাস, সেখানে নানা আঙ্গিকের সমাজবিন্যাসের মসৃণ কোনও চিত্র তৈরি হয়নি। ইউরোপীয় স্বাধীন ‘নেশন-স্টেট’-এর একমাত্রিক অভিজ্ঞতা এ দেশে তাই অচল। সামাজিক বিন্যাসের যৌক্তিক পরিণামের বদলে অনেকটাই উপহার হিসেবে আমাদের হাতে এসেছে স্বাধীন ভারতের আইন প্রণয়নকারী সংবিধান। এই বিশাল কর্মকাণ্ডটি সম্পন্ন হয়েছিল অম্বেডকরের সংবিধান ড্রাফ্টিং কমিটির সভাপতিত্বে। ভারতীয় সংবিধানের মূল সুর বেঁধে দিয়েছে মৌলিক অধিকারের পরিচ্ছেদ। অম্বেডকর ভেবেছিলেন এই অধিকার লাভের ফলে সমতা আর যুক্তির দিশায় গড়ে উঠবে সামাজিক কাঠামো। রাষ্ট্রের দায়িত্ব আর অধিকারের পেলব মিলমিশে আমাদের হাতে এই সংবিধান তুলে দিয়েছে নাগরিকত্ব। বেশ কয়েক বার নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। সাম্প্রতিকতম পরিবর্তনে ধর্মীয় অনুষঙ্গ এসেছে। অনিশ্চয়তা, জনপরিসরে প্রতিবাদ বর্তমান সময়ে নাগরিকত্বের এই নয়া অনুষঙ্গ নিয়েই।

একশো বছর পিছিয়ে ভারতকে ফিরে দেখার দুটো উদ্দেশ্য। এক, এই প্রশ্ন তোলা যে বহুমাত্রিক বিভাজনে সমাজগোষ্ঠীর অসম বিকাশ যে দেশে, সেখানে এক লহমায় ‘ইকুয়ালিটি’ আর ‘লিবার্টি’ কী ভাবে প্রয়োগসফল হবে? উন্নত সামাজিক আদর্শে কখনওই এক লাফে পৌঁছনো যায় না। সৌভ্রাতৃত্ব হল যে কোনও আধুনিক সমাজব্যবস্থার প্রাথমিক শর্ত। সাম্যব্যবস্থা, সমতার ভিত্তিতে মুক্তি এই সব অনেক পরের কথা। যে সমাজে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আন্তর্সম্পর্কের বৈষম্য বা ভিন্নতা ধর্মীয় ভিত্তিতে সাজানো, তার থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে স্বয়ং অম্বেডকর নিদান দিয়েছিলেন সেই ধর্মীয় শাস্ত্রকে সমূলে ছুড়ে ফেলতে। পরবর্তী সময়ে আশা করেছিলেন, সাংবিধানিক সুবুদ্ধি হয়তো কালক্রমে ভ্রাতৃসুলভ সমাজ গড়তে সাহায্য করবে।

দুই, পাশাপাশি আমরা দেখতে পারি ক্লাসিকাল নাগরিক অধিকার লাভের বিশ্ব-ইতিহাস। নাগরিকত্বের অধিকার মূলত উদারসমাজ-সৃষ্ট। কোনও সম্প্রদায় বা সমাজের পূর্ণ সদস্য হিসেবে সমস্ত পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের অংশগ্রহণের অধিকার পাওয়াই হল নাগরিকত্বের গোড়ার কথা। সাবেক ইউরোপীয় ইতিহাসে গণ অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার আর সামাজিক অধিকার, এই তিন অধিকারের সমন্বয়ে নাগরিকত্বের বিশ্লেষণ করেছেন সমাজবিজ্ঞানী থমাস মার্শাল। বিংশ শতাব্দীর পরবর্তী আধুনিক সমাজে এই তিন ধরনের অধিকার একে অপরের পরিপূরক হিসেবেই নাগরিকত্বকে সমৃদ্ধ করেছে। ধনতন্ত্রের বিকাশে অসম সমাজে সক্রিয় গণআন্দোলনের ফলেই এই অধিকারগুলো মান্যতা আদায় করে নিয়েছে। শ্রেণি-সক্রিয়তার অনেক গোড়ায় রয়েছে ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক স্থাপনের লড়াই। অর্থাৎ, ঘুরে ফিরে সেই সৌভ্রাত্রের ভিত্তিতেই ধাপে ধাপে আধুনিক সমাজ নাগরিকত্বের স্বাদ পেতে পারে।

কাগজে কলমে দেশের নাগরিক হিসেবে মান্যতা পাওয়াই নাগরিকত্বের মূল কথা নয়। আবশ্যিক শর্তগুলো টপকে যে সাংবিধানিক নাগরিকত্ব পেয়ে আমরা খুশি থেকেছি, তাতে অনেক ঐতিহাসিক প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে গিয়েছি অথবা সমাজ উত্তরণের অনেক ধাপ অতিক্রম অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে। ঠিক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বিতর্ক থেকে অনেক ‘পিছিয়ে’ একটা সামগ্রিক একতার কথা বলার সুযোগ এসে গিয়েছে এই সময়ে। ফেলে আসা অনেক দ্বন্দ্বের সঙ্গে নয়া প্রজন্মকে মুখোমুখি হতে হবে। শুধুমাত্র সংখ্যালঘু ধর্মীয় আবেগ নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের একটা বিরাট অংশ কিন্তু মূলস্রোতে ব্রাত্য। আধুনিক সমাজ গঠনের ‘অআকখ’-টা এই নতুন দশকে আমরা ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আইনসভায় সাবেক বিরোধী স্বরের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ায় একটা নতুন দিকদিগন্ত খুলে যাচ্ছে। জন পরিসর— জন মহল্লায়, রাজপথে নয়া প্রজন্মের নয়া স্বর আশা করতেই পারি এ সময়ে। ইতিমধ্যেই দেখেছি রাজধানীর নন-এলিট মহল্লায় ‘জাহিল-অনপঢ়’ মহিলারা ধর্নায় বসেছেন, খাঁচা ভেঙে ‘পিঞ্জরাতোড়’ গোষ্ঠী বলছে, হয়তো নারীরাই পারবেন হিন্দুরাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে।

অন্য বিষয়গুলি:

CAA NRC NPR National Flag Anti CAA movement
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy